Advertisement
E-Paper

‘পোশাকে নক্ষত্র জুড়ে বিষাদে হাসাহাসি—’

সঞ্জয়ের ছবির বিমূর্ততাও ওই রঙেরই সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ভিন্ন রেখার এক বিশৃঙ্খল সংগঠন, যা অভিঘাতময় এক শৃঙ্খলিত বন্ধনও।

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৫
বর্ণিল: প্রদর্শিত হল সঞ্জয় ঘোষের চিত্রকর্ম

বর্ণিল: প্রদর্শিত হল সঞ্জয় ঘোষের চিত্রকর্ম

অষ্টাদশ শতকের বিশ্বখ্যাত জাপানি ইউকিয়ো শিল্পী-ছাপচিত্রকর কাতসুশিকা হোকুসাই আশি-উত্তীর্ণ বয়সে বলেছিলেন, “আরও বেশি বছর বাঁচলে যা আঁকব, তখন রঙের যে ফোঁটাটি ফেলে লাইন টানব, তখন সেগুলোই কথা বলবে, প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।” স্বশিক্ষিত চিত্রকর, লেখক, কবি, চিকিৎসক সঞ্জয় ঘোষের ‘পেন্টিংস ইন দ্য ডার্কার টাইম’-এর মিশ্রমাধ্যম, জল-রং, চারকোলের কাজ দেখে হোকুসাইকে মনে পড়ল। যেন কাগজে সঞ্জয় একটা বর্ণিল ফোঁটা ফেলে, রেখা টেনে, তুলির চালনায় ছবিকে কথা বলিয়েছেন। কিন্তু কেন অন্ধকার সময়ের ছবি? শিল্পীর কাছে যা নির্জন মরুভূমি, গভীর জলাশয়, শূন্য সময়ের অনন্ত কুয়োয় যেন সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়েছিল। সত্যিই কি? তা হলে তাঁর ছবি দেখতে দেখতেও তো আর এক কবির অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে থাকার কথা মনে পড়ে। তাঁর ছড়ানো প্রান্তর বা অন্তরীক্ষে ভাসমান বস্তুপুঞ্জকেও তো মনে হয় ‘দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত!’ তাঁর ছবিতেই অনুভূত হয় সেই অমোঘ লাইন— ‘কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে...।’

সঞ্জয়ের ছবিতে বারবার ফিরে আসে বর্ণময়, প্রগাঢ়, শুষ্ক, স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ, অসম্পূর্ণ, ভাঙাচোরা, স্থূল ও চিকণ ব্রাশিংয়ের বিভিন্ন লাইন। ওই যে ফিগারেশন বা একক রূপের প্রকাশ, তাদের শৃঙ্খলিত সঙ্ঘবদ্ধতাই অনেক অব্যক্ত ভাষায় পটে রূপ পাচ্ছে। এই সঙ্কেতময় আবহের আড়ালে রয়ে গিয়েছে উন্মাদনা, আকুলতা, অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা। কোথাও মনে হয় প্রকৃতি, ব্রহ্মাণ্ড, মহাকাশে পোস্টমর্টেম করেছেন চেতনায়, রঙে, রেখায়, এক মেলোডির মধ্য দিয়ে। যে সুরে মিশে থাকে বিষাদ ও উচ্ছ্বাস। তিন বছর আগে প্রকাশিত নিজেরই গ্রন্থালোচনায় স্পষ্ট করেছেন, ‘ছবির নিজস্ব উপাদানের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে ছবির ভরকেন্দ্র। তার রেখা, রং, স্পেস, টেক্সচার প্রভৃতির নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে ছবি পৌঁছতে পারে তার নিজস্ব বাসভূমিতে।’

সঞ্জয়ের ছবির বিমূর্ততাও ওই রঙেরই সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ভিন্ন রেখার এক বিশৃঙ্খল সংগঠন, যা অভিঘাতময় এক শৃঙ্খলিত বন্ধনও। তাঁর রূপবন্ধের বিবর্তিত ভাষা থেকে উৎসারিত আরও বিমূর্ত ও সংগঠিত ফর্মগুলির মধ্যে তখনই বর্ণের আলোড়ন, আবার অজানা দিকনির্দেশ। তিনি রূপের কাঠামোকে গড়েন, ভাঙেন, তছনছ করে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সার্চলাইট ফেলেন আকাশের দিকে। গ্রহ-নক্ষত্রের সন্ধানে? শাখা-প্রশাখায় ছড়ানো জঙ্গল, রশ্মির আলোড়নে জেগে থাকা রূপ কীসের ইঙ্গিত? তবে কি সব অন্ধকার সময়ের ছবি নয়? শিল্পী তো আলোকেও গভীরতর আঁকড়ে ধরার প্রয়াস করেছেন। কোরিয়োগ্রাফির সঙ্গে নৃত্যক্রিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মতোই সেখানে দু’টি মূল্যবান বিষয়ের বোধ স্পষ্ট। এক, ছবি— যা রং, রেখা, বিভিন্ন আকার এবং তাদের যোগ্য সংস্থাপনার মধ্যে। দুই হল, ছন্দের বোধ। যদিও কোরিয়োগ্রাফিতে শিল্প পরিবর্তনশীল, শিল্পীকে তাই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছন্দের কথা ভাবতে হয়। সঞ্জয়ের ছবি প্রায় সতেরো বছর আগে নাট্যসাহিত্যের অধ্যাপক সৌমিত্র বসুর কোরিয়োগ্রাফির আলোচনা স্মরণ করায়। তাঁর স্থির অচঞ্চল পটের কোথাও যেন ভেসে যাচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। তখন তো তাঁর ছবি বলে ওঠে, ‘বাতাসে তুলোর বীজ, তুমি কার? এই দিক-শূন্য ওড়াউড়ি, এ যেন শিল্পের রূপ— আচমকা আলোর রশ্মি পপিফুল ছুঁয়ে গেলে যে রকম মিহি মায়াজাল...।’

তাঁর ছবির ভঙ্গুর রেখা, বালখিল্য টানটোন, মহাজাগতিক রশ্মির আভাস, দামাল বাতাসের ওলটপালট, শাখাপ্রশাখার হেলে পড়া, জলকল্লোল ভেদ করা সবুজ আলোর ঝলকানি, রং-রেখা, তুলির তুলকালাম সংঘর্ষের বিশৃঙ্খলা, রূপারোপের দ্বন্দ্বদীর্ণ উন্মাদনা— এ সবের মধ্যেই কিন্তু তিনি বলে ফেলেছেন অন্ধকার সময়ের কথা। আবার পট জুড়ে নির্মাণ করেছেন এক অন্য রকম আলোর স্থাপত্য।

সঞ্জয়ের ছবি কি কোথাও সিম্বলিক? বস্তুপুঞ্জ তো গোপন সত্যের ব্যঞ্জনা। রং, ভাষা, উচ্চারণ, ঘ্রাণ তো ভেদহীন। এ সবই আইডিয়াজাত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সবটাই তো উপমার মধ্যে বিশ্বকে উন্মোচিত করবে। ফরাসি সিম্বলিজ়মের জনক ও মহাকবি শার্ল বোদলেয়রের ঘোষণাই যেন ভেসে ওঠে।

শিল্পীর ছবিতে প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর কবিতা। ‘কোথাও ভেসে যাচ্ছে সাদা নৌকোর শব। শিকড় জেনে যায় রাত্রির টেক্সচার। দৃশ্য ধোঁয়াশা সারি সারি মন্তাজ। বাজি কি পুড়েছিল? কার্নিশে, হৃদপিণ্ডে?’ এই হল সঞ্জয়ের ‘ডার্কার টাইম’।

Painting Exhibition Review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy