E-Paper

তমসাবিন্দু থেকে আলোকবন্দরে যাত্রা

এ নাটকের সময়কাল নব্বইয়ের দশক। স্থান ইছামতীর ধারের একটি গ্ৰাম। এইখানে থাকে হিন্দু পিতা ও মুসলমান মায়ের ছেলে রহিম।

সৌভিক গুহসরকার

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৩৮
নাটকের দৃশ্য।

নাটকের দৃশ্য।

গত ২৬ অগস্ট রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হল কলকাতা রমরমা নাট্যগোষ্ঠীর ‘সওয়ার’। নাটকটি লিখেছেন এবং নির্দেশনা করেছেন কন্যকা। দরিদ্র মানুষকে ধর্মের নামে উস্কে দিয়ে, বিভেদ সৃষ্টি করে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার যে দীর্ঘ পরম্পরা এ দেশে চলে এসেছে, এ নাটক সেই পরম্পরার খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু নাটকটি এই অন্ধকারকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়নি। এই অপরিমেয় নিরন্তর তমসার ভিতরেও যে রহিমের মতো সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের চেতনা জ্বলে উঠতে পারে এবং সেই আলোয় যে তমসাচ্ছন্ন দিগ্ভ্রান্ত মানুষের মনও আলোকিত হয়, সেই কথাই বলেছে। তমসাবিন্দু থেকে যাত্রা করে আলোকবন্দরে নিয়ে চলা এই নাটক উত্তরণের রং ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ে। এই কেন্দ্রীয় ভাবনাকে নাটকের আঙ্গিকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন কন্যকা। দৃশ্য রচনা ও সংলাপের মধ্যে সন্ত কবীরের দোঁহাকে চমৎকার ভাবে বুনেছেন তিনি। ‘সওয়ার’-এ কবীরের দোঁহার ব্যবহার নাটকটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

এ নাটকের সময়কাল নব্বইয়ের দশক। স্থান ইছামতীর ধারের একটি গ্ৰাম। এইখানে থাকে হিন্দু পিতা ও মুসলমান মায়ের ছেলে রহিম। তার বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন। রহিম নানা রকমের কাজ করে আর কবীরের দোঁহা, যা ছোটবেলায় তার মা তাকে শোনাত— সেই সব আওড়ায়। কিন্তু সে এ কথা জানেও না যে তা কবীর নামক এক সন্তের লেখা। কবীরের দোঁহার বচনগুলো সে সত্য বলে মানে এবং তাই অশিক্ষিত হলেও সে উদার। সে ধর্মের ভেদাভেদ মানে না। সে মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করে। রহিমের একটি ভাঙাচোরা ট্যাক্সি রয়েছে, যেটি তার বাবা চালাত এবং যেটি অকেজো। এই ট্যাক্সিটিকে সে ভালবাসে। পিতার স্মৃতি বলেই হয়তো। ‘সওয়ার’ আবর্তিত হয় রহিম ও তার এই অকেজো ট্যাক্সি নিয়ে।

প্রথমেই যেটি চোখে পড়ে, সেটি হল মঞ্চসজ্জা। মঞ্চের উপরেই আর একটি উঁচু মঞ্চে ট্যাক্সির উপস্থিতি নাটকটিতে অন্য ধরনের স্বাদ এনেছে। অম্বরীশ দাস খুবই ভাল কাজ করেছেন। এর পরেই বলতে হয় সাধন পাড়ুইয়ের আলোর কথা। ইছামতীর ঘাটের দৃশ্যগুলোয় আলোর চমৎকার ব্যবহার করেছেন তিনি। পাশাপাশি ভাল লেগেছে তিমির-সৌরভের আবহ।

এ বার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। রহিমের চরিত্রটি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যম ভট্টাচার্য। নাটক চলাকালীন তিনি যে ক্রমশ চরিত্রটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠছিলেন, তা অনুভব করা যায়। পাশাপাশি বলতেই হয় রহিমের বোবা বন্ধু শিবুর কথা। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌস্তভ মুখোপাধ্যায়। চমৎকার কাজ করেছেন তিনি। ভূতো বহুরূপীর চরিত্রে সপ্তক হালদারও উল্লেখযোগ্য। রহিম, শিবু আর ভূতোর মধ্যকার বন্ধুত্বের রসায়ন ভাল লেগেছে। বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছেন সুখীরামের চরিত্রে শিলাদিত্য চট্টোপাধ্যায়। বেশ কিছু দৃশ্যে তাঁর কাজ মুগ্ধ করে। এ ছাড়া শামসুর আলির চরিত্রে দীপ বসু দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। এই চরিত্রের বেশ কিছু সূক্ষ্ম জায়গা তিনি নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রধানের চরিত্রে শুভব্রত ঘোষ, হরিহরের ভূমিকায় প্রণীত বিশ্বাস, বিশুর চরিত্রে দেব সরকার যথাযথ কাজ করেছেন। ভাল লেগেছে মতিলালের চরিত্রে আয়ুষ ঠাকুরের অভিনয়। রাধামতী বাউরির চরিত্রে তীব্রতা এনেছেন কন্যকা। রাধামতীর চরিত্রের নানা পরত তিনি সাবলীল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

নাটকটি মঞ্চে দৃঢ় ভাবে উপস্থাপিত করেছেন নির্দেশক কন্যকা। যেহেতু এটি তাঁর নিজের লেখা, তাই নির্দেশক হিসেবে এই নাটকটিকে তাঁর মনের মতো করেই রূপ দিতে পেরেছেন। শেষ দৃশ্যটি অসাধারণ ভাবে নির্মাণ করেছেন তিনি। সেখানে নোয়ার বা মনুর নৌকার পৌরাণিক অনুষঙ্গ চলে আসে। কিন্তু এই নাটকটি হয়তো আর একটু সম্পাদিত হতে পারে। তাছাড়া রাধামতী বাউরি রহিমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অত হিন্দি কেন বলল, সেটা ঠিক বোঝা গেল না। ওই জায়গাটি বাংলায় বললেও নাটকীয় রস খুব একটা ক্ষুণ্ণ হত বলে মনে হয় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindra Sadan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy