Advertisement
E-Paper

পৌষের অমর্ত্য

তাঁর অন্তরাত্মায় অর্থনীতি, তবু একান্ত আলাপে জেগে উঠল অমরত্ব, ঈশ্বরভাবনা, পরকাল...! এ কোন অমর্ত্য সেন? শান্তিনিকেতনে তাঁকে নিয়ে সুমন ঘোষের তথ্যচিত্র তৈরির শ্যুটিং-এ হাজির স্বাতী ভট্টাচার্যতাঁর অন্তরাত্মায় অর্থনীতি, তবু একান্ত আলাপে জেগে উঠল অমরত্ব, ঈশ্বরভাবনা, পরকাল...! এ কোন অমর্ত্য সেন? শান্তিনিকেতনে তাঁকে নিয়ে সুমন ঘোষের তথ্যচিত্র তৈরির শ্যুটিং-এ হাজির স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:০৮
মুখোমুখি অমর্ত্য সেন ও কৌশিক বসু

মুখোমুখি অমর্ত্য সেন ও কৌশিক বসু

সকাল সকাল মুড খারাপ।

কাচের মন্দির চত্বরে পৌঁছেই বকে দিলেন ছাত্রকে।— ‘‘ফোনটা বন্ধ করে রেখেছ কেন? সকাল থেকে ফোন করে পাচ্ছি না।’’

পাশে দাঁড়ানো ছাত্রের ছাত্র, তাঁর দিকে ফিরে বললেন, ‘‘আর তুমি তো কাল রাতে তোমার নম্বরটা দিতেই ভুলে গেলে।’’

বকুনি-খাওয়া ছাত্র কৌশিক বসু। এই সে দিন পর্যন্ত ছিলেন বিশ্বব্যাঙ্কের চিফ ইকোনমিস্ট, ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। খুব কম লোকই তাঁকে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ‘স্যর’ যে প্রফেসর সেন।

অতএব বিনীত গলায় ‘আমার আমেরিকার নম্বরটা কাজ করছে’ এক্সকিউজটা উড়ে গেল অমর্ত্যের সপাট জবাবে, ‘‘সেটা আমার অকার করেনি।’’

তরুণ তুর্কি সুমন ঘোষ অবশ্য বকুনি বেমালুম হজম করে ক্যামেরা শুরু করার জন্য উসখুস করছেন। অমর্ত্য সেন তাঁর ‘অ্যাকাডেমিক গ্র্যান্ডফাদার।’

সুমনের পিএইচ ডি গাইড কৌশিক, কৌশিকের গাইড ছিলেন অমর্ত্য। পনেরো বছর আগে অমর্ত্য সেনের উপর তাঁর ছবির প্রথম অংশটা তুলেছিলেন সুমন, এখন তুলছেন শেষটা। দীর্ঘ পরিচয় সাহসী করেছে সুমনকে। যাঁরা নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-উপাচার্যদের, গোটা দিন তেমন দু’জনকে দিব্যি নির্দেশ দিয়ে গেলেন অর্থনীতির অধ্যাপক-কাম-ফিল্ম পরিচালক। ‘আর একটু জোরে বলুন’, ‘একটু এ দিকে সরুন’, ‘আর একবার হেঁটে আসুন’ ...

‘‘আমি কিন্তু বকুনি খেতে দেখেছি অমর্ত্য সেনকে,’’ চা খেতে খেতে বলছিলেন সুমন। তখন বেঁচে মা অমিতা সেন। অমর্ত্যের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। অমিতা বারবার বলছিলেন, ‘সুমন খেয়ে নাও,’ আর সুমন উত্তর দিচ্ছিলেন, ‘‘আমি খেয়ে এসেছি মাসিমা।’’

শেষে অমর্ত্যবাবু আপত্তি করতেই অমিতার ধমক, ‘‘আমি একশোবার খেতে বলব, ও একশোবার না বলবে। তুই কিছু বলবি কেন?’’ পিছু হঠেছিলেন অমর্ত্য, ‘‘আচ্ছা তুমি বলো।’’

এ যেমন মানুষগুলোর পরিচয়, তেমনি স্থানটিরও। স্থাপত্য, ভাস্কর্য থেকে জীবনচর্যা, সব কিছুতে অনাড়ম্বর সহজ-সুন্দরের সাধনা শান্তিনিকেতনের স্বভাব। খ্যাতি-প্রভাব-ক্ষমতাকে দরজার বাইরে চটিজোড়ার মতো খুলে রেখে আসতে হয়। বিখ্যাত লোক তো কম দেখেনি এই মন্দির চত্বর, ওই আম্রকুঞ্জ!

পৌষমেলা সবে শেষ হয়েছে, নরম রোদ জাফরি কেটেছে লাল মাটির নুড়ি-ছড়ানো পথে।

ক্যামেরা চলছে, মন্দিরের ঘণ্টা-ঝোলানো গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কৌশিক বলছেন, ‘‘এই শান্তিনিকেতন আশ্রম ভবনেই আপনি গাঁধীজির সঙ্গে আধঘণ্টাটাক কথার বলার সুযোগ পেয়েছিলেন না?’’

মিটার পঞ্চাশেক পথ, শৈশবের স্মৃতিতে তা ধরে হাঁটা শুরু। পথের শেষে এসে উঠল এখনকার কাজের কথা।

সত্তরের দশকে বেরোনো ‘কালেক্টিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার’ বইটির নতুন সংস্করণ বেরোবে। ছ’নম্বর প্রুফ দেখা চলছে। অমর্ত্য বললেন, ‘‘লাইফ ইজ ফাইনাইট। যা বলতে চাই তার সব হয়তো বলা হবে না, আশা করছি অনেকটাই বলা যাবে।’’

সুমন বললেন, ‘‘কাট।’’

কাটু টু আফটারনুন। ‘প্রতীচী’ বাড়ির প্রশস্ত বারান্দা, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ার।

অমর্ত্যের বিশাল, বিচিত্র কাজের পর্যালোচনা যে অল্প ক’জন করেছেন, তাঁদের একজন কৌশিক। তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায় দুই অমর্ত্য সেনের কথা।

‘সেন ওয়ান’ যিনি তুখড় তাত্ত্বিক, সাধারণের বুদ্ধির অগম্য।

আর ‘সেন টু’ যিনি অপুষ্টি, দারিদ্র, ন্যায়-নৈতিকতা সম্পর্কে খবরের কাগজে, পপুলার বইতে লিখে চলেছেন।

দ্বিতীয় জনকে বোঝা সহজ।

প্রথম জন অতি কঠিন।

কিন্তু চার দশকেও বুঝতে পারেননি শিষ্য, অমর্ত্য সেনের এমন দিক রয়ে গিয়েছে। প্রতীচীর বারান্দায় বসে সেই প্রশ্নই কৌশিক করলেন।—

‘‘আপনি তো কই মৃত্যু, মরণশীলতা নিয়ে কখনও কিছু বলেননি?’’

হার্ভার্ড, কেমব্রিজ বা কলকাতায় এ প্রশ্নটা করতে পারতেন কি কৌশিক? নাকি পিতা আশুতোষ সেনের তৈরি বাড়িটির জন্য এই প্রশ্নটা অপেক্ষা করছিল?

ছায়া পড়ে এসেছে বারান্দায়। তিরাশি আর চৌষট্টি মুখোমুখি।

‘‘চলে যেতে হবে, এই চিন্তাটা দুঃখের তো বটেই। বেঁচে থাকা আমি উপভোগ করি,’’ বললেন অমর্ত্য। উ়ডি অ্যালেনের কথা তুলে মজা করে বললেন, ‘‘আমি অমর হতে চাই, তবে তা লোকের স্মৃতিতে নয়, মরে না গিয়ে বেঁচে থেকে।’’

অমর্ত্য মৃত্যু, পরকাল, ঈশ্বর, সম্পর্কে দু’চারটি কথা যা বললেন, সে তাঁর বিস্তৃত জ্ঞান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়েই যেন কেটে কেটে দেখা বিষয়কে।

জীবনের আগে আর পরে যে অনন্ত অনস্তিত্ব, তার ধারণা করা কঠিন। মানুষের চেতনার বাইরে পৃথক কোনও ব্রহ্মাণ্ড আছে কি না, তা-ই বা বলা যায় কী করে?

গৌতম বুদ্ধের কথা তুলে বললেন, ঈশ্বর আছেন কি না জানা যায় না— সম্ভবত নেই। আর তার প্রয়োজনও নেই নৈতিক দিক থেকে— এটা বুদ্ধদেব পরিষ্কারভাবেই বলেছেন।— ‘‘কেন আমাদের ভাল আচরণ করা উচিত, তার উত্তর খুঁজতে ঈশ্বরের ধারণাকে টেনে আনার প্রয়োজন হয় না।’’

খানিক আগে আম্রকুঞ্জে বসে যে স্বরে, যে ছন্দে কথা বলেছেন অর্থনীতির তত্ত্ব, অসহনশীলতা, ন্যায়, হিংসা নিয়ে, ঠিক তেমন উচ্চারণেই বললেন, ‘‘আমি মৃত্যু নিয়ে উদাসীন নই। আমি জানি মৃত্যু আসবে। এবং পরিচিত পৃথিবী, সূর্য, অন্যান্য তারাও নিভবে। তারপর কী হতে পারে তা ভাবা কঠিন। কিছুই সম্ভব নয় এমনটাও বলা কঠিন। কিন্তু ঈশ্বরকে আমদানি করে অনিশ্চিতকে নিশ্চিত করে, অজানাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার যে লোভ, তা সম্বরণ করার পক্ষে যুক্তি আছে।’’

প্রৌঢ়বেলায়

অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে অনেক কিছুই যে আমরা জানি না, এটাই সত্য। সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে মন্দ লাগে না, কিন্তু তার চাইতে জরুরি কাজ তাঁর আছে। আছে আজকের দিনের দারিদ্র ও গরিবদের উপর অত্যাচারের কারণেই।

তা হয়তো আছে। কিন্তু এমন ভাবে বিচার করে কেউ বাঁচে নাকি?

শুটিং-এর মধ্যে কয়েক মুহূর্ত ফাঁক পেয়ে চট করে প্রশ্নটা করেই ফেলা গেল। সবই কি বুদ্ধি? প্যাশন বলে কি জীবনে কিছু নেই?

‘‘বুদ্ধির জগৎ, অবুদ্ধির জগৎ, এমন কিছু নেই। গান, ছবি, ভাল খাবার খেয়ে সন্তুষ্টি, সে-ও তো বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে হবে। কী ভাল লাগল, তা সনাক্ত করতেও বুদ্ধি চাই। রুচির প্রশ্নও বুদ্ধি দিয়েই ঠিক করতে হয়।’’

তা বলে একজনের বুদ্ধির জগৎটুকু দিয়ে কি তাকে বোঝা যায়? এই যে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে কত লোককে চিঠি লিখেছেন। যা থেকে আশা-আশঙ্কা, উদ্বেগ-আবেগে ভরা মানুষটাকে যেন ধরাছোঁয়া যায়। কই আপনি তো তেমন কিছু লেখেননি?

‘‘রবীন্দ্রনাথ যে সংস্কৃতির লোক ছিলেন, সেখানে অনেকেই দিনের শেষে ডায়েরি বা চিঠি লিখতেন। তাঁদের চিন্তায় যে দ্বন্দ্ব, যে ঘাটতি, তা সেই লেখার মধ্যে মেলে। এ ভাবে নিজেকে তুলে ধরার প্রবণতা অন্যদের জ্ঞান আহরণের পক্ষে ভাল। বোঝা যায় লোকটাকে। তবে আমি কখনও ডায়েরি লিখিনি।’’

কেন? ‘‘সময়ের অভাব। তা ছাড়া সবাই পড়ে লাভবান হবেন, এমন বিশ্বাসের উচ্চাকাঙ্খা আছে। লেখার জোর আসে এই বিশ্বাস থেকে যে সবাই আমার বিষয়ে জানতে চান। চিঠি যাকে লেখা হয়, সেটা কিছুটা তার জন্যে, আর কিছুটা শৃন্বন্তু বিশ্বে।’’

একটু থেমে বললেন, ‘‘নানা বিষয়ে কী করা দরকার সে প্রশ্নে আমার অনিশ্চয়তার কথাও আমি লিখেছি। কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে লিখিনি।’’

এই পরিমিতিও অমর্ত্যের পরিচয়। তাঁর জ্ঞানচর্চার বিস্তৃতির মতোই। তাঁর কৌতূহল ও চর্চার পরিধি বিশাল, কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সীমা তিনি বরাবর সযত্নে, সতর্কভাবে নির্দিষ্ট করেন। হাজার চেষ্টাতেও সে সীমা কেউ পেরোতে পারে না। সাংবাদিকরা সে কথা টের পায় হাড়ে হাড়ে। যদি দু-একটা ‘এক্সক্লুসিভ বাইট’ মেলে, সেই আশায় তাঁর পিছু ছাড়তে চায় না।

শুটিং-এর দিনই সকালে একটি চ্যানেলের সাংবাদিক মর্নিং ওয়াকে তাঁর পিছু নিয়েছিল। ঘেমে-হাঁপিয়ে ‘বাইট’ মিলেছে, ‘‘হাঁটলে শরীর একটু ভাল থাকে।’’

অথচ মানুষটা যে নিজেকে আড়ালে রাখেন, এমনও নয়। যতক্ষণ শান্তিনিকেতনে থাকেন, জীবনে ‘ব্যক্তিগত’ পরিসর থাকে সামান্যই। গোটা সময়টাই গেটের ওপারে পুরুষ-মহিলার ভিড়। গেটে মোতায়েন পুলিশের নির্দেশে আটক।

‘বাচ্চাটাকে একটু ঢুকতে দিন,’ অনুরোধ এলে তিনি মেনে নেন। কলকাতা-বীরভূমের পাপারাৎজির ক্লিক-ক্লিক। মর্নিং ওয়াকে কিছুতেই সঙ্গে পুলিশ নেবেন না, অথচ পিছু ছাড়ে না সই-শিকারি, সেলফি-প্রত্যাশীর দল।

নোবেলের অর্থে প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের বার্ষিক শিক্ষক সম্মেলনে পৌঁছতেই প্রতি বছর পড়ে হুড়োহুড়ি। ঘড়ঘড়ে মাইক, নড়বড়ে চেয়ার, হুড়ুম-দুড়ুম দর্শক, কোন ইকোনমিক্স নোবেল এমন অনুষ্ঠানে কথা বলবেন, তিনি ছাড়া? আর একটা ছবি, আর একটা অটোগ্রাফ, আর একটা হ্যান্ডশেক, বারণ সত্ত্বেও আর একটা প্রণাম। তারই মধ্যে চলে লেখালেখি।

তিনি এলেই আসেন জঁ দ্রেজ। ২০০২ সালের ‘ইন্ডিয়া: ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেশন’ থেকে ২০১৩ সালের ‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি’, বহু বইয়ের ভূমিকার নীচে দেখা যায় স্থান-নির্দেশ, ‘শান্তিনিকেতন।’

বাড়ির পিছনের বাগানে শুটিং, অমর্ত্যকে ঘিরে একদল কচিকাঁচা। তাদের প্রশ্ন করছেন, ‘‘স্কুলে যেতে ভাল লাগে?’’

উঠোনে তখন বেতের চেয়ারে আধবসা দ্রেজ তন্ময় হয়ে বই পড়ে চলেছেন। হয়তো দু’জনে দুরূহ অর্থনীতির আলোচনায় বসবেন রাতে। শুটিং-এর আগের দিন ভোর তিনটে অবধি লেখালেখি করেছেন অমর্ত্য। সেন ওয়ান আর সেন টু মিলে যায় শান্তিনিকেতনে।

যে কোনও পরিবেশে যে অমর্ত্য অক্লেশে মিশে যেতে পারেন, এটা ওঁর আশ্চর্য গুণ, বলছিলেন কৌশিক। ‘‘ইংল্যান্ডের বহু লোককে দেখেছি, আমেরিকায় গিয়ে স্বচ্ছন্দ হতে পারেননি। আমার নিজেরও অসুবিধে হয়েছে একটু। কিন্তু অমর্ত্যদা সমান সাবলীল। লর্ড-লেডিদের সঙ্গে বৈঠকেও দেখেছি তিনি দিব্যি সবার সঙ্গে মিশে গিয়ে কথা বলছেন।’’

সেই লোকটিই বোলপুরের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কথা শোনেন সমান আগ্রহ নিয়ে। সুমনও লক্ষ করেছেন, পরিবেশের সঙ্গে কতটা মিশে যান অমর্ত্য।

হার্ভার্ডের কফি শপে দু’জনে যখন বসে, তখন ইংরেজি ছাড়া কথা বলেন না। আবার শান্তিনিকেতনে বাংলাই বলেন। কথার মাঝে দুয়েকটা এমন শুদ্ধ বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন, যার মানে হাতড়াতে হয় সুমনকে।

সবার সঙ্গে, সবার মতো করে এমন কথা বলার গুণ তাঁর উচ্চতার আর কোন অধ্যাপকের আছে?

কৌশিক অনেক ভেবে আর এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজের কথা বললেন, যিনি পাবলিক লেকচারে স্বচ্ছন্দ, লোকের সঙ্গে কথা বিনিময় পছন্দ করেন। ‘‘তবে অল্প কয়েকজনের যখন আড্ডা বসে, তেমন আলোচনায় দেখেছি অমর্ত্যদার কথার নির্মাণশৈলী অতুলনীয়।’’

উল্টো দিকে কেনেথ অ্যারো। অর্থনীতিতে ‘সেরার সেরা’ বলে মনে করা হয় যাঁদের, তাঁদের একজন অ্যারো। কিন্তু তাঁর কথা বোঝে সাধ্যি কার! সুমনের ছবির জন্য অমর্ত্যের কাজ সম্পর্কে বলতে রাজি হয়েছিলেন অ্যারো। ‘‘চার-পাঁচ বার তাঁকে থামিয়ে বলতে হয়েছিল, বড় বেশি তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছে, সহজ করে বলুন,’’ বললেন সুমন। ‘‘আমার বন্ধুরা বিশ্বাসই করতে চায়নি, আমি প্রবাদপ্রতিম অ্যারোকে থামিয়ে দিয়েছি।’’

অমর্ত্য সেখানে কোনও তত্ত্ব, অঙ্ক টানেন না, সাবলীল ব্যাখ্যা করেন যে কোনও বিষয়ের, বলছিলেন সুমন।

কিন্তু তা দিয়েও ব্যাখ্যা চলে না অমর্ত্যের ‘স্টার’ হয়ে ওঠার। এই প্রতিবেদকের হার্ভার্ডে দেখার সুযোগ হয়েছিল, পাকিস্তানের ছাত্রদের আয়োজিত এক সারাদিনের অনুষ্ঠানে অমর্ত্য আসা-মাত্র সকলের কী হুড়োহুড়ি!

সেখানে পণ্ডিত-বক্তার অভাব নেই, কিন্তু তাঁর প্রতি যে আগ্রহ-উচ্ছ্বাস সব দেশের, সব বয়সের ছেলেমেয়েদের, তা কমই দেখা যায়।

কৌশিকও বললেন, পেরুতে কিংবা তাইল্যান্ডে গ্রুপ তৈরি করে অমর্ত্যের কাজ নিয়ে আলোচনা করে লোকে। এমন উৎসাহ আর কোনও অর্থনীতিবিদকে নিয়ে দেখা যায় না।

‘‘হয়তো এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যেই রয়েছে। অথবা হয়তো তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ-উন্মাদনা একজনের থেকে আর একজনে যত ছড়িয়েছে, তত তার তীব্রতা বেড়েছে। আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, তবু মাঝেমাঝে মনে হয় তাঁর প্রতি মুগ্ধতা কি শুধু তাঁরই অসামান্যতার জন্য, নাকি অনেকের উচ্ছ্বাস আরও অনেকের উচ্ছ্বাস ক্রমশ বাড়িয়েছে?’’

বিশ্বে অমর্ত্যের অবস্থান এখন যেখানে তা অতি-বৃহৎ, অতি-উচ্চ। ‘‘তাঁকেও কি সকলে গুরুর জায়গায় নিয়ে বসাতে চাইছে? এ বিষয়ে অমর্ত্যদার কী প্রতিক্রিয়া, একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে হবে,’’ বললেন কৌশিক।

প্রশ্ন করলে অমর্ত্য হয়তো গুরুবাদের ইতিহাস, দর্শন, নৈতিকতা নিয়ে অনেক না-জানা কথা বলবেন। কিন্তু বলা-কথার বাইরে দেখা-কথা থেকে যায়। সুমনের গল্পে পাওয়া গেল অন্য উত্তর।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লন্ডন থেকে কলকাতা ফ্লাইট। হিথরো এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গিয়েছে দু’জনের, কথা চলছে। বোর্ডিং ঘোষণা হতে দু’জনেই এগিয়ে গিয়েছেন। ‘‘আমার খেয়াল ছিল না, আমার টিকিট ইকোনমি, ওনারটা ফার্স্ট ক্লাস। আগে ওনার বোর্ডিং। ওনার টিকিট দেখার পর বিমানকর্মী বললেন, আর ইউ টু টুগেদার? প্রফেসর সেন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টুগেদার ইন লাইফ, আনফরচুনেটলি নট টুগেদার ইন ফ্লাইট।’ তারপর সরে এসে আমার সঙ্গে অপেক্ষা করেছিলেন ইকোনমি ক্লাসের বোর্ডিং-এর জন্য।’’

শট দেওয়ার আগে পরিচালকের সঙ্গে

উচ্চতা যে দূরত্ব আনবেই, এমন কথা নেই।

সে দিনের শুটিং-এর শেষ শট। প্রতীচীর গেটের বাইরে ক্যামেরা, অমর্ত্য হেঁটে ঢুকে যাচ্ছেন বাড়িতে, সেই দৃশ্য ধরা হবে। পিছন থেকে ছবি তোলা হবে শুনে একটু আপত্তি করলেন অমর্ত্য, ‘‘সামনে থেকে নাও। পিছন থেকে ছবি তোলা পছন্দ করি না।’’

শেষে রাজি হলেন। ক্যামেরা-যন্ত্রী বলে উঠলেন, ‘‘রোলিং।’’

বেলা দেড়টা-দুটো, মোরাম-ছড়ানো রাস্তা দিয়ে অমর্ত্য হেঁটে চলেছেন দোতলা বাড়িটির দিকে।

ঢুকে গেলেন ভিতরে।

ক্যামেরার কাজ শেষ।

প্রতীচীর বাসিন্দার এখনও কাজ বাকি আছে।

ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

Amartya Sen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy