বাস্তববাদ: মনামী পালের কিছু কাজ
ওয়াশ পেন্টিংয়ের ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে আজও গর্বের সীমা নেই। অথচ প্রাতঃস্মরণীয় সেই শিল্পীদের অনেকেই কিন্তু আজ বিস্মৃতপ্রায়। মাধ্যমটি একে তো প্রায়-অদৃশ্য, তবুও কেউ কেউ এর মাহাত্ম্য অনুভব করে কাজ করে চলেছেন। এঁদের সকলেই যে ভারতীয় শিল্পীদের অবিস্মরণীয় কাজগুলি দেখেছেন বা স্মরণে রেখেছেন, তা কিন্তু নয়। এক সময়ে কলকাতার সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে এই মাধ্যমটি যথেষ্ট গুরুত্ব-সহকারে শেখানো হত। ছাত্র-ছাত্রীরাও সে ভাবেই এই মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে চমৎকার সব কাজ করেছেন, যা এখনও অনেকে চালু রেখেছেন। তবে যে অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা এই মাধ্যমের জন্য প্রয়োজন, তা আর সে ভাবে আজ দেখা যায় না। যদিও এখনও কিছু ভাল শিক্ষক আছেন ওই মহাবিদ্যালয়ে, যাঁরা দক্ষতার সঙ্গেই মাধ্যমটিকে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করান। এখন এই মাধ্যমটি নিয়ে খুব বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী অনুপ্রাণিত হন না। অ্যাক্রিলিক, মিক্সড মিডিয়ায় তাঁরা যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, অন্যগুলিতে তেমন নয়। অয়েল তো ধূসর দিগন্ত, পিয়োর ওয়াটার কালারেও আগের মতো উৎসাহ দেখা যায় না। ওয়াশ পেন্টিং সেখানে অনেকটাই নিষ্প্রভ।
মনামী পাল একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। ১৩ বছর আগে বাংলায় স্নাতক পর্ব শেষ করে চিত্রচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ওই বছরের শেষ দিকেই তিনি শিল্পী রবীন্দ্রনাথ চৌধুরীর কাছে নাড়া বেঁধে, শিল্পশিক্ষার পাঠ নেন। আজও সেই ধারাবাহিক চর্চা অব্যাহত। মনামী কিন্তু মাধ্যম হিসেবে ওয়াশ পেন্টিংকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে কাজ করে চলেছেন। তাঁর এই নিষ্ঠার পিছনে মাস্টারমশাইয়ের অবদান বিরাট। তিনি যে ভাবে একজন নবাগতকে ওয়াশ পেন্টিংয়ে অনুপ্রাণিত করে হাতেকলমে কাজ শিখিয়েছেন, এ বড় কম কথা নয়। বিশেষত, তাঁর উৎসাহেই মনামী অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সম্প্রতি ওঁর ১৬টি কাজ নিয়ে প্রথম প্রদর্শনীটি সম্পন্ন করলেন। একটি মাত্র সাদা-কালো লিনোকাট ছিল, পাঁচটি টেম্পারা, বাকি সব ওয়াশ। যদিও অত্যধিক রুক্ষ ত্বকের কাগজ ও হ্যান্ডমেড কাগজে বেশ কিছু ওয়াশ পেন্টিং ছিল, যা অভিপ্রেত নয়। এই মাধ্যমের জন্য যে সব কাগজ প্রয়োজন— টেক্সচারাল কোয়ালিটির নমনীয়তা, জল ও রং-ধারণ ক্ষমতা এবং ওয়াশের জন্য আদর্শগত ত্বকের গুণাগুণ-সর্বস্বতা, এগুলি সম্পর্কে মনামীর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সময় হয়েছে। ওয়াশ পেন্টিংয়ে রং ও বিশেষ করে কাগজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর পর আসবে ক্রমান্বয়ে কয়েকটি দিক— রচনা, পরিসর, বিন্যাস, ড্রয়িং, সূক্ষ্মতা, ডিটেলিং, তুলির ব্যবহার, ধৌত পদ্ধতির ক্রম... ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি ওয়াশ পেন্টিং কার্যকর হয়ে ওঠে।
মনামীর প্রথম প্রদর্শনীর কাজগুলি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই তাঁর দুর্বলতার দিকগুলি বলতে হয়। কাজ যে যথেষ্ট গুরুত্ব-সহ শিখেছেন বা করছেন, বোঝা যায়। তবু কিছু ক্ষেত্রে তো সমস্যা থাকবেই, যাকে অচিরেই কাটাতে হবে। ওঁর কাজে বর্ণ বড় লাবণ্যময় হতে হতেও কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাগজের রুক্ষ ত্বকের কারণেই। তবুও শিল্পী বহু ক্ষেত্রেই বর্ণের সেই নমনীয়তা রাখতে চেষ্টা করে গিয়েছেন। কন্টুর লাইনে যেমন ভীষণ রকম সরু ও সূক্ষ্ম তুলির নির্দিষ্ট চলন, আবার হঠাৎ কোথাও একটু কর্কশ হয়েছে। রেখার এই টানগুলিতে তুলির চাপের আধিক্য ছবিকে একটু হলেও বাধা দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও সামগ্রিক ভাবে তাঁর কাজ কিন্তু যথেষ্টই চিত্তাকর্ষক। ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রে চমৎকার রিয়্যালিজ়ম রেখেছেন, বিন্যাসও যথাযথ, দৃশ্যাবলি ও ঘটনাগুলির সমন্বয় ও সামঞ্জস্য সুন্দর, বিশেষত কম্পোজ়িশন ও সময়। আলো-আঁধারি মায়াবী পরিবেশ ওয়াশ ছবির অন্যতম দিক, যা মনামী তাঁর কাজে রাখতে চেষ্টা করে সফলই হয়েছেন, বলা যায়। তাঁকে এ বার ভাবতে হবে পরিসর নিয়ে। অ্যারেঞ্জমেন্টে কোথাও কোথাও অবয়বের বাহুল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। স্পেসকে কোথাও ছাড়তে জানতে হয়।
বেশি অবয়বের কর্মদক্ষতা সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনহীন। ধৌত চিত্রের ক্ষেত্রে স্পেসের শূন্যতা ও জমাট সংগঠনের রচনা দুই-ই দেখা যায়। সেখানে চিত্রের সার্বিক দিকটিকে ভারসাম্যের মধ্যে রেখে তা করতে হবে। তাঁর প্রতিটি চরিত্রের অভিব্যক্তি, বর্ণবিন্যাস ও পরত, নিকট-দূরের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, আলো-আঁধারের আশ্চর্য সমীকরণ, গ্রাম্য উপচার-অনুষ্ঠানের বাস্তবতা, পুজো-পার্বণের ঐকান্তিক আয়োজনের দৃশ্য, মাছ ধরার কৌশল, প্রাকৃতিক দৃশ্য, পুষ্প, পদ্মপাতা, সাপ, জলে শরীর ডোবানো ব্যাং, বর্ষাকাল, নবপত্রিকা বরণ কাজগুলিতে এই নবাগতার স্টাইলাইজ়েশন ও ওয়াশ টেকনিকের পদ্ধতিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy