E-Paper

ভাবনা এল সাদায় কালোয়

পার্থ ঘোষের ছবিতে বিশেষ ভাবে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষণীয়। আরও সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে পশ্চিম ইউরোপীয় এক্সপ্রেশনিজ়মের ভাব ও ভাবনার প্রতিচ্ছায়া ওঁর ছবিতে দেখা যায়।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:০৩
অবয়বী: অ্যাকাডেমিতে পার্থ ঘোষের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

অবয়বী: অ্যাকাডেমিতে পার্থ ঘোষের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে পার্থ ঘোষের তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয়ে গেল। রূপালেখ্য গ্ৰুপ আয়োজিত তাঁর এই প্রদর্শনী, নাম ‘ইস্তাহার’।

প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার কোনও সুযোগই শিল্পী ছোটবেলা থেকে পাননি। একেবারে ছোট থেকেই পার্থ ইটের টুকরো, খড়ির টুকরো বা অন্য যে কোনও রঙিন চক জাতীয় জিনিস হাতে পেলেই দেওয়ালে আঁকিবুঁকি করত। তাঁর মা আঁকার শিক্ষকের কাছে দিলেন। কল্যাণ বসুর কাছে পার্থর অঙ্কনশিক্ষায় হাতেখড়ি। পরবর্তী কালে আর্ট কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক কারণে চাকরি করতে হয়েছিল। ১৭ বছর চাকরি করেছেন পার্থ। সেই সময়ে আঁকা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল তাঁর।

কোভিডের সময়ে আবার শিল্পমুখী হন পার্থ। ২০২৩ সাল থেকে তিনি শিল্পচর্চাকে পেশাদার ভাবে জীবিকা অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন।

বিভিন্ন ধরনের চারকোল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে উইলো চারকোল, কম্প্রেসড চারকোল, চারকোল পাউডার, তরল চারকোল ইত্যাদির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে শিল্পীর। এই প্রদর্শনীতে বিভিন্ন ধরনের চারকোলের ব্যবহারে শিল্পীর যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবির মাধ্যমই চারকোল, তবে তার মধ্যেও কিছু ছবি কাগজে অ্যাক্রিলিক রঙে করা,‌ কিছু কাগজে জলরঙের ছোঁয়া এবং স্বল্প কিছু ছবি মিশ্র মাধ্যমের পরিণাম। এ ছাড়াও তেলরঙে তিনি কাজ করেন, কাগজে এবং ক্যানভাসে।

পার্থ ঘোষের ছবিতে বিশেষ ভাবে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষণীয়। আরও সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে পশ্চিম ইউরোপীয় এক্সপ্রেশনিজ়মের ভাব ও ভাবনার প্রতিচ্ছায়া ওঁর ছবিতে দেখা যায়। এক্সপ্রেশনিজ়ম বাহ্য বাস্তবের তুলনায় অন্তরানুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। উত্তর ইউরোপে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়, ভ্যান গঘের উত্তরসূরিরা জার্মানিতে এই শিল্পের বিস্তার করেছিলেন। তাঁদের ভাবনা ছিল জীবনের অন্ধকার দিকটা মানুষের কাছে তুলে ধরা। গাঢ় অন্ধকারের পাশে দীর্ঘ প্রতিচ্ছায়া। তার সঙ্গে মানুষের অবয়ব, কিন্তু তার রেখাগুলো বিমূর্ত। সব মিলিয়ে এক অতিলৌকিক ভাব ফুটিয়ে তোলা। এঁদের বিশ্বাস ছিল যে, শিল্পী সব সময়েই মানুষ, পশুপাখি ইত্যাদির গভীর অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলবে। সেখানে আছে আক্রোশ, ক্রোধ, যন্ত্রণা এবং চরম হতাশার অভিব্যক্তি। পৃথিবীর মানুষের এই সৌন্দর্যবর্জিত বিকৃতি দেখিয়ে মানুষের মধ্যে সেই সব হারিয়ে যাওয়া অনুভূতিতে ধাক্কা মারাই হয়তো ছিল ওঁদের অভিপ্রায়।

শিল্পী বলছেন, প্রথম জীবনে তিনি ভক্ত হয়ে পড়েন ফ্লোরেন্সের মাইকেল‌এঞ্জেলোর। তাঁর ফ্রেস্কো নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেছেন মানুষের প্রতিকৃতি। তাঁর ‘লাস্ট জাজমেন্ট’ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। ভারতীয়দের মধ্যে পার্থর প্রিয় শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। এ ছাড়াও রয়েছেন জার্মান শিল্পী ক্যাথে কলউইটস। পেন্টিং ছাড়াও তাঁর ছাপচিত্র এবং ভাস্কর্যে পারদর্শিতা ছিল। তিনি‌ও জার্মান এক্সপ্রেশনিজ়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যিনি কণ্ঠরুদ্ধ ভাষাকে নিজের শিল্পের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন।

পার্থর ছবিতে পেশিবহুল মানুষের অবয়ব দেখা যায়। সেই সব আকৃতিতে দৈহিক শক্তির পরিচয় আছে। একটা আদিম শক্তির ব্যঞ্জনা। হয়তো প্রথম জীবনে দেখা মাইকেল‌এঞ্জেলোর স্বল্প প্রভাব, কিন্তু সেখান থেকে অনেকটা সরে এসে তিনি অন্তরাত্মার খোঁজে মগ্ন থেকেছেন। পার্থর ছবিতে বাস্তবের প্রতিফলন সে ভাবে নেই। এখানে ঘোড়ার মুখ করুণ রসে আর্দ্র। আবার কোথাও মহিষ বা বাইসনের অভিব্যক্তি হৃদয়-বিদারক।

প্রদর্শনীতে পার্থ সৃষ্টি করেছেন এক নববিবাহিতার ছবি। সেই মুখশ্রীতে আনন্দের ভাবের থেকেও ভবিষ্যৎ জীবনের অজানা এক সঙ্কেতের ছায়া। তাঁর ছবিতে প্রগাঢ় অন্ধকারে এক-একটি মুখ যেন চরম হতাশা কিংবা অন্য কোনও দুঃখকষ্টের শিকার। আঙ্গিকে তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্বতা লক্ষণীয়। ছবিতে আবেগ, অনুভূতি, ছন্দ এবং গতিশীলতায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা চোখে পড়ার মতো। শিল্পরসিককে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে বাধ্য করবে। সব প্রতিকৃতির বিমূর্তকরণ সেগুলিকে আরও যেন আকর্ষক করে তুলেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Art exhibition Academy of Fine Arts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy