E-Paper

চিত্রাঙ্গদা: অরূপ ভিতরকণিকা

‘চিত্রাঙ্গদা’রই কীতর্নাঙ্গ অনুজ্ঞাপদ— ‘মায়া ছেড়ে দিক পথ/প্রেমের আসুক জয়রথ/রূপের অতীত রূপ/দেখে যেন প্রেমিকের চোখ’।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৫
মঞ্চে পরিবেশনায় শিল্পীরা।

মঞ্চে পরিবেশনায় শিল্পীরা। নিজস্ব চিত্র।

মহাকাব্যে কার্যত উপেক্ষিতা চিত্রাঙ্গদা রবীন্দ্ররচনায় নারী-স্বাধিকারের দিশা-মশাল, লিঙ্গবৈষম্যের উপরে বৌদ্ধিক কষাঘাত এবং তথাকথিত রূপভাবনার বিপ্রতীপে রূপাতীত অরূপসন্ধান। রবীন্দ্রনাথ আগে লেখেন কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। অনেক পরে একই ভাববয়ানে তৈরি তাঁর প্রথম নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। মহাভারতের এই কাহিনি রবীন্দ্রনাথে নিছক প্রেমের উপাখ্যান নয়। বরং কবির সারা জীবনের শব্দ-সুর-রঙের মতোই প্রেম, সম্মান, অধিকার, আত্মশক্তি আর প্রকৃতি-অনূদিত স্বাধীনতার মঙ্গলকাব্য। যা-কিছু বানিয়ে তোলা, তার পরাজয় সুনিশ্চিত রবীন্দ্রনাথের আখ্যানে। তাই অর্জুনের আত্মতুষ্ট ব্রহ্মচর্যের শ্লাঘা নিরর্থক প্রতিপন্ন হয়। তাই ব্যর্থ হয়ে যায় চিত্রাঙ্গদার বহু আশায় প্রাণপণে প্রার্থনা করা মদনমায়াও। রবীন্দ্রনাথের অর্জুন সত্য-পুরুষকারের সন্ধানী হয়ে উঠতে আগ্রহী হয়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা ছিন্নভিন্ন করে দেয় আরোপিত রূপভাবনার সৌন্দর্যবিলাসকে। চিত্রাঙ্গদা— অরূপ ভিতরকণিকা।

‘চিত্রাঙ্গদা’রই কীতর্নাঙ্গ অনুজ্ঞাপদ— ‘মায়া ছেড়ে দিক পথ/প্রেমের আসুক জয়রথ/রূপের অতীত রূপ/দেখে যেন প্রেমিকের চোখ’। সম্প্রতি কলকাতার রবীন্দ্রসদনে ভবানীপুর বৈকালী অ্যাসোশিয়েশন উপস্থাপন করল ‘চিত্রাঙ্গদা’, যার শীর্ষনাম ‘রূপের অতীত রূপ’। একই শীর্ষনামে আগেও সার্থক প্রযোজনা দেখেছে কলকাতা। ২০০৮ সালে সুচিত্রা মিত্র, সুবীর মিত্র, কলাবতী দেবী, অনিতা পালেদের আয়োজন স্মরণস্নিগ্ধ হয়ে আছে অনেকের কাছে। কাব্যনাট্য আর নৃত্যনাট্যের গ্রন্থনা ছিল সে আয়োজনেও। সে পরিবেশনায় ‘ওরে ঝড় নেমে আয়’ গানের ঠিক আগে, সুচিত্রা মিত্রের পাঠ আর কলাবতী দেবীর নৃত্যের মধ্যে মঞ্চে আলো খসে পড়ে চুরমার হয়ে যাওয়া এবং মুহূর্তমাত্র থমকে গিয়েই পরক্ষণে সাবলীল গতিতে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া, কলাবতী দেবীর বিভঙ্গ-সাম্পানের ভেসে চলা— ‘মিথ’ হয়ে রয়েছে। এ বার প্রমিতা মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনা আর পূর্বিতা মুখোপাধ্যায়ের নৃত্য পরিচালনায় একই শীর্ষনামের আয়োজনও স্মরণীয় হয়ে থাকল উপস্থাপনার সুষমায়।

বৈকালীর উপস্থাপনাতেও কাব্যনাট্য আর নৃত্যনাট্যের বয়ান হাত ধরাধরি করে চলেছে। নাট্য এবং সিনেমাটিক উপস্থাপনার নানা উপচারে সম্পাদিত এই পরিবেশনায় ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ পর্ব যেমন রয়েছে, তেমনই তরবারি হাতে শিহরন তৈরি করা নাচের পেশকারিও রয়েছে। ছিল গানের আগে-পরে রাগসঙ্গীতের অভিক্ষেপ ব্যবহার। স্থান-কাল-পট পরিবর্তনের আগে এ প্রযোজনা প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার রেখে সময় নেয়নি। বরং ভরিয়ে তুলেছে সুর-তালের আলিম্পনে। সে সময়কালে কিছু ক্ষেত্রে নাচের আলাদা খণ্ড-বয়ান তৈরি করে সেতু নির্মিত হয়েছে আগে-পরের অংশের সঙ্গে।

উপস্থাপনায় মণিপুরী নৃত্যশৈলী বড় অংশ জুড়ে। তবে, আরও একাধিক নৃত্য-ঘরানার সংমিশ্রণ ছিল। ‘গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে’ গানের সঙ্গে তরবারি-নৃত্যে যেমন মণিপুরের মার্শাল নৃত্যশৈলী ‘থাং তা’ ব্যবহৃত হয়েছে প্রীতি পটেলের কাছে নৃত্যদীক্ষা নেওয়া কে সুশীল সিংহ এবং এস রবার্ট মেইতের উপস্থাপনায়, তেমনই ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা’য় আধুনিক বা ‘কনটেম্পরারি’ নৃত্যশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। ‘তাই আমি দিনু বর’ গানের পরে রূপান্তরের সময়সেতু তৈরি করা হয়েছে কত্থকের তুমুল ব্যবহারে।

চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় নাচে পূর্বিতা মুখোপাধ্যায় মুগ্ধ করেছেন। চরিত্রের চিন্তা-বিবর্তন তাঁর নৃত্যাভিনয়ে আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে। অর্জুনের ভূমিকায় নৃত্যে রিন্টু দাস অনবদ্য। তাঁর শিল্পী-ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত প্রযোজনায়। চমৎকার মদন চরিত্রের নৃত্যশিল্পী সৌরভ রায়ও। মঞ্চে তাঁর আগমনকে আর্বিভাব করে তুলেছেন তিনি। প্রধান তিন চরিত্র ছাড়াও নৃত্যে বাকি যে কুশীলবেরা, প্রত্যেকে মুগ্ধতায় বাধ্য করেছেন দর্শককে।

সঙ্গীতাংশে চিত্রাঙ্গদার গান গেয়েছেন দূর্বা সিংহ রায়চৌধুরী, প্রিয়াঙ্গী লাহিড়ী এবং প্রকৃতি মুখোপাধ্যায়। তিন জনই তুলনাহীন। গানের ভাব এবং গান-বয়ানের অভিব্যক্তির রসায়ন বিবেচনা করে তাঁদের মধ্যে গান ভাগ করে দেওয়ার ভাবনাটিও দারুণ ভাবে সফল এবং অভিনন্দনযোগ্য। অর্জুনের গানে প্রত্যুষ মুখোপাধ্যায় এবং মদনের গানে অর্জুন রায় মন জয় করে নেন। সমবেত গানের শিল্পীরাও শ্রোতাকে সম্মোহন করেছেন। প্রযোজনায় আলাদা মাত্রা যোগ করেছে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে প্রমিতা মল্লিকের পাঠ। অহেতুক বাচিক-মেদ সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত, বরং উচ্চারণে ব্যক্তিত্বের নাট্যোপযোগী প্রকাশ। অর্জুন আর মদনের অংশে ভাস্কর সরকার এবং প্রিয়দর্শী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠও চমৎকার।

সুব্রত বাবু মুখোপাধ্যায়ের যন্ত্রানুষঙ্গ পরিকল্পনা-পরিচালনা, উত্তীয় জানার আলো আলাদা ভাবে সাধুবাদের দাবিদার। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের প্রাক্‌কথন সুন্দর। এ দিন ‘চিত্রাঙ্গদা’র আগে কয়েকটি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশিত হয় বৈকালীর শিল্পীদের কণ্ঠে। শতাধিক শিল্পীর সেই পরিবেশনাও মুগ্ধ করেছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখার চোখের বদলে দেখার মনকে জয়তিলক পরিয়েছে। গোটা কাব্যনাট্য আর নৃত্যনাট্য জুড়ে চোখ আর মন নিজেরাই অনপনেয় চরিত্র হয়ে রয়েছে। ‘কোন আলো লাগল চোখে’— তার খোঁজই যেহেতু কালজয়ী এই রবীন্দ্রসৃজনের মাধুকরী-পথ, এ-উপস্থাপনায় সে-পথের অন্বেষণে সার্থক পথিক হয়ে উঠেছে ভবানীপুর বৈকালী।

অনুষ্ঠান

মঞ্চে পরিবেশনায় শিল্পী।

মঞ্চে পরিবেশনায় শিল্পী। নিজস্ব চিত্র।

  • সম্প্রতি জ্ঞান মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ‘হে একা সখা’ শিরোনামে একটি ব্যতিক্রমী আবৃত্তির অনুষ্ঠান। শিল্পী স্বপ্না দে-র একক আবৃত্তি দর্শক শ্রোতাদের প্রায় দু’ঘণ্টা সময় ধরে আবিষ্ট করে রেখেছিল। স্বপ্না দু’টি পর্বে সাজিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠান। প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়ে একটি অভিসারের যাত্রাপথ নির্মাণ করেছেন শিল্পী। সেই যাত্রা শেষ হয় বুদ্ধদেব বসুর লেখা ‘বাইশে শ্রাবণ’ দিয়ে। কবিতার নিজস্ব শক্তি যে অনেক গভীর, সে বিষয়টির যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন স্বপ্না, তাঁর পাঠের গভীর উচ্চারণ ও অভিব্যক্তি দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে একেবারে ব্যতিক্রমী এক উপস্থাপনা ছিল ‘বেহুলা-একটি কথকতা’ শিরোনামে। বিষয়টি স্বপ্নার মস্তিষ্কপ্রসূত, রূপদান করেছিলেন অধ্যাপক কৌশিক রায়চৌধুরী, জাগরণ পালা লিখে। জাগরণ পালার নির্বাচিত অংশ ‘বেহুলা-একটি কথকতা’। সমসময়ের এবং যুগযুগান্তের জলছবি যেন এই পরিবেশনা। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন শুভেন্দু মাইতি, মঞ্চ সৌমিক, আলো সৌমেন, আবহ প্রয়োগ অনুপম, শব্দ নিলয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটির ভাবনা ও পরিকল্পনায় ছিলেন স্বপ্না দে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindra Sadan Chitrangada

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy