E-Paper

তুলির আঁচড়ে জীবনের স্বপ্ন

বৃহত্তর পরিসরে শিল্পীর পর্যবেক্ষণে ছিল বিশেষ একটি ফর্ম। পরাবাস্তবতার ছায়ায় সেগুলির অন্তর্বিপ্লব ঘটে। যেমন দড়ি, বস্তা, মুখোশ, বিভিন্ন মুখ ইত্যাদির রূপান্তর।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৭
প্রতিচ্ছবি: শিল্পী সুমন্ত দে-র একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

প্রতিচ্ছবি: শিল্পী সুমন্ত দে-র একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

সম্প্রতি অ্যাকাডেমির শিল্পাঙ্গন এক আবেগঘন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল। শিল্পের ইতিহাসে এমন কিছু নাম থেকে যায়, যারা সময়ের আগেই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। সুমন্ত দে এমনই একটি বিরল নাম। শিশুকাল থেকেই ছবির প্রতি প্রবল টান ছিল। বাবা, কাকার শিল্পচর্চার পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। ‘অ,আ, ক,খ’ শেখার আগেই শুরু হয়েছিল ছবি আঁকা। পড়াশোনাতেও তুখড়। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। সুমন্ত বলতেন, ‘যদি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে সুযোগ না পাই, তাহলে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নেব।’ অনেক কথা উঠে আসছিল মা সাধনা দে-র স্মৃতিচারণে। ২০২১ সালের অতিমারির শিকার সুমন্ত। বয়স তখন মাত্র ২৯।

অ্যাকাডেমির সেন্ট্রাল গ্যালারি জুড়ে সাজানো হয়েছিল শিল্পীর বিমূর্ত অনুভূতির প্রকাশ। জড় থেকে সজীব হয়ে ওঠার প্রসেস। একাধিক মুখের ছবি— কখনও ছাগলের মুখ, কখনও মানুষের। সবই চলমান প্রতীকের মুখচ্ছবি। অন্তর্গত অস্থিরতার মিশেলে শক্তিশালী এক ভার্শন। শিল্পীর আগের প্রদর্শনীতে দেখা গিয়েছিল বাস্তবসম্মত চিত্রকর্ম, যাতে তাঁর আর্ট কলেজ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার প্রকাশ। এই প্রদর্শনীর কাজে তারই রূপান্তর দেখা গেল।

বৃহত্তর পরিসরে শিল্পীর পর্যবেক্ষণে ছিল বিশেষ একটি ফর্ম। পরাবাস্তবতার ছায়ায় সেগুলির অন্তর্বিপ্লব ঘটে। যেমন দড়ি, বস্তা, মুখোশ, বিভিন্ন মুখ ইত্যাদির রূপান্তর। প্রথমেই একটি চমকপ্রদ কাজ চোখে পড়ে। ‘বস্তা থেকে বেরিয়ে আসা একটি জিভ’— দমিয়ে রাখা প্রতিবাদের চিৎকার বা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের চিহ্ন। হলুদ-বাদামি আলোছায়ার ফর্ম, তার থেকে উঠে আসা লালচে জিভ। এক ধরনের ভৌতিক নাটকীয়তা সৃষ্টি করে। এই কাজটির বহুমাত্রিক ধারণায় দর্শক অস্বস্তিতে পড়েন, কিন্ত চোখ সরানো যায় না।

সমতুল্য আবেদন নিয়ে প্রদর্শনীর আর একটি চিত্র, ‘ছাগলের মুখ’। বলি বা উৎসর্গের প্রতীক। অসহায় চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। শিল্পী এখানে নিছক প্রতিকৃতি আঁকতে চাননি। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এক রহস্যকে ধরার প্রয়াস। সেপিয়া ও সামান্য লালের ব্যবহারে অস্বস্তির সৌন্দর্য তৈরি হয়। তবে শুধুই যন্ত্রণা তুলে ধরা নয়, থাকে মুক্তিরও আভাস। সুমন্ত দে-র কাজে মানুষ ও পশুর মুখ এক অবিচ্ছেদ্য যাত্রায় মিলেমিশে যায়। কখনও স্পষ্ট, কখনও ঝাপসা। একটি স্থির কাঠামো থেকে চলমান শক্তির রূপ।

বহুমাত্রিক প্রতীকে ছবির নির্বাক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিটি ছবিতে জড় থেকে প্রাণের উত্তরণের পথ। দর্শককে সহজ উত্তর না দিয়ে, প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে জানতেন এই শিল্পী। জলরং বা কালি দিয়ে শুধু নয়, কাগজের নিজস্ব শরীর দিয়েও তৈরি করেছেন নিজস্ব শিল্পভাষা। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় কিছু কাগজের রূপান্তর। যেমন ছিঁড়ে যাওয়া প্রান্ত, কাগজের ভাঁজ। আবার রঙে ভিজে জীবন্ত হয়ে ওঠা। কোথাও আবছা দাগের সঙ্গে ইঙ্কের মিশ্রণ আকৃতি নিয়েছে মুখের। কুঁচকে যাওয়া কাগজের ভাঁজ, দাগ, রং... সবই সময় ও স্মৃতির ছাপবিশেষ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, শিল্পীর স্পেসের বোধ। ফ্রেমের ফাঁকা জায়গা যেন অদৃশ্য চরিত্র হিসেবে ঘোরাফেরা করে। দর্শকের চোখ প্রান্তসীমা ধরে ঘুরতে থাকে। কখনও শূন্যতা, কখনও বিস্ফোরণের আভাসে। শিল্পী সেখানে প্রশ্ন করার অবকাশ রেখেছেন। আবার নরম টোনে জলরং যেখানে ভেসে চলে, সেখানেই ইঙ্কের ছাপ সঙ্কেত দেয়— সৌন্দর্য একা বাঁচে না। পাশে অন্ধকারও বেঁচে থাকে।

শিল্পী সুমন্ত দে-র মূল ও প্রিয় মাধ্যম ছিল জলরং। জলরঙের জন্য তিনি জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। কম বয়সেই একাধিক পুরস্কার, দেশবিদেশ জুড়ে প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ, ইলাস্ট্রেশনের কাজ। প্রথম দিকে ছিল অ্যাকাডেমিক স্ট্রাকচার করার প্রবণতা। বলা ভাল, ছাত্রসুলভ কাজ। পরবর্তীতে সেই কাজ অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে যেতে থাকে। বৃহত্তর জায়গা থেকে একটি বিশেষ বস্তুর উপরে আলোকপাত করেন। জার্মান এক্সপ্রেশনিজ়মের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

এক্সপেরিমেন্টাল প্রকাশে পাঁচজন সহপাঠী মিলে একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল তাঁদের— ‘ইনফিনিটি’। ২০১৭ থেকে শুরু হয় নিজেদের প্রদর্শনী। সেই সময়ে সুমন্তর কাজ ছিল মূলত রেখাপ্রধান। ক্রমান্বয়ে নিত্যনতুন উদ্ভাবনে মাতেন তিনি। গবেষণার জন্য লন্ডনে সুযোগও পান। কিন্তু এরই মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায় জীবন। রয়ে যায় অগণিত কাজ,খসড়ার পাহাড়।

অল্প বয়সেই নিজের ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন সুমন্ত দে। তাঁর প্রতিটি কাজই অসমাপ্ত সম্ভাবনার প্রতীক। পূর্ণ বিকাশের আগেই চলে যাওয়া শিল্পজগতে অপরিমেয় ক্ষতি। তবে সত্যিকারের প্রতিভা সব সময়েই কালোত্তীর্ণ।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Academy of Fine Arts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy