E-Paper

রং নয়, সাদাকালোয় বাঙ্ময়

সেখানে ছাপা ছবির উপরে প্রথমে পেনসিল এবং পরে কলম চালিয়ে ধীরে ধীরে সব ড্রয়িং রপ্ত করে ফেলল সেই বালক।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:০১

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি শিল্পী শমীক দে-র নবম একক প্রদর্শনী দেখতে পেলেন কলকাতার শিল্পরসিক দর্শক। প্রদর্শনীর নাম, ‘ইকোস অব দি ইটার্নাল’। এর আগে বেশ কিছু দলীয় এবং একক প্রদর্শনী তিনি করেছেন, কিন্তু এত বিশদে তাঁর ছবি দেখার সুযোগ হয়তো আগে কখনও পাওয়া যায়নি। এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন শৌনক চক্রবর্তী এবং ডলি দাব্রিওয়াল।

শমীক দে শৈশবে ঠাকুরমা-দিদিমার সান্নিধ্যে শুধুই পুরাণের নানা আখ্যান শুনে বেড়ে উঠেছেন। বালগোপাল, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, কালী, গণেশ প্রমুখ দেবদেবীর রঙিন সব ছবি কল্পনা করে, তাঁদের সঙ্গেই নিজস্ব এক কাল্পনিক আত্মীয়তা সৃষ্টি করে ছোটবেলাটা কেটেছিল তাঁর।

এর পর শমীকের হাতে এল ‘অমর চিত্রকথা’ নামে একটি পত্রিকা। সেখানে ছাপা ছবির উপরে প্রথমে পেনসিল এবং পরে কলম চালিয়ে ধীরে ধীরে সব ড্রয়িং রপ্ত করে ফেলল সেই বালক। দুর্গার দশ হাত শরীরের কোন জায়গা থেকে নিঃসৃত হচ্ছে, প্রশ্ন জাগত। গণেশের দেহের গড়নে কৌলীন্যের অভাব, সেই বালককে অবাক করত। নৃসিংহ অবতারে মানুষের শরীরে সিংহের মাথার ইতিহাস জানতে উৎসুক বালক রাত জেগে কাটাত উত্তরের সন্ধানে। সেই ছোটবেলা থেকেই প্রথমে ড্রয়িং এবং তার উপরে ক্রেয়ন দিয়ে ছবি আঁকা শুরু।

স্কুল-কলেজ শেষ করার সময়ে শমীক সান্নিধ্য পান কিছু বড় শিল্পীর। স্কুলের শিক্ষক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সমকালীন শিল্পী সনৎ কর,‌ রবীন মণ্ডল এবং আরও কিছু বিশিষ্ট শিল্পীর সঙ্গে। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও ওই শিল্পীগোষ্ঠী শমীককে জায়গা দিয়েছিলেন নিজেদের অঙ্গনে। সেই ছত্রচ্ছায়ায় একজন শিল্পী বেড়ে উঠলেন, যাঁর শিল্প সম্পর্কে ধারণা হল দৃঢ়। অনেক ছবি দেখা ও আলোচনা শোনার সুযোগ পেলেন শমীক।

এর পরে দীর্ঘ কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে শমীক ছবি এঁকেছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করেছেন। যদিও পাশাপাশি একটা চাকরিজীবন আলাদা ভাবে সব সময়েই ছিল তাঁর।

এই প্রদর্শনীতে দশমহাবিদ্যার কাহিনি এবং আলাদা করে এঁদের দশটি রূপ— যেমন কালী, তারা, ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী, কমলা এবং ছিন্নমস্তার ছবি দেখা গেল। ঐশ্বরিক রূপের ভিতর দিয়ে শিল্পী কিন্তু অন্য কথা বলতে চেয়েছেন। দশমহাবিদ্যার বিভিন্ন রূপের মধ্যে বিশেষ করে ‘ছিন্নমস্তা’র ছবিটি বড়ই সাঙ্ঘাতিক। নিজের মস্তক ছিন্ন করে মস্তিষ্কবিহীন শরীর উপবিষ্ট আছে সঙ্গমরত দু’টি মানুষের উপরে। ফিনকি দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নিজেও পানরতা নিজের রক্ত। এই দেবী বৈপরীত্যের প্রতীক। যেমন, সুন্দর ও অসুন্দর, কথা ও স্তব্ধতা, সৃষ্টি এবং প্রলয়। কুণ্ডলিনী জাগ্ৰত হলে, যখন অহঙ্কারের অবসান হয়, তখন মানুষের মধ্যে যে আত্মানুভূতি জন্ম নেয়, তার‌ই রূপ।

বিষ্ণুর অনন্তশয্যা ছাড়াও মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, নৃসিংহ, রাম, বলরাম, কল্কি, পরশুরাম, কৃষ্ণ প্রমুখ দশাবতারের ভারী সুন্দর দশটি ছবি এঁকে শিল্পী সোজা চলে এসেছেন হরিহরের ছবিতে। এই ছবি মহাজাগতিক ভারসাম্যের কথা বলছে। দার্শনিক দিক থেকে দেখলে অদ্ভুত ঐক্য চোখে পড়ে। শিব এবং বিষ্ণু যে একেবারেই এক, এ উপলব্ধি সহজেই করা যায় এই কাজ দেখলে। এ হল ঈশ্বরের অদ্বৈত ভাব।

শমীক দে-র দেবদেবীর ছবিতে কিন্তু তিনি প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণায় আমাদের ভাবাতে চাননি। সম্পূর্ণ নিজের মতো করে তাঁদের কাহিনি নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। ভারতীয় এবং পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার চিত্রকলার ইতিহাসে প্রাচীন গুহাচিত্রগুলিতে যে সব রেখাচিত্র পাওয়া যায়, তার মধ্যে কিছু কিছু বহু হাজার বছরের পুরনো। তার পর আমরা দেশীয় পদ্ধতিতে আ‌ঁকা প্রথমে রাজপুত এবং তার পর মুঘল মিনিয়েচার কাজে অনেক ড্রয়িং দেখেছি। তার অনেক পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পটুয়া চিত্রকলার ঐতিহ্যে এবং অন্যান্য লোকশিল্পেও লাইন ড্রয়িং বা রেখাচিত্রের প্রচলন ছিল। সেই সময়ে বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীরাও প্রচুর রেখাচিত্র এঁকেছেন। সব শিল্পীই রেখায় ধরতে চান মানুষ বা অন্য কিছুর অবয়ব।

শমীক দে সেই রেখাকে সম্বল করে পরিপূর্ণ ভাবে নিজের আঙ্গিকে গল্প বেঁধেছেন। তাঁর গল্পে ফুটে উঠেছে অভাবনীয় নাটকীয়তা। এ ছাড়াও নাচের ভঙ্গি এবং অনবদ্য মুদ্রাসম্ভার মুগ্ধ করে। বিশেষত কৃষ্ণের ভঙ্গিমায় তাঁর মহাভারতের অর্জুন-সখার মাহাত্ম্য থেকে যেন প্রেমিক সত্তার প্রতি শিল্পীর পক্ষপাত বিশেষ ভাবে নজরে পড়ে।

বিমূর্তকরণের চরমে পৌঁছেছে তাঁর শ্রীনাথজী ছবিটি। এ যেন কালি-কলমের জাদু। তাঁর শৈল্পিক বোধ, ডিজ়াইনের ধ্যানধারণা, কৃষ্ণের মুখের অভিব্যক্তি দর্শককে মুগ্ধ করে। সম্ভবত এটি প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ ছবি।‌

তিনটি রূপ দেখিয়েছেন দুর্গার। অম্বিকা, শূলধারিণী এবং সিংহবাহিনী। এই তিন রূপের মধ্যে শূলধারিণীর ভাবনা অকল্পনীয়। শুধু কলমের কাজে নানা রকম টোনের তারতম্য সৃষ্টি করেছেন। নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছেন দেবীর বস্ত্র, অলঙ্কার, তাঁর পদতলে সিংহের মুখের হতাশা এবং সিংহের উপর তাঁর চরণযুগল। সমস্তটা পাশাপাশি রাখা কলমের নকশায় করা, অথচ প্রতিটি নকশা বিভিন্ন স্বরে বাঁধা।

এর পর শমীকের ছবিতে দেখা গেল শিবকে। দুই রূপে দেখিয়েছেন, কালভৈরব এবং পশুপতি। কালভৈরব রূপে করছেন ধ্বংস। আবার পশুপতি হচ্ছেন রক্ষাকারী। তিনি সমস্ত প্রাণিজগৎ রক্ষা করেন এবং উত্তরণের মধ্য দিয়ে জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি দেন মানুষকে।

এর পরে দেখা গেল গণেশজননী দুর্গাকে। গণেশের জন্মের পরে শিব তাঁর মাথা কেটে দিয়ে পরে আবার হাতির মাথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই জন্য গণেশের এক অভূতপূর্ব রূপ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তার ফলে গণেশের মধ্যে দু’টি রূপ প্রকট হল— এক রূপে তিনি আদ্যাশক্তি এবং তার সঙ্গে দেবত্বপ্রাপ্ত। বত্রিশ রকমের গণেশকে নানা রূপে দেখানো হয়েছে শমীকের ছবিতে। এই সব কাহিনি গণেশ পুরাণের। এ ছাড়াও ভাল লাগে সমুদ্রমন্থন, মহাকাল এবং অর্ধনারীশ্বরের শৈল্পিক ব্যাখ্যা।

শিল্পী শমীক দে-র সাদাকালোর রেখাচিত্রের গল্পে, কারুকার্যে, ভাবানুভূতিতে স্বকীয় ধ্যানধারণার ছাপ সুস্পষ্ট, যা দর্শককে নতুন ভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Black and White Birla Academy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy