E-Paper

শাস্ত্রীয় নৃত্যের সুন্দর উপস্থাপনা

মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনের সময়ে বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীতের ব্যবহারও সুন্দর। এই রকম তথ্যসমৃদ্ধ ওয়ার্কশপের আরও প্রয়োজন রয়েছে।

বিপাশা মাইতি

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫২
নৃত্য পরিবেশনে শিল্পী।

নৃত্য পরিবেশনে শিল্পী।

সম্প্রতি উত্তম মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মালশ্রীর প্রযোজনায় ‘অষ্টম প্রেরণা উৎসব ২০২৫’। উৎসবের সূচনায় পিয়াল ভট্টাচার্য চমৎকার ভাবে বিশ্লেষণ করলেন নাট্যশাস্ত্রের পরিভাষা এবং তার প্রয়োগবিধি। পিয়াল ভট্টাচার্য নাট্যশাস্ত্রের গবেষণার মাধ্যমে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন। নাট্যশাস্ত্রের ছোট ছোট যে পরিভাষা আছে, সেগুলি সুচারু ভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব সংস্থা চিদাকাশ কলালয়-এর ছাত্রছাত্রীরা। সায়ক মিত্র সুন্দর ভঙ্গিমার দ্বারা বোঝালেন নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত স্থানের মাহাত্ম্য।

নাট্যশাস্ত্র বলছে— মনের ভাবকে প্রথম বোঝানো যায় ‘স্থান’ অর্থাৎ ‘স্থিতি’ দিয়ে। এর পর আসে ‘গতি’, যার নতুন নামকরণ করেন ভরত— ‘চারি’। মাছের আঁশের মতো চলন দেখানোর সময়ে শিল্পীর হাতের মুদ্রাপ্রয়োগ প্রশংসনীয়। পর পর ‘কৈশিকী’ ভাব, ‘করণ’ অর্থাৎ ‘উপাদান’ যার দ্বারা আমরা জগৎকে ভোগ করি, এই ভাবগুলি পিয়াল চমৎকার ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন। প্রথম করন— ‘তাল’, ‘পুষ্প’, ‘পুট’ অসাধারণ নৃত্যভঙ্গিমা এবং হস্তমুদ্রার দ্বারা মঞ্চে প্রদর্শন করলেন পিঙ্কি মণ্ডল এবং শ্রীতমা চৌধুরী। মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনের সময়ে বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীতের ব্যবহারও সুন্দর। এই রকম তথ্যসমৃদ্ধ ওয়ার্কশপের আরও প্রয়োজন রয়েছে।

নাট্যশাস্ত্র ওয়ার্কশপের পরেই একে একে মঞ্চস্থ হতে থাকে ওড়িশি, কত্থক, কুচিপুড়ি এবং মণিপুরী নৃত্যানুষ্ঠান। ওড়িশি নৃত্যশিল্পীদ্বয় অর্পিতা ভেঙ্কটেশ এবং বন্দিতা ভেঙ্কটেশের প্রথম নিবেদন ঝিঞ্ঝট রাগ এবং দশ মাত্রার মাঠা তালে নিবদ্ধ ‘লয়বিন্যাস’ পল্লবী। ওড়িশি নৃত্যধারায় ‘পল্লবী’ নৃত্যভিত্তিক উপস্থাপনা, যেখানে শিল্পী বিভিন্ন ভঙ্গি ও পদচালনার দ্বারা নির্ধারিত তালের প্রয়োগ করেন। পরবর্তী নিবেদন অভিনয়ভিত্তিক ‘বাল্মীকি কথা’। বন্দিতা ভেঙ্কটেশের আরও তালিমের প্রয়োজন। নিখুঁত ভঙ্গিমা ওড়িশি নৃত্যের একটি প্রধান অঙ্গ, শিল্পীদ্বয়ের মধ্যে যার কিছুটা অভাব মনে হয়েছে৷

পরবর্তী শিল্পী সৌরভ রায় মঞ্চে প্রবেশ করলেন কত্থক নৃত্যের উপস্থাপনা নিয়ে। প্রথম পরিবেশনা ১২ মাত্রা চৌতালে নিবদ্ধ ‘বিশ্বনাথষ্টকম’, যেখানে ভগবান শিবের স্তুতি করা হয়েছে। এই নৃত্যাংশে নিখুঁত ভাবে ঠাট, লয়কারি এবং বিভিন্ন বোলের ব্যবহার করেছেন শিল্পী। দ্বিতীয় নিবেদন অভিনয়ভিত্তিক রামায়ণের কাহিনি ‘সাদ্রা’। পণ্ডিত বিন্দাদীন মহারাজের কম্পোজিশন, মিয়াঁ মল্লার রাগ এবং ঝাঁপতালে নিবদ্ধ ছিল এই বিশেষ নৃত্যটি।

পরবর্তী এবং শেষ নিবেদন দ্রুত লয়ে তালভিত্তিক বোল পরহান্ত নৃত্য, যেখানে সৌরভের অসাধারণ পায়ের কাজ দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। গুরু মালবিকা মিত্রের বোল পরহান্তের সঙ্গে শিল্পীর নৃত্য পরিবেশনা দেখে মনে হয়েছে, তাঁর পায়ের ঘুঙুর কথা বলছে বোল পরহান্তের সঙ্গে। অভিনয়েও যে তিনি যথেষ্ট সিদ্ধ, তার প্রমাণ পাই দ্বিতীয় নিবেদন ‘সাদ্রা’-তে। এই পর্বে যখন তিনি রাবণের চরিত্র ফুটিয়ে তুলছেন, তখন তাঁর চোখেমুখে কখনও ফুটে উঠেছে বীররসের ভাব, আবার কখনও বীভৎস রসের ভাব। এ ছাড়াও কী অপূর্ব ফুটিয়ে তুলেছেন মন্দোদরী চরিত্রের রাবণকে হারানোর হাহাকার। সব মিলিয়ে সৌরভের নিবেদনই এই সন্ধ্যার শ্রেষ্ঠ নিবেদন। তাঁকে কণ্ঠসঙ্গীত, সরোদ, সেতার এবং সারেঙ্গিতে সঙ্গত করেন যথাক্রমে সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, সুনন্দ মুখোপাধ্যায়, সন্দীপ নিয়োগী ও রমেশ মিশ্র। তবলায় সুবীর ঠাকুর, পণ্ডিত দীননাথ মিশ্র এবং বোল পরহান্ত ও পরিচালনায় গুরু ড. মালবিকা মিত্র।

প্রভু গণেশের স্তুতি ‘প্রাণাভাবারাম সিদ্ধি বিনায়কম’ রাগ আরভি এবং আদি তালে নিবদ্ধ কুচিপুড়ি নৃত্য পরিবেশন করেন ববি চক্রবর্তী। তাঁর দ্বিতীয় নিবেদন ‘শিবতরঙ্গম’। এই নৃত্যে কুচিপুড়ির প্রচলিত প্রথানুসারে পিতলের থালার উপরে দাঁড়িয়ে শিল্পীর পরিবেশনা আনন্দ প্রদান করে।

ওই সন্ধ্যার শেষ নিবেদন গুরু প্রীতি পটেলের পরিচালনায় মণিপুরী নৃত্য। প্রথম নিবেদন ‘ইঙ্গা কুমুদাম্বী’, যার অর্থ বৃষ্টি। গুরু প্রীতি পটেল এবং তাঁর সহশিল্পীরা বর্ষার যে ভাবটি ফোটাতে চেয়েছেন, তা হল— প্রতি বর্ষায় মাতৃরূপী মেঘ আকাশ জুড়ে বিচরণ করে এবং প্রত্যক্ষ করে মানব ও অন্যান্য প্রাণিকুলকে; প্রত্যক্ষ করে গোপিনী সহযোগে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার রাসলীলা। ‘মাতৃরূপী মেঘ’ চরিত্রটি লাস্যময়ী মণিপুরী নৃত্য দ্বারা সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন গুরু প্রীতি পটেল। লাহেরোবার কোমল ভঙ্গি তাঁর নৃত্যে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছে। শুভ্র সাদা পোশাকটিও ভারী সুন্দর, স্নিগ্ধ। রাসলীলা পর্বে উজ্জ্বল মণিপুরী পোশাক পরিহিতা গোপিনী সহযোগে শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার নৃত্য প্রদর্শন সুন্দর। এই মণিপুরী নৃত্যপর্বে যে নৃত্যটি সকল দর্শকের মন জয় করে সেটি হল, কে. রতন সিংহের পুং (মণিপুরী খোল) নিয়ে নৃত্য প্রদর্শন। পুং কাঁধে যে ভাবে তিনি নৃত্য প্রদর্শন করেন, তা চমৎকার।

তবে কোনও নৃত্য পরিবেশনায় ‘আলো’ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ওই দিন আলোর ব্যবহার আরও উজ্জ্বল হওয়া দরকার ছিল।

অনুষ্ঠান

অনুষ্ঠানের মুহূর্ত।

অনুষ্ঠানের মুহূর্ত।

  • সম্প্রতি কলা মন্দিরে বেঙ্গল ওয়েব সলিউশন, সেরাম গ্রুপের সহযোগিতায় নিবেদিত হল ইমন চক্রবর্তীর একক। প্রথম ভাগে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিতীয় ভাগে বাংলার লোকসঙ্গীত। সঙ্গীত আয়োজন করেন নীলাঞ্জন ঘোষ। অনুষ্ঠানে সেরাম থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন ফেডারেশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নিবেদিতা আচার্য। এ দিন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের হাতে প্রাণদায়ী ওষুধ তুলে দেন ইমন।
  • কলকাতা ইয়ুথ অঁসম্বলে অমিতাভ ঘোষের তত্ত্বাবধানে মিউজ়িকাল কনসার্ট ‘দশে দশ’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জি ডি বিড়লা সভাঘরে। মুখ‍্য বাদ্যযন্ত্র ছিল ভায়োলিন। প্রায় ১৪০জন শিল্পী একই মঞ্চে ভায়োলিনে সুরধ্বনি তুললেন। অনুষ্ঠানে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক‍্যাল, ইন্ডিয়ান ক্লাসিক‍্যাল ও আধুনিক সঙ্গীতের মেলবন্ধনে এক অনন‍্য সুরসমাহার প্রতিফলিত হল। আর ছিল কিছু হিন্দি গানের পরিবেশনা। অনুষ্ঠানের শেষাংশে সঙ্গীত ও বাদ‍্যযন্ত্রের সুর নতুন সিম্ফনি তৈরি করল ইন্ডিয়ান ক্লাসিক‍্যাল মিউজ়িকের সঙ্গে। রাগ বেহাগ, কিরওয়ানি, চারুকেশী, মেঘমল্লারের সুর এক অন‍ন‍্য আবহ সৃষ্টি করল। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতীদের সম্মান প্রদান করা হল অনুষ্ঠানে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Uttam Manch

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy