বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করের ১০৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি ও উদয়ন কলাকেন্দ্রের উদ্যোগে ২৭ জুন বেহালা শরৎসদনে ‘অর্ঘ্য’ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কালমৃগয়া’ মঞ্চস্থ হল। উদয়শঙ্কর-প্রবর্তিত নৃত্যধারাকে নৃত্যচর্চার মাধ্যমে বয়ে নিয়ে চলেছেন অমলাশঙ্করের সুযোগ্যা কন্যা মমতাশঙ্কর। নিয়মিত নৃত্যশিক্ষা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চায়িত করছেন তিনি। সে দিন ‘অর্ঘ্য’ অনুষ্ঠানে উদয়শঙ্করের প্রয়াত পুত্র আনন্দশঙ্করের সঙ্গীত রচনা ও অমলাশঙ্করের নৃত্য পরিকল্পনায় একটি উপস্থাপনা ‘মিসিং ইউ’। সুর ও নৃত্যের পরম্পরা ফিরে দেখা গেল মমতাশঙ্করের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থাপনায়।
আলমোড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে যে নৃত্যচর্চার সূচনা, তা আজ বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্করের পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে। ভারতে সৃজনশীল নৃত্যের জনক উদয়শঙ্করের নৃত্যনির্মাণের যে নান্দনিক সৃষ্টির বীজটি উপ্ত হয়, তা অমলাশঙ্কর ও পরে মমতাশঙ্করের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পল্লবিত হয়ে এক অসামান্য নৃত্যধারার রূপ ধারণ করেছে। সেতারবাদক দীপক চৌধুরীর সুর নির্মাণে, মমতাশঙ্করের নৃত্য পরিকল্পনায় উদয়ন কলাকেন্দ্রের শিল্পীদের লোকনৃত্যে দর্শকেরা উদয়শঙ্করের নৃত্যধারার পরম্পরাকেই প্রত্যক্ষ করলেন। মমতাশঙ্করের নৃত্য পরিকল্পনায় আরও একটি নিবেদন ‘সোহো’ (সঙ্গীত সৃজন কিতারো) দর্শকদের ভাল লাগে।
অমলাশঙ্করের নৃত্যের চিত্রায়ণ প্রদর্শিত হয় ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্রের টুকরো ছবি দিয়ে গাঁথা— এভারগ্রিন মেমোরিজ়। দূরদর্শনে এক সময়ে নৃত্যনির্মাণের নেপথ্যকাহিনি বর্ণনা করেছিলেন অমলাশঙ্কর টুকরো ছবির সঙ্গে। দর্শকের মনে সে স্মৃতি আজও অম্লান। এই ফিল্মটি দেখা এক বিরল অভিজ্ঞতা। সৃজনশীল নৃত্যশিল্পীদের ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র দেখা আবশ্যিক হওয়া উচিত। একটি নৃত্যধারা গড়ে উঠছে, তার ইতিহাস ধরা রয়েছে এই চলচ্চিত্রে। সে দিনের অনুষ্ঠানে ‘কল্পনা’র অংশবিশেষের উপস্থাপনার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই।
সে দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ ও ‘মায়ার খেলা’র যুগে রবীন্দ্রনৃত্যের আদি পর্বে নৃত্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়। ১৮৮২ সালে ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্য রচিত হয়। রামায়ণে বর্ণিত দশরথ কর্তৃক অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধু বধের আখ্যান এই নাট্যের উপজীব্য। গীতিনাট্যকে নৃত্যনাট্যের আঙ্গিকে উদয়শঙ্কর ঘরানার নৃত্যধারায় মমতাশঙ্করের নৃত্য পরিচালনায় ‘কালমৃগয়া’ মঞ্চস্থ করা হয়। মমতাশঙ্কর বনদেবীর ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন। পোশাকের পরিকল্পনাও তাঁরই। আলোকসম্পাত— রাতুলশঙ্কর ঘোষ। শব্দ প্রক্ষেপণ— কৃষ্ণজিৎ মুনশি ও সৌমিত্র দাস। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন চন্দ্রোদয় ঘোষ৷
অনুশষ্ঠান
- সম্প্রতি কসবা সুরঞ্জনীর উদ্যোগে রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হল শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠান। প্রথম পর্বে শান্তিনিকেতনের তিনজন শিল্পী প্রশান্ত ঘোষ, প্রলিপ্ত ঘোষ ও পলাশী ঘোষের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ৭টি গান। দ্বিতীয়ার্ধে আচার্যের সংক্ষিপ্ত জীবনকথা ও তাঁর কৃত স্বরলিপির কয়েকটি গানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয় কসবা সুরঞ্জনীর শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘আমার আপন গান’। পরিকল্পনা, বিন্যাস ও পরিচালনায় ছিলেন রীণা মুখোপাধ্যায়। বাচিকশিল্পী দেবাশিস বসু ও রীণা মুখোপাধ্যায়ের পাঠের সঙ্গে একক, দ্বৈত ও সমবেত সঙ্গীত সুমধুর। পল্লবী রুজের পরিচালনায় নৃত্যানুষ্ঠানটিও হৃদয়গ্রাহী। একক সঙ্গীতে ছিলেন মালিকা চক্রবর্তী, মৌসুমী মণ্ডল, দীপাঞ্জন পাল, সায়ন মিত্র, প্রীতম চক্রবর্তী, ভাস্বতী ভট্টাচার্য, চন্দনা সামন্ত ও স্বয়ং রীণা মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে দ্বৈত সঙ্গীতে ছিলেন বাসব ঘোষ ও লেখা বিশ্বাস, দীপাঞ্জন পাল ও সিদ্ধার্থ বিশ্বাস, অভিরূপ গুহ ও তপশ্রী রায়, রাজশীর্ষ দাস ও রূপশীর্ষ দাস। যন্ত্রানুষঙ্গের যথাযত সঙ্গত, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত, ধ্বনি প্রক্ষেপণ... সবেতেই ছিল মৌলিকতা ও সৃজনশীলতার এক মেলবন্ধন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অনুপ মতিলাল।
- সহজিয়া নাট্যগোষ্ঠীর নাটক ‘বীজ’ উপস্থাপিত হল সম্প্রতি মধুসূদন মঞ্চে। সহজিয়া নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় পরিচালক রূপকথা সেনগুপ্ত। পচনশীল সমাজ, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ, অনৈতিক রাস্তায় হঠাৎ ধনী হওয়ার হাতছানি এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তাই এই নাটকের উপজীব্য। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গতানুগতিক জীবন, ভয়ে, ভীতিতে, ভালবাসায়, প্রলোভনে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো এই নাটকের আখ্যান ভাগ। তার মধ্যে অঙ্কুরিত হয় প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। প্রত্যেক অভিনেতা ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু নাটকের চালিকাশক্তি পরিচালক ও অভিনেতা রূপকথা সেনগুপ্ত। মঞ্চে জবার ভূমিকায় তাঁর দৃশ্য উল্লেখযোগ্য। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, একদা বিপ্লবী ঊষানাথের চরিত্রে বিশ্বজিৎ সমাদ্দারের অভিনয় জীবন্ত। নিশানাথের ভূমিকায় জীবন মুখোপাধ্যায় মানানসই। দারিদ্রক্লিষ্ট পরিবারের কর্তা শুধুই দর্শক। নাটকটি যত এগিয়েছে, আশালতার ভূমিকায় মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী তত পরিণত হয়েছেন। বিরতির পর প্রতিবাদী শুভর আগমন। স্বল্প পরিসরে শুভ্রাংশু চট্টোপাধ্যায় অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। পরিশেষে বলতে হবে মালা বা মালুর ভূমিকায় গৈরিকা সেনগুপ্ত অল্প পরিসরে বয়ঃসন্ধির একটি মেয়ের ভূমিকায় যথাযথ। নাটকের আবহ, মঞ্চ ও আলো উপযুক্ত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)