Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যুর দোরগোড়ায়

গত কয়েক বছরে একাধিক ক্যানসার রুগির শেষ কয়েক মাসের যন্ত্রণার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থেকেছেন তিনি। সেই সব মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ফিরে দেখলেন প্রীতিময় চক্রবর্তী কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ছিল কোমরের ব্যথা। সে তো কত জনেরই থাকে। কে জানত, তার মধ্যে এত বিষ জমা হয়েছে দিনে দিনে! আমেরিকার ঝকঝকে শহরে পর্ণা-পিনাকীদের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে সাজানো সংসার। এক মুহূর্তের ঝোড়ো হাওয়া সব এলোমেলো করে দিল।

চিত্রণ: শেখর রায়

চিত্রণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কোথা থেকে কী হয়ে গেল!

ছিল কোমরের ব্যথা। সে তো কত জনেরই থাকে।

কে জানত, তার মধ্যে এত বিষ জমা হয়েছে দিনে দিনে!

আমেরিকার ঝকঝকে শহরে পর্ণা-পিনাকীদের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে সাজানো সংসার। এক মুহূর্তের ঝোড়ো হাওয়া সব এলোমেলো করে দিল।

কলকাতায় ওঁদের যোগাযোগ বলতে পর্ণার বৃদ্ধা বিধবা মা। থাকেন দক্ষিণ কলকাতার নয়াবাদে। ফ্ল্যাটে। পরিচারিকা-নির্ভর জীবন। বয়স অনুপাতে রোগজ্বালা তেমন নেই বললেই চলে। শুধু ওই এক কোমরের ব্যথা। বহু দিনের পরিচিত হাড়ের ডাক্তার সময়-সময় ওষুধ-ইনজেকশন, ব্যায়াম দিয়ে তাঁকে সচল রাখেন। এর মধ্যে বার দুয়েক আমেরিকায় ঘুরে গেছেন। এমনিতে সুস্থই বলা চলে।

দিনকতক ধরে পর্ণা খেয়াল করেছিল, ব্যথা ছাড়া মা যেন সব কথা ভুলে গেছে। এক বার বিরক্ত হয়ে বলে ফেলল, ‘‘পাড়ার ডাক্তারকাকুকে দেখিয়ে নিলেই তো হয়। উনিই তো সামলে দিতে পারেন।’’

ফোন ছেড়ে পিনাকীকে বলল, ‘‘মায়ের না, ব্যথাটা বাতিক হয়ে গেছে।’’ ডাক্তারকাকু সব শুনে এক বার রক্তপরীক্ষা করাতে বললেন। হিমোগ্লোবিন মারাত্মক কম—৬! এর পরই সব ওলটপালট হয়ে গেল। ধরা পড়ল ‘বোন ম্যারো ক্যানসার’।

হাড়ের ডাক্তার, যাঁকে পর্ণারা এত দিন প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে রেখেছিল, তিনি বুঝতেই পারেননি, তাঁর রোগীর জীবনে কত বড় বিপদ হাজির হতে চলেছে।

বোন ম্যারো ক্যানসার। ছোট করে যার আরেক নাম বোন ক্যানসার। এ রোগের আরম্ভ হাড়ে নয়, রক্তে। রক্তে বোন ম্যারোর সেল বা কণা তৈরি হয়, আর সেটাই টিউমারের চেহারা নিয়ে গেড়ে বসে হাড়ে।

তাই হল বৃদ্ধার। অসুখ ধরা পড়ার পর ব্যথা যেন আরও বাড়ল। মেয়ে চলে এল দেশে। এই ডাক্তার সেই হাসপাতাল নিয়ে জড়িয়ে পড়ল পুরো পরিবার। শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।

ফল জেনেশুনেই যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। যতক্ষণ না রোগী নিজে থেকে সব চিকিৎসার উর্ধ্বে চলে যান। পরিবারের সকলে জানপ্রাণ দিয়ে লড়েন। লড়তে তো হয়ই। তার মধ্যেই কেউ কেউ খোঁজ নেন ইতিমধ্যে বিদেশে কোনও ওষুধ বেরলো কিনা বা অন্য কোনও সুরাহা, কেউ বা আবার কখনওসখনও হোমিওপ্যাথি দেখানোর জন্য সওয়াল করেন।

শোনা যাচ্ছে, বহু দিন ধরে আবিষ্কারকরা নাকি প্রভূত উন্নতি করে ফেলেছেন কর্কট-গবেষণায়।

সম্প্রতি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রর এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, গাঁজা গাছের পাতা নাকি কর্কট নিরাময়ে কাজে দিতে পারে। খবরটা রীতিমতো আশ্চর্যের। এক দিকে বলা হয়, ধূমপান-নিকোটিন ক্যানসারের অন্যতম কারণ, অথচ যে তামাক নিকোটিনের জনক, সেই তামাককেই কিনা বলা হচ্ছে ক্যানসারের সম্ভাব্য উপশম! এই বিভ্রান্তিগুলো কেমন যেন! এ সব ইচ্ছাকৃত নয়তো? আসলে দুঃখজনক ভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে ‘ক্যানসার’ এখন পুরোদস্তুর একটা ইন্ডাস্ট্রি। সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে তাজা ইন্ডাস্ট্রি। লক্ষ লক্ষ দুষ্টচক্র জড়িয়ে ক্যানসারকে ঘিরে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে।

মানবদেহে কোটি কোটি কোষ আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই কোষগুলো বৃদ্ধ হয়। মারাও যায়। নতুন কোষ তৈরি হয়। এই নিয়মের অন্যথা হলেই সর্বনাশ। যখন বৃদ্ধ, অকেজো কোষগুলো শরীরের মধ্যে বাঁচতে চায়, আর নতুন কোষের জন্মকে আটকে দেয়, সর্বনাশের শুরু তখনই। এই অপ্রয়োজনীয় কোষ ভাঙতে ভাঙতে তৈরি হয় টিউমার। এই টিউমারের থাকে প্রবল আক্রমণের শক্তি। শরীরের যে কোনও জায়গায় তা বাসা বাঁধতে পারে।

ক্যানসার কেন হয়, তা আজও জানা যায়নি। কিন্তু ক্যানসারে যে বহু ক্ষেত্রেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তা এখন তর্কের অতীত।


চিত্রণ: শেখর রায়

আর শুধু ‘মৃত্যু’-তেই এর শেষ নয়। পরিবারের অন্য মানুষগুলো এই কাতর সময়টার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কী যে ভয়ঙ্কর ‘ট্রমা’য় আক্রান্ত হন, তা আমার দেখা। ওই দুঃসময়ের ক্ষত বুকে নিয়ে তাঁরা জীবনটাকে এতটাই অনিশ্চিত ভাবতে শুরু করেন যে, মাঝে মাঝেই অদ্ভুত এক ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়। রজ্জুতেও সর্পভ্রম ঘটে যায়।

একটি পরিবারের কথা বলি।

মা-বাবা আর মেয়ের ছোট্ট সংসার। হঠাৎ কিশোরী কন্যার মা ব্রেস্ট ক্যানসারে মারা গেলেন।

মায়ের অভাব মেয়ের জীবনে পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু তা যে কতটা বিচিত্র ভাবে দেখা দিল এক দিন! তার পুরোটাই কিন্তু ওই ফেলে আসা দিনের ‘ট্রমা’র জের। শুনুন তা হলে।

মেয়ের বয়ঃসন্ধির প্রথম দিনে বাবা এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, পাড়ার ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনেন বাড়িতে।

ডাক্তারবাবু কিশোরীকে দেখেই বুঝতে পারেন ঘটনাটি কী? সন্ত্রস্ত বাবাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘‘ও ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ে আপনার বড় হচ্ছে।’’

দীর্ঘক্ষণ অযথা উদ্বিগ্নে থাকা বাবার এ বার যেন সম্বিৎ ফেরে। তাঁর এ ধরনের বিহ্বলতা দিনে দিনে মেয়েকে যেন বড় করে তোলে। যে বয়েসে তার সান্ত্বনা পাওয়ার কথা, অন্যের চোখের মণি হয়ে থাকার কথা, সেই বয়েসে সে তার বাবাকে ভরসা জোগাতে জোগাতে কোন ফাঁকে কৈশোরবেলাটা হারিয়ে ফেলল।

ক্যানসার রোগে আক্রান্ত রুগির পরিবারকে এক ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই তাড়া করে বেড়ায়— রোগ ধরা পড়ার আগে রুগির কী কী ‘সিম্পটম’ ছিল।

এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনও ক্যানসারের নির্দিষ্ট কোনও পূর্বলক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানই কিছু বলে উঠতে পারেনি। এটুকু বলা যায়, অখিদে, মারাত্মক ভাবে ওজন কমে যাওয়া... এই জাতীয় কিছু ক্ষেত্রে চুপচাপ বসে না থেকে, অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিত। ডাক্তার প্রয়োজন বুঝলে ‘ক্যানসার ডিটেকশন টেস্ট’ করিয়ে নেন।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। এক ক্যামেরাম্যান কাম পরিচালককে তাঁর চেম্বারে দেখে হকচকিয়ে উঠেছিলেন এক প্রখ্যাত ডাক্তার।

ওঁর রোগের শুরুটা কীরকম ছিল, শুনুন। অম্বল হত খুব। রোজ একটা-দুটো অ্যান্টাসিড ছিল বাঁধা। তার পর শুরু হল পেটে ব্যথা। তখন ব্যথা তাড়ানোর ওষুধ খেয়ে ভাল থাকার চেষ্টা। মানুষের এই এক অবৈজ্ঞানিক অভ্যাস। ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ‘সেল্ফ মেডিকেশন’। যার পরিণতি মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য।

এ ক্ষেত্রেও যেমন হল।

ক্রমে পেটে ব্যথা এত ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছল, ওষুধে আর কাজ দিল না। তখন ডাক্তার, পরীক্ষা ইত্যাদি। ধরা পড়ল যকৃতে কর্কট। স্টেজ ফোর!

অথচ কে বলতে পারে, গোড়ার থেকেই যদি চিকিৎসকের কাছে যেতেন ভদ্রলোক, হয়তো ফল অন্য রকম হলেও হতে পারত।

এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।

ভদ্রলোকের চিকিৎসা শুরু হল। কখনও ভাল, তো কখনও খারাপ। ডাক্তারকুল দিনরাত এক করে চেষ্টা চালাতে লাগলেন রোগীকে যতটা ভাল রাখা যায়। এ দিকে কাজে ভাটা পড়লেও তখনও বন্ধ হয়নি ক্যামেরা। ঠিক এমন সময় রোগীর ভ্রাতৃকুল ঠিক করলেন ভাল চিকিৎসার জন্য মুম্বই নিয়ে যেতে হবে। তাও যদি সঠিক পথে যাওয়া হত। হল না। কোনও এক দালালচক্রর পাল্লায় পড়ে নাজেহাল দশা হল রোগী সমেত গোটা পরিবারটির। রুগির স্ত্রী, নাবালক পুত্র অসহায়। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল রুগির। খাওয়া বন্ধ হল। লোককে চিনতে কষ্ট হতে থাকল।

আর এ ভাবেই অন্তিমকালটা এগিয়ে এল একদিন। মৃত্যু যতটা পীড়াদায়ক হতে পারে, তার চরম নিদর্শনগুলো রাখতে রাখতে পরিচালক-ক্যামেরাম্যানের চলমান জীবন-ছবি এক দিন স্থির হয়ে গেল চিরদিনের মতো। তার ছেলেটি তখনও স্কুল ফাইনাল দেয়নি।

আরেকটি অতি সাধারণ রোগ থেকে চরম পরিণতির ঘটনা বলি।

এখানে আবার রুগির ‘সেল্ফ মেডিকেশন’-এর পথে হাঁটেননি। বরং উল্টোটাই করেছিলেন। কিন্তু মাঝ পথে গণ্ডগোলটা পাকল কী ভাবে দেখুন।

ঘন ঘন পেটে ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তারবাবু সব শুনে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করালেন। ধরা পড়ল গলস্টোন। অপারেশন দরকার।

রুগি অপারেশনের কথা শুনে ডাক্তারবাবুকে বললেন, ‘‘আচ্ছা, অপারেশন কি করতেই হবে? ওষুধ খেয়ে যদি...।’’

ডাক্তারবাবু খানিক ভেবে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আশা করছি বেরিয়ে যাবে।’’

ওষুধ খেয়ে ‘স্টোন’ সত্যি সত্যিই বেরিয়ে গেল। পরীক্ষা করে তেমনই ধরা পড়ল। ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত।

কিন্তু মাসখানেক গড়াতেই আবার পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। তখন আবার ডাক্তার। এ বার ডাক্তারের কেমন যেন সন্দেহ হল। তাই অঙ্কোলজিস্ট। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। দেখা গেল, ক্যানসার আক্রমণ করেছে গলব্লাডারকে। এই পরিণতিও স্বভাবতই সুখের হয়নি।

অঙ্কোলজিস্টের সন্দেহ, ‘স্টোন’ বেরিয়ে গেলেও গলব্লাডারে ঘষা খেতে খেতে সে তত দিনে যে ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে, তার থেকে কর্কট বাসা বাঁধতে পারল। অপারেশন হয়ে গেলে এমনটা হত না। এ ভাবে অপারেশনে ভয় পেয়ে ‘কর্কট’ ডেকে আনাটাও বিরল নয়। যেখানে অপারেশন দরকার সেখানে অপারেশন করাতেই হবে, এর অন্যথা করা ঠিক নয়।

আমার এক বন্ধুর কথা।

ও বিশ্বাস করত কিনা জানি না, তবে খুব জোর দিয়ে বিশ্বাস করাতে চাইত, জীবনের অত্যন্ত দুর্গমতার মধ্যে দিয়ে যাওয়াটাও নাকি একটা স্তর। ও নাকি ঠিক কাটিয়ে উঠবে সেই স্তরটিকে। কর্কট তত ক্ষণে তাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল। দক্ষ ডাক্তার আর রুগির জিগীষু মনের জোরে ঘুড়িটা শুধু কাটব-কাটব বলেও কাটছিল না। বরং হাওয়া লেগে খানিকটা উড়ছিলই বলা চলে।

শেষ দিন অবধি হিমোগ্লোবিনের তারতম্য লক্ষ করা যায়নি। ওজন কমাটাও যেন একটু লাগাম টেনেছিল। কম সময়ের জন্য হলেও অফিসে যাতায়াত চলছিল। একটু-আধটু আড্ডাও। রোগভোগ ভুলে থাকার জন্য সময় করে নিয়ে খুব সিনেমাও দেখছিল। খিধেটা অবশ্য কমছিল দিন-দিন। জিভের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। যেমন এই রোগে সবারই হয়। পাকস্থলীই যদি বেঁকে বসে খাবারের স্বাদ বা ইচ্ছে কোথা থেকে আসবে! বিস্বাদ আর খাবারে অনীহা নিয়েই সে চলে ফিরে বেড়াচ্ছিল। আইসক্রিমকে মূল খাদ্য করে চলছিল জীবন।

এর পরই অদ্ভুত এক কাণ্ড!

প্রথম পর্যায়ের কেমোর ডোজটা ভালভাবে মিটে যাওয়ার পরে, হঠাৎ বন্ধু-আত্মীয়দের কেউ কেউ মত দিলেন, আর কেমো নয়।

যে-কেমো ওকে সুস্থ করে রাখল, সচল রাখল, সেই কেমোই কোনও এক অজানা কারণে ‘ডাইনি’ বলে মনে হল সবার! ডাক্তারের মত কী, কেউ জানতেও চাইল না। শুরু হল হোমিওপ্যাথি।

দ্রুত ছবিটা নির্মম ভাবে পাল্টে গেল। নিত্যদিন অফিস করা মানুষটা, এক দিন সহকর্মীকে কথা দিল, ‘‘সন্ধ্যায় আসছি।’’

তা আর হল না। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল সে। তার পর থেকে নিজের কষ্টটাও ঠিক করে বুঝিয়ে উঠতে পারল না।

পারল না তো, পারলই না।

গত কয়েক দিন আগে নিমতলার শ্মশানঘাটে অনেক রুগির সমাগম হল। সে দিন মারা গিয়েছিলেন তাঁদের অতি প্রিয় চিকিৎসক।

ডাক্তারবাবুর রোগীর বিস্তার শহর ছাড়িয়ে সেই সুন্দরবন অবধি। সুন্দরবনে খবর পৌঁছেছিল কিনা জানা নেই, পৌঁছলেও হয়তো’বা দূরত্বের কারণেই ওখান থেকে আর কেউ এসে উঠতে পারেননি। তাঁকে শেষ শয্যায় দেখতে শ্মশান চত্বরে যাঁরা ভেঙে পড়ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ডাক্তারবাবুর কলকাতা রুগিরা।

তাঁকে কর্কটে ধরেছিল। বছর ঘোরেনি। তার আগেই সব শেষ!

সবাইকে যিনি সুস্থ থাকার ‘মন্ত্র’ দিতেন, সেই মানুষটা নিজের কাছে নিজেই হেরে বসলেন।

উপদ্রবটা শুরু হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। হাতের লেখা বা সই অহোরাত্র পাল্টে যাচ্ছিল। একটু আধটু অসংলগ্ন উচ্চারণ যেন কানে আসছিল কারও কারও। মন যা ভাবছে, মাথা যেন তৎক্ষণাৎ তা ধরতে পারছে না। সন্দেহ হল স্ত্রীর। বন্ধু, সহকর্মী ডাক্তারদেরও।

ব্রেন স্ক্যান হল। তার পরেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটা দুঃসময় হয়ে ছুটে এল। কর্কট মাথার মধ্যিখানে।

অপারেশন হল। এই ভাল-এই খারাপের সেই অভিশপ্ত খেলাটা শুরু হয়ে গেল। অপারেশনের জের সামলে বাইরে বেরনো শুরু হল ডাক্তারের। কিন্তু তাঁর বাড়ি না-ফেরা অবধি সবারই একটা চাপা অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা। তার মধ্যেই শরীর, রোগকে উপেক্ষা করে শনিবার-শনিবার সুন্দরবন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে, ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরাটা জারি রইল।

কিন্তু শেষের অনেক আগেই যেন হুইসিল বাজিয়ে খেলাটা থামিয়ে দিলেন কর্কট-আক্রান্ত ডাক্তারবাবু।

বাড়িতে নব্বই বছরের বাবা। এখনও সবল। তিনিও বুঝে উঠতে পারছেন না কী হতে চলেছে। বা হয়তো পারছেন বুঝতে, জানান দিচ্ছেন না, ভেতরে-ভেতরে তাঁর কী চলছে!

স্ত্রী নার্সের চেয়েও বেশি পটুতায় স্বামীর সেবা করে গেলেন। হাজার কষ্ট-কান্না চেপে তাঁকে যে থাকতে হবে হাসিমুখেই। ছেলেরা, বন্ধুরা যাতে ভেঙে না পড়ে। এক দিন মুখ ফসকে এক পারিবারিক বন্ধুকে শুধু বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ও যদি পুজো অবধিও থাকে...।’’ সে-বন্ধু বেলভিউ নার্সিংহোমের লবিতে সে-কথা আর এগোতে দেননি।

পুজো কেন, তার বহু আগেই শেষ খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল দমবন্ধ করা হাহাকার হয়ে!

নিজেকে নিংড়ে দিয়েও হেরে যাওয়া ডাক্তার-পত্নী তাঁর স্বামীর শবদেহ চুল্লিতে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Cancer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE