মনোজ মিত্র নিজেই ধরা দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি এখনও অভিনয়ের শেষ কথা। মঞ্চে তাঁর আগমন এবং সহজ সরল সংলাপে কোথায় যেন লুকিয়ে আছে বাবা-ঠাকুর্দার কাছে ছোটবেলায় শোনা সেই সব সংলাপ এবং কথা বলার ভঙ্গি।
কারণ তিনি মনোজ মিত্র। নাটক করেন কিন্তু নাটকীয়তা পছন্দ করেন না। দেশভাগের সেই যন্ত্রণা তিনি নিজে নাটকের চরিত্রে শুষে নিতে পারেন। কিন্তু কোথায় যেন বুক ফাটা আর্তনাদ গ্রাস করে নেয় সব হারাবার কান্নায়। অথচ মুখের ম্লান হাসি মিলিয়ে যায় না একটি বারের জন্যেও। তাই যখন শিশুটিকে অন্যের হেফাজতে রাখতে গিয়ে বলে ওঠেন, ‘বাচ্চাটাকে একটু রাখতে পারো মা জননী? আমি একটা ব্যবস্থা করে এসে ওকে ঠিক নিয়ে যাব’। অনেক দর্শকই তখন চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
সুন্দরম প্রযোজিত ‘জাদুবংশ’ নাটকটি কোথায় যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল মনকে, আবেগকে আর দেশ ভাগের যন্ত্রণাকেও। ছিন্নমূল..বাস্তুহারা...মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পালিয়ে বেড়ানো। কিন্তু ওরাও তো মানুষ। মানবিকতার কাছে হাতজোড় করা ক্ষুধার্ত কিছু মানুষ। চুরি নয়, কর্মের জোরে আমরাও বাঁচতে চাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা।
আরে এমন কথাই তো শৈশবে বাবার কাছে শুনেছিলাম। কেঁদেছিলাম। এমন হয় নাকি? হয়। বাবার সেই অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের চোখের জলে নতুন করে প্রমাণ দিলেন মনোজ মিত্র। এটাই অভিনয় জীবনের বড় সার্থকতা। দেশভাগের কারণে একটি শিশু হারিয়ে গেছে। অনাথ। শিশুটি জানে না, সাম্প্রদায়িক কারণে তার বাবা ও মা কেউই জীবিত নেই। সব স্বপ্ন বুড়িগঙ্গার জলে ভেসে গেছে।
এখানেই সানাই চরিত্রটি মুখ্য হয়ে ওঠে। সানাই নামের চরিত্রটি এই নাটকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সে নিজেকে রবিঠাকুরের আত্মীয় বলে মনে করে। তাঁকেই দাদাঠাকুর বলে ডাকে। সানাই মনে করেন, দাদাঠাকুর বেঁচে থাকলে এমনভাবে দেশ-ভাগ হত না। এভাবে এই নাটকে এই প্রসঙ্গ এনে মনোজ মিত্র যেন নাটকে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। বলতে চেয়েছেন, ভৌগোলিক বেড়া মানে না কোনও মানবিক সম্পর্ক যা বেঁচে থাকে ভালবাসার ‘জাদু’তে।
রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে মনোজ মিত্র তুলনাহীন। নাটকের গতি ধরে রাখতে পাল্লা দিয়েছেন অন্যান্যরাও। অসাধারণ টিমওয়ার্ক। যেমন নন্দরানী (ময়ূরী ঘোষ) চরিত্রের কথা। যার সন্তান লাভের আকুতি কোথায় যেন ছুঁয়ে যায় নারী মনকে। জাদুগোপাল (সমর দাস), নাড়ুগোপাল ( সুব্রত চৌধুরী), ফাগুন (অদিতি ঘোষ), ধুর্জটি (প্রিয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়) ছাতাওয়ালা (অতনু বসু) চরিত্রগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy