স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্তের সঙ্গে
সেই সময়কার অনেক সাহিত্যিকও তাঁদের নিজের রচনার উপর করা ছবিতে নিজেই গান লিখতেন। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়... ‘ডাকহরকরা’ (১৯৫৮) ছবির সূত্রেই তারাশঙ্করের সঙ্গে সুধীনের পরিচয়। সুধীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সুবীর হাজরা। ‘অগ্রগামী গোষ্ঠী’ তত দিনে ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’র মতো ছবি করেছে। সেখানে সুর দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। এহেন অগ্রগামীর প্রধান সরোজ দে-র কাছে সুবীর হাজরা নিয়ে যান সুধীনকে। একটা সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন। কারণ মুখচোরা সুধীনের পক্ষে সেই কাজটি করা কোনও দিনই সম্ভব হত না। অথচ তত দিনে সুধীনের সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ যথেষ্ট জনপ্রিয়। সেই গানের সূত্রেই সুযোগ পেলেন সুধীন। পরিচয় হল সাহিত্যিক তারাশঙ্করের সঙ্গে। সুধীনকে বড় ভালবাসতেন তারাশঙ্কর। ২৪ জুলাই তাঁর জন্মদিনে প্রতি বছর তিনি নিজের বাড়িতেই এক গানের আসরের আয়োজন করতেন। তাবড় শিল্পীরা আমন্ত্রিত হতেন সেখানে। ‘ডাকহরকরা’র পর সুধীনও আসতেন। সুধীন গান গাইতে বসতেন সবার শেষে। তারাশঙ্কর চুপচাপ বসে শুনতেন ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ আর অঝোরে কাঁদতেন। বলে গিয়েছিলেন, ‘আমার লেখা গান যেন সুধীন ছাড়া আর কেউ সুর না করে’।
কত কিছুর থেকেই যে সুর সেঁচে নিতেন তিনি! ‘ডাকহরকরা’ থেকে ‘হংসরাজ’— তাঁর অনেক সুরই বাউল অঙ্গের। অথচ বিলিতি পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মানুষটির সঙ্গে গ্রামবাংলার বাউল সুরের পরিচয় কোথায়? সুধীনের এক বন্ধু এবং সহকারী প্রশান্ত চৌধুরী তখন নিয়মিত যাতায়াত করতেন কৃষ্ণনগর থেকে দমদম। ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে তাঁর সঙ্গে অনেক বাউলের পরিচয় হয়। প্রশান্ত চৌধুরী তাঁদের ধরে নিয়ে আসতেন সুধীনের সিঁথির বাড়িতে। এক সময় প্রায় বাউলের আখড়া বসে গিয়েছিল ওই বাড়িতে। তাঁরা সেখানেই সারা দিন থাকতেন, খেতেন, নাচতেন, গাইতেন আর সুধীন চুপচাপ তাঁদের গানগুলো শুনে যেতেন। ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’-এর মতো অনেক গানের সুরই বাউলদের কাছ থেকে পাওয়া। এমনই এক বাউল গানের সুর তুলে প্রায় কুড়ি বছর পর
তিনি ‘হংসরাজ’-এ বসালেন আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে— ‘শহরটার এই গোলকধাঁধায় আঁধার হল মন’।
সৈকত মিত্রের মনে আছে এক দিনের ঘটনা। ‘এক বার পাড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন সুধীনকাকা। তখন অনেক মানুষই গান গেয়ে ভিক্ষা করতেন। এমনই কোনও এক জনের কাছ থেকে একটা গান শুনে বাবাকে এসে বললেন, ‘ওই গানটা রিভাইস করেছি। একটু শুনবি?’ বাবা তো অবাক! সেই গানই ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে’। আবার, শ্যামল মিত্রের কণ্ঠেই ‘ভীরু ভীরু চোখে’, ‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে’র মধ্যে স্পষ্ট পশ্চিমী সুরের ছোঁয়া। আসলে বাংলা গানকে তিনি সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। অনাবশ্যক অলংকার ছেড়ে অনেক ঝরঝরে হয়ে উঠেছিল কথা আর সুর।
মান্না দে-কে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর শুরুটাও সেই ‘ডাকহরকরা’ ছবির সূত্রেই। তার আগে অবধি মান্না দে কিছু বাংলা ছবিতে গান গাইলেও সেগুলো মূলত ছিল বম্বের প্রোডাকশন। ‘ডাকহরকরা’র বাউল অঙ্গের গানগুলির জন্য সুধীন দাশগুপ্তই অগ্রগামী-র কাছে মান্না দে-র নামটি তোলেন। তাতে তাঁরা রাজিও হন। এই জুটির সফল পথচলার সেই শুরু। অন্য দিকে, উত্তমকুমারের লিপে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরই একচেটিয়া বসত। তার বদলে মান্না দে-র কণ্ঠ— সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। সুধীন সেই পরীক্ষাটিও করলেন। তাঁরই সুরে উত্তমের লিপে ‘গলি থেকে রাজপথ’ (১৯৫৯) ছবিতে মান্না দে গাইলেন ‘লাগ লাগ লাগ লাগ ভেলকির খেলা’।
‘শঙ্খবেলা’ (১৯৬৬) ছবিতে সেই সুধীনই আবার মান্না দে-কে নেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু নিমরাজি। ‘শঙ্খবেলা’র গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মিউজিক ডিরেক্টর সুধীন দাশগুপ্ত। সুধীনের সিঁথির বাড়িতে রাত তিনটে অবধি মিটিং। কে গাইবেন, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ আর ‘আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম’ গান দু’টি? প্রথম গানটিতে সুধীন চাইছেন হেমন্তের রোম্যান্টিক ছোঁয়া এবং দ্বিতীয়টিতে মান্না দে-কে। তাঁকে বোঝানো হল, একই নায়কের লিপে দুই গানে দুই কণ্ঠ বাংলায় চলবে না। তখন সুধীনের প্রস্তাব, দু’টি গানই গাইবেন কিশোরকুমার।
কিন্তু মিটিংয়ে উপস্থিত অন্যরা কিশোরের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলেন না। বরং দু’টি গানের ক্ষেত্রেই তাঁরা মান্না দে-র নাম প্রস্তাব করেন। উত্তমকুমার নিজেও মান্না দে-র ক্ষেত্রে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু ছবিমুক্তির পর সমস্ত দ্বিধা ধুয়ে যায় গান দু’টির জনপ্রিয়তার তোড়ে। ‘শঙ্খবেলা’র সেই অমর উত্তম-মান্না জুটিই এর পর শিখর ছোঁবে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭) ছবিতে, অনিল বাগচীর সুরে। আর মান্না দে-র সঙ্গে সুধীন দাশগুপ্তের নামটা প্রায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে যাবে। শুধু উত্তমই নন, তরুণ সৌমিত্রর লিপে মান্না দে-র কণ্ঠে ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবির (১৯৬৯) ‘জীবনে কী পাব না’, ‘হয়তো তোমারই জন্য’ বা ‘বসন্ত বিলাপ’-এর (১৯৭৩) ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ তো তাঁরই লেখা এবং সুর করা। বাঙালি এখনও এই গানগুলোর নস্ট্যালজিয়া থেকে বেরোতে পারল কই!