জি ডি বিড়লা সভাগারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ‘লোপা-সাহানা দু’জনায়’ শীর্ষক এক সুন্দর সঙ্গীতানুষ্ঠান। আয়োজক সংস্থা সংস্কৃতি সাগর। সে দিনের সন্ধ্যার মূল দুই শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র এবং সাহানা বাজপেয়ীর সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতে পারফর্ম করলেন গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও।
লোপামুদ্রার সাঙ্গীতিক জীবন দীর্ঘ তিরিশ বছর পার করেছে। তা সত্ত্বেও মঞ্চে ওঁর সক্রিয় উপস্থিতিতে এখনও প্রবল ভাবে ধরা পড়ে তারুণ্যের তেজ। পাশাপাশি সাহানার উদাত্ত কণ্ঠস্বর এবং প্রাণশক্তি এক মূহূর্তের জন্যও ছন্দপতন ঘটতে দেয়নি। দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশনায় যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয়, তা এই দুই শিল্পীর গানে এবং অভিব্যক্তিতে বেশ লক্ষণীয় ছিল এ দিনের অনুষ্ঠানে।
সঙ্গীত-চয়নের ক্ষেত্রে উভয় শিল্পীই নিজেদের গান, লোকসঙ্গীত কিংবা রবীন্দ্রনাথের গানের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। গোড়ার দিকে সুরফাঁকতালে আবদ্ধ ‘প্রচণ্ড গর্জনে’ বা কীর্তনাঙ্গের ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’— এই দু’টি বহুশ্রুত গানের নতুন ধরনের সঙ্গীতায়োজন শ্রোতাকে সেই সন্ধ্যার চমকগুলির জন্য প্রস্তুত করে দেয়। ‘মহারাজ একি সাজে’র সঙ্গীতায়োজনে সাধারণত যে বেহাগ রাগের ছাপ পাওয়া যায়, তা সাহানার এ দিনের উপস্থাপনায় ছিল না, সম্ভবত প্রথাগত পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য। রবীন্দ্রনাথের ‘খাঁচার পাখি ছিল’ গানটিতে দ্বৈত কণ্ঠের ব্যবহার, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানটির ইন্টারলিউডে ‘আকাপেলা’-র ব্যবহার, ‘আমার রাত পোহালো’-র অবয়ব জুড়ে পিয়ানো সোনাটার অলঙ্কার এবং ভায়োলিনের মর্মস্পর্শী সুর পুরো পরিবেশনার মধ্যে একটা নাটকীয়তা এনে দিয়েছিল, যা এখনকার মঞ্চশিল্পীদের অনুষ্ঠানের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য।
গানের পর্যায়ক্রমের নেপথ্যে কোনও বিশেষ ভাবনা ছিল বলে মনে হল না। ঠিক তেমনই লোকগানের তালিকা নিয়েও শিল্পীরা বিশেষ ঝুঁকি নেননি। প্রত্যেকটি গান বহুশ্রুত, জনপ্রিয়। তবে গানের সঙ্গীতায়োজনের ক্ষেত্রে শিল্পীরা যথাসম্ভব সাহসিকতা দেখিয়েছেন। শাহ আব্দুল করিমের সৃষ্টি ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’ গানে ফাঙ্ক রক-এর ছাপ যেমন পাওয়া গেল, তেমনই লালনের ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ গানে ড্রামস, ঢোল এবং ভায়োলিনের যৌথ সঙ্গতে ছিল নিয়ম ভাঙার স্বতঃস্ফূর্ততা। হাসন রাজার সৃষ্টি ‘সোনা বন্দে’ গানটির ইন্টারলিউডে গিটারে জ্যাজ়ের ব্যবহার আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছিল। এই ভাবেই রাধারমণ দত্তের ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’, লালনের ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, লোপামুদ্রার কণ্ঠে সাহানার বিখ্যাত গান ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি’, আবার সাহানার কণ্ঠে লোপামুদ্রার জনপ্রিয় গান ‘ছাতা ধর গো দেওরা’— এই সব পরিবেশনা দিয়েই দুই শিল্পী নিজেদের ডালি সাজিয়ে নিয়েছিলেন। ‘ছাতা ধর গো দেওরা’ গানটিতে সাহানা অবশ্য কোনও এক অজ্ঞাত কারণে একটি স্তবক কম গাইলেন, সম্ভবত সময়ের অভাবেই। অবশ্য এই স্বাধীনতা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও নিয়ে থাকেন অনেক শিল্পী।
নিজের গানের মধ্যে লোপামুদ্রা গাইলেন ‘ঠিক যেখানে দিনের শুরু’, ‘আমার মতে তোর মতো কেউ নেই’ এবং ‘যাও পাখি’। সাহানা গাইলেন তাঁর নিজের রচনা ‘একটা ছেলে মনের আঙিনাতে’। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় ড্রামসে গৌরব ‘গাবু’ চট্টোপাধ্যায়ের কথা, যিনি সাত জনের ব্যান্ডকে তালে-ছন্দে ধরে রেখেছিলেন পারদর্শিতায়। সামগ্রিক ভাবে উপভোগ্য এক সন্ধ্যা।
অনুষ্ঠান
শিল্পীবৃন্দ।
- রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন— এই তিনজনের গানের ভাবকে পাথেয় করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ‘ফোর্থ ডায়মেনশন’। নূপুরছন্দা ঘোষের পরিচালনায় অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল অমোল পালেকরের কণ্ঠে কান্তকবির গানের কাব্যরূপায়ণ। সঙ্গে ছিল নূপুরছন্দা এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের গান। নূপুরছন্দার একক কণ্ঠে দ্বিজেন্দ্র-পুত্র দিলীপকুমার রায়ের ‘ভারতরাত্রি প্রভাতিল যাত্রী’ গানটি অনুষ্ঠানে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। সমাপ্তি সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন অমিত রায়। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন দীপঙ্কর আচার্য, তন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুরজিৎ চক্রবর্তী, স্বরূপ মুখোপাধ্যায়, অনুপ চক্রবর্তী, অলক রায়চৌধুরী।
- সম্প্রতি রবীন্দ্রসদনে কলাভৃৎ উপস্থাপন করল একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ‘বিরাজ সত্যসুন্দর’। প্রায় ৩০০ কলাকুশলী অংশগ্রহণ করেন অনুষ্ঠানে। মঞ্চ-সজ্জা করা হয়েছিল বাংলার পটচিত্র দিয়ে। রণপা নৃত্যের মাধ্যমে সূচিত হয় অনুষ্ঠান। ৫০ জন শিল্পী সমবেত ভাবে পরিবেশন করেন আবৃত্তি ‘কামাল পাশা’। গান ও নাচের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয় সত্যজিৎ রায় এবং সলিল চৌধুরীকে। উপস্থিত ছিলেন সলিল-কন্যা অন্তরা চৌধুরী। সলিলস্মরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ইন্দ্রনীল সেন, ইন্দ্রাণী সেন, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, সৈকত মিত্র, রূপঙ্কর বাগচী, আরাত্রিকা সিংহ, দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায় ও কলাভৃৎ শিল্পীগোষ্ঠী। দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কলাভৃৎ-এর নিবেদন ছিল ‘মাতৃ মন্দির পুণ্য অঙ্গন’। অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির উদয়ের ভাবনা মাথায় রেখে অনুষ্ঠিত হয় ‘আনন্দ ভৈরবী’ (মহিষাসুরমর্দিনী অবলম্বনে)। পরিবেশ সচেতনতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৫০ জন শিশুশিল্পী নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করল ‘সৃষ্টি’। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অনিন্দ্য মিত্র, দেবাশিস কুমার, ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাতী মুখোপাধ্যায়, প্রণতি ঠাকুর। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন অলক রায়চৌধুরী, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসুদেব নন্দী, রাহুল দেব মণ্ডল, তড়িৎ সরকার, বুদ্ধদেব গঙ্গোপাধ্যায়। সমগ্র অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় অনুশীলা বসু।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)