বাবলি পালের সংযত ছবিতে দেখি মেহনতি মানুষের কথা। কাগজের স্বল্প পরিসরে, তুলির নরম টানে যা ধরা পড়ে, তা শ্রম নয়— শ্রমিকের জীবনের প্রতি তাঁর সকরুণ মমত্ব। কখনও স্মৃতি, কখনও বসতি,কখনও পণ্য হয়ে ওঠে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু। সেখানে মানুষের অবয়ব না থাকলেও কখনও ত্রিপলের তৈরি অস্থায়ী আস্তানায়, কখনও বা অবহেলায় পড়ে থাকা নিত্যব্যবহারের টিনের কৌটোয় মানুষের উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
অন্য দিকে, সত্যরঞ্জন দাসের ছবিতে স্থান পেয়েছে শ্রমিকের পরিযান। তপ্ত, রুক্ষ মরুভূমিতে পায়ে হেঁটে চলা অগণিত মানুষের ভিড় মনে করিয়ে দেয় সেই দুরূহ গ্রীষ্মের স্মৃতি। অপরিকল্পিত লকডাউনের জেরে বিপর্যস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ইতিহাস।
এক আশ্চর্য শূন্যতা ঘিরে রয়েছে প্রদর্শনীর সমস্ত ছবিকে। নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রাকে একভাবে পাওয়া যায় অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে। অতিমারির সময়ে গৃহবন্দি জীবনের নির্জনতা ও অনিশ্চয়তা তাঁর ছবির প্রধান বিষয়। সেখানে ক্ষুদ্রকায় একাকী মানুষের শরীরের অনুপাতে তার ঘর, বাগান, বারান্দা, এমনকি আসবাবপত্র, জানালায় এসে পড়া রোদ বা ছায়া—সবই বিরাটাকার রূপ নিয়েছে।
অদৃষ্ট বা মানুষের পরিহাস অশনি সংকেত দেখায় প্রভাকর সিংহের রক্তাভ ছবিতে। ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা এই ছবিতে ভেসে থাকে পশু ও মানুষের ম্লান মুখ। সেখানে প্রকট সাদা রঙের হিসেবি ব্যবহারে ফুটে ওঠে মানবিক ও পাশবিক হাসি—শান্তি ও হিংসার এক আশ্চর্য সমাগম।
মানুষের পৃথিবীর অনতিদূরে রয়েছে যে না-মানুষের জগৎ, তার প্রতিফলন দেখা যায় সন্দীপ রায়, সাদিকুল ইসলাম ও শান্তনু রায়ের ছবিতে। সাদিকুল বারবার এঁকেছেন রাখাল বালক ও গরুর পালের ছবি। কিন্তু তাঁর রাখালের হাতে বাঁশি নেই, আছে দড়ি। অন্য রঙের পাশাপাশি লাল ও নীল রঙের ব্যবহার তাঁর ছবিকে ব্যঞ্জনার স্তরে পৌঁছে দিয়েছে।
সন্দীপ রায়ের পুরুলিয়া, মুম্বই বা বেনারসের গঙ্গার ঘাট মূলত জলরঙে আঁকা জলের ছবি। মেঘ ও জল তাঁর ছবির প্রধান চরিত্র। তাঁর ছবির মাপ নিসর্গ-ব্যাপ্তির দ্যোতনা আনে, যা বস্তুত ভৌগোলিক এবং দৃশ্যত রোমান্টিক।
এই মোলায়েম সৌন্দর্যবোধের বিপ্রতীপে রয়েছেন শান্তনু রায়। তাঁর ছবির ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি নিসর্গের পেলব নান্দনিকতার সীমা ছাড়িয়ে, প্রকৃতির রুদ্ররূপের সন্ধানী। রেখার দৃঢ়তা, রঙের ঘনত্ব ও গতি তাঁর ছবির সামগ্রিক চর্চার সঙ্গে একাত্ম। সমগ্র প্রদর্শনীতে ধরা পড়েছে বিভিন্নতা ও সহাবস্থান। অতিমারির প্রভাব নানা ভাবে ফিরে এসেছে শিল্পীদের অভিব্যক্তিতে। নির্বাচকের চয়নে মাধ্যমের শুদ্ধতার চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ব্যবহার-বৈচিত্র, ভাষার চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ভাবনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা।