E-Paper

নাটকটি বিচারের আলোর কথাই বলে

আদর্শবান সম্মানিত অবসারপ্রাপ্ত বিচারক জ্যোতিষ দাশগুপ্তর সঙ্গে তাঁর মেজ পুত্র নীতিহীন অথচ প্রখরবুদ্ধিসম্পন্ন উকিল ঋত্বিক দাশগুপ্তর মধ্যকার সংঘাতই এই নাটকের দ্বান্দ্বিক কেন্দ্রবিন্দু। জ্যোতিষ আদর্শ থেকে নড়বেন না, ঋত্বিক আদর্শের ধার ধারে না।

সৌভিক গুহসরকার

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩৭
নাটকের একটি দৃশ্য।

নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।

গত ৫ জানুয়ারি বাঘাযতীন আলাপের উদ্যোগে ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বাংলা নাট্যোৎসব ২০২৫’-এর অন্তর্গত সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর ‘ধর্মাবতার’ নাটকটি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে পরিবেশিত হল। একটি বিদেশি চলচ্চিত্রের ছায়ায় এই নাটকটি রচনা করেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। নাটকটি সুলিখিত এবং তার অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি এসে আঘাত করে দর্শককে। এই নাটকটি নির্দেশনা করেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য। ‘ধর্মাবতার’ নাটকটি মানুষের ভিতরের গভীরতম নীতিবোধের দরজায় ধাক্কা দেয়। আইন আগুনের মতো। সে আলোও দেয়, আবার সে ঘরও পোড়ায়। তাকে ব্যবহার করে সুবিচার আসে, আবার তাকেই ব্যবহার করে অপরাধীরা মুক্তিও পায়। ঠিক এই জায়গায় চলে আসে মানুষ ও তার মানবিকতা। সে কার পক্ষে? আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে একজন বিচারক সুপ্ত রয়েছে, যে সবটা জানে এবং বোঝে। সে-ই প্রকৃত ধর্মাবতার। তাকে জাগ্ৰত করলে মানুষ ন্যায়ের দিকে যায়। তাকে নিদ্রিত রাখলে মানুষ অন্যায়কে সমর্থন করে। এখন মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে সে কী চায়— জাগরণ না নিদ্রা?

আদর্শবান সম্মানিত অবসারপ্রাপ্ত বিচারক জ্যোতিষ দাশগুপ্তর সঙ্গে তাঁর মেজ পুত্র নীতিহীন অথচ প্রখরবুদ্ধিসম্পন্ন উকিল ঋত্বিক দাশগুপ্তর মধ্যকার সংঘাতই এই নাটকের দ্বান্দ্বিক কেন্দ্রবিন্দু। জ্যোতিষ আদর্শ থেকে নড়বেন না, ঋত্বিক আদর্শের ধার ধারে না। সে অপরাধীদের হয়ে ওকালতি করে এবং বহু অর্থের বিনিময়ে তাদের মামলায় জিতিয়ে দেয়। জ্যোতিষ এটা সহ্য করতে পারে না। সে আইনের আলোর পক্ষে, ঋত্বিক আইনের অন্ধকার খুঁড়ে তোলে। এক সময়ে একজন পুরনো আসামীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার অভিযোগে জ্যোতিষ দাশগুপ্তর বিরুদ্ধে খুনের মামলা করে মৃতের স্ত্রী। এ দিকে এক কঠিন মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে জ্যোতিষ নানা জিনিস বিস্মৃত হতে থাকে। সে আদৌ খুন করতে চেয়েছিল কি না, তা-ও তার মনে পড়ে না। এ অবস্থায় ঋত্বিক তার পিতার হয়ে এই মামলা লড়তে চায়, কিন্তু জ্যোতিষ তাকে নিজের উকিল হিসেবে নিযুক্ত করতে অস্বীকার করে। পিতা ও পুত্রের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এর পর কী ঘটে, সে সব নিয়েই এই নাটকটি।

নাটকের একটি দৃশ্য।

নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।

‘ধর্মাবতার’ নাটকে অবসারপ্রাপ্ত বিচারকের ভূমিকায় মেঘনাদ ভট্টাচার্যর অভিনয় মুগ্ধ করে। তিনি দর্শকের ভিতর তীব্র আবেগ সঞ্চার করার পদ্ধতিটি জানেন। তাঁর সংলাপের উচ্চারণের মাতন এসে বুকের ভিতর নাড়া দিয়ে যায়। ঋত্বিকের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ কুণ্ডু সংযত ও আবেগঘন। ঋত্বিকের স্ত্রী লীনার চরিত্রটি রূপসা ভট্টাচার্য ফুটিয়ে তুলেছেন দৃপ্ত ও সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে। জ্যোতিষের রুগ্‌ণা স্ত্রীর ভূমিকায় রুনা মুখোপাধ্যায়, বড় ছেলে গৈরিকের চরিত্রে ধূর্জটি দে ও ছোট ছেলে দৌবারিকের ভূমিকায় গৌতম সেন উল্লেখযোগ্য। বাড়ির কাজের মেয়ে ময়নার ভূমিকায় ইন্দ্রজিতা চক্রবর্তী প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত। বাকিদের কাজ নাটকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যথাযথ।

এই নাটকে সৌমিক-পিয়ালীর মঞ্চসজ্জা নাট্যবস্তুকে তীব্র করে তোলে। একটা বিচারালয়ের খাঁচার মধ্যেই যেন পুরো নাটকটি ঘটে চলেছে। পাশাপাশি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আলো, পঞ্চানন মান্নার রূপসজ্জা ও মুরারি রায়চৌধুরীর সঙ্গীত নাটকের আবেগকে প্রাণদান করেছে। ‘ধর্মাবতার’ নাটকটি নির্দেশনা করেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটকটিকে তিনি এক মেদহীন গতিশীলতা প্রদান করেছেন। নাট্যবস্তুটি যে আঘাত করবে, তা তিনি জানেন। কিন্তু এই আঘাতের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তা তিনি নিশ্চিত করেছেন। ধর্মাবতার নাটকটি এ সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই নাটক উস্কে দেয় অনেক চিন্তা, যা মানবসমাজকে প্রতিনিয়ত পীড়ন করে চলেছে। এই নাটকটি শেষ পর্যন্ত বিচারের আলোর কথাই বলে। যে-আলো ব্যক্তিগত লোভ ও বস্তুতান্ত্রিক জগতের কঠিন অন্ধকার ফাটিয়ে শুভ বুদ্ধি রূপে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের চেতনায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cultural Program theatre Academy of Fine Arts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy