সম্প্রতি আইসিসিআর-এর অবনীন্দ্রনাথ আর্ট গ্যালারিতে ‘সুবর্ণ ২০২৫ উৎসব’ উদ্যাপিত হল। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের আগে সলতে পাকানোর মতো উৎসবের আগে একটি শিক্ষাশিবিরের আয়োজন করে সুবর্ণরেখা, সুবর্ণমুখ ও সুবর্ণপাদ— এই তিন ভাগে উৎসবকে বিভক্ত করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন উৎসবের অন্যতম আয়োজক ড. হিমাংশু শ্রীবাস্তব। ছবি— রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— ‘চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে’— সঙ্গীত ও নৃত্যের মাঝে তা মূর্ত হয়ে ওঠে, এ যেন এক শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে অন্য শিল্প মাধ্যমের দৃষ্টি বিনিময়। এ ভাবেই হিমাংশু ‘আলারিপু’র উপস্থাপনা করেছেন। নাট্যচিত্র, ধ্রুব ইনস্টিটিউট অব ডান্স ও স্পর্শ স্টুডিয়ো ফর পারফর্মিং আর্টসের সৌজন্যে দু’দিনের এই উৎসবের আয়োজন। অর্ঘ্যদীপ্ত কর, রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও হিমাংশু শ্রীবাস্তবের ছবির প্রদর্শনী বিশেষ আকর্ষণ ছিল। চিত্রশিল্পী অর্ঘ্যদীপ্তের বিষয় তান্ত্রিক শক্তি; আর রিয়ার বিষয় ওড়িশার পটচিত্র ও তিব্বতি তাঙ্কা। ঢুকতেই দেওয়ালে ছোট ছোট ফ্রেমে বাঁধানো মাতৃমূর্তির ছবি— কখনও দুর্গা করুণাময়ী, কখনও বা ভয়ঙ্করী। ছবির শেষে আর একটি দেওয়ালে হিমাংশুর আঁকা দশভুজা কাত্যায়নীর একটি বিশাল চিত্রের পরে কালো একটি পর্দা টাঙানো রয়েছে সারা দেওয়াল জুড়ে— যা নৃত্যের পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। পর্দার শেষ প্রান্তে লম্বা একটি পথের ছবির উপর অসংখ্য পদচিহ্ন... যেন অনন্তের দিকে হেঁটে চলেছে। মঞ্চসজ্জাটি সহজ সুন্দর, দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সার্থক সুবর্ণরেখা।
ওই শিক্ষা শিবিরেরই ড. দূর্বা রায়চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের গানের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির পাঠ সঙ্গীত সহযোগে ব্যাখ্যা করেন। সন্ধ্যা ছ’টার পর ওই মঞ্চেই নৃত্য প্রদর্শনী। ২৩ অগস্ট ‘সুবর্ণপাদ’ এই পর্যায়ে নৃত্য পরিবেশন করেন প্রথমে সায়নী চক্রবর্তী ও পরে হিমাংশু শ্রীবাস্তব। মীরাবাইয়ের একটি ভজন ‘আজ শুনি ম্যায়’ আধারিত একটি বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা নিবেদন করেন সায়নী চক্রবর্তী—‘ঘনশ্যাম’। এটি ভরতনাট্যমের ‘বর্ণম’ আঙ্গিকে সুপরিকল্পিত। সায়নীর দ্বিতীয় নিবেদন জয়দেবের অষ্টপদী আধারিত বিপ্রলব্ধা নায়িকা রাধার সখীদের সঙ্গে কথোপকথন। রাগমালিকায় রচিত সঙ্গীতের সঙ্গে রাধার নৃত্যের পরিকল্পনা করেন সায়নী— চমৎকার উপস্থাপনা। সায়নী রমা বৈদ্যনাথনের শিষ্যা। তাঁর নৃত্য নিবেদন দর্শকদের মনোরঞ্জন করে।
পরের শিল্পী হিমাংশু শ্রীবাস্তব। একলব্যের গুরুকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নিবেদন নিয়ে একটি বিষয়ভিত্তিক নৃত্য নিবেদন করেন যে, একলব্যের মাথায় দানব ও শয়তান বিরাজিত। এই একলব্যকে দর্শক গ্রহণ করবেন না বর্জন, তা দর্শকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন হিমাংশু। হিমাংশুর নৃত্যগুরু কমলিনী দত্ত ও পরে সরোজা বৈদ্যনাথন, রমা বৈদ্যনাথন। তাঁর ভরতনাট্যম আঙ্গিকে নৃত্য উপস্থাপনা দর্শকের ভাল লাগে।
দ্বিতীয় দিনের নৃত্যশিল্পী ছিলেন যথাক্রমে দক্ষিণা বৈদ্যনাথন ও অনিতা মল্লিক। দক্ষিণা বৈদ্যনাথনের নিবেদন ত্যাগরাজের প্রচলিত সঙ্গীতের সঙ্গে যোগভৈরবম। সরোজা বৈদ্যনাথন ও রমা বৈদ্যনাথনের পরম্পরার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনায় নতুনত্বের স্বাক্ষর তিনি রেখে গিয়েছেন, যখন তিনি ভৈরবম থেকে ভৈরব ও ভৈরব থেকে বম-এ উত্তরণ ঘটালেন। দ্বিতীয় নিবেদন মাতৃত্বের উদ্যাপন— অপূর্ব সুন্দর নৃত্যভাবনা। শরীরের ভিতরে শিশুকে লালন করা আর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে পালন করার যে এক মধুর যাত্রা— তাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর নৃত্যভঙ্গিমায়। এর বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনা দর্শকদের আপ্লুত করে।
শেষ নিবেদন তিরুপতি ভেঙ্কটেশ ও পদ্মাবতীর প্রেম কাহিনি। ভক্ত পূজারী মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে চলে যাওয়ার পর ঈশ্বর সেখানে আবির্ভূত হয়ে যেন লীলা করছেন। সুন্দর উপস্থাপনা। উৎসবের শেষ নৃত্যশিল্পী ছিলেন অনিতা মল্লিক। কেরালা কলামণ্ডলমের নৃত্যধারায় শিক্ষিত অনিতা কলকাতায় অতিপরিচিত নাম। তাঁর নৃত্য শিক্ষায়তন ‘সারস্বত’ বহু ভরতনাট্যম শিল্পী তৈরি করেছে। ষাটোত্তীর্ণ এই শিল্পী তাঁর ভাবাভিনয় দিয়ে দর্শকদের মোহিত করেছেন। দেবকী ও যশোদা— কৃষ্ণের দুই মাতার কথোপকথন, যা একজন দেখেছেন, আর একজন দেখেননি। সেই লীলা বর্ণনার মধ্য দিয়ে দর্শকেরা কৃষ্ণের লীলা প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর উপস্থাপনায় ভরতনাট্যমের আঙ্গিকে রচিত এই বিষয়ভিত্তিক নৃত্য পরিবেশনা মুগ্ধ করে। তাঁর নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেন— কণ্ঠে আকাশ মুখোপাধ্যায়, মৃদঙ্গমে শঙ্করনারায়ণ স্বামী, নটুভঙ্গমে হিমাংশু শ্রীবাস্তব।
অনুষ্ঠান
- রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্গীতের ধারায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সঙ্গীত ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপরে নৃত্য সহযোগে মূল গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে রবিচেতন পরিবেশন করল ‘বিশ্ব সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠান। এ ছাড়াও ছিল শ্যামা নৃত্যনাট্যের আদি রূপ ‘পরিশোধ’। রবীন্দ্রনাথের এমনই বহু অচর্চিত উপস্থাপনা সাধারণ দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে রবিচেতন সর্বদাই সচেষ্ট। সঙ্গীত এবং নৃত্যের এই জমজমাট অনুষ্ঠান দু’টিতে অংশগ্রহণ করলেন রবিচেতন পরিবারের দেশ বিদেশের সদস্যরা। অনুষ্ঠান দু’টি পরিচালনা করলেন সাগরময় ভট্টাচার্য। সঞ্চালনায় ছিলেন সুদীপ্তা মুখোপাধ্যায়।
- সম্প্রতি স্বভূমির রঙ্গমঞ্চে হয়ে গেল বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘মিলাপ’। দ্য হাউস অব রেয়ার-এর রেয়ারফোরের উদ্যোগে হয় এই অনুষ্ঠান। সেখানে বিশিষ্ট ভরতনাট্যম শিল্পী রুক্মিণী বিজয়কুমার, ভায়োলিন বাদক অম্বি সুব্রহ্মণ্যম একসঙ্গে পারফর্ম করেন। এর পর ছিল সঙ্গীতশিল্পী তেজের পারফরম্যান্স। অনুষ্ঠানে একটি আলোচনা সভায় অংশ নেন অভিনেত্রী শেফালি শাহ এবং রেয়ারফোরের অধিকর্তাঅক্ষিকা পোদ্দার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)