শিল্প মানে শুধুই সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়। বরং সমাজের নান্দনিক দলিলও বটে। ইমামি আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি আয়োজিত শিল্পী প্রশান্ত সাহুর কাজে তারই নজির দেখা গেল। শিরোনাম, ‘দ্য জিয়োমেট্রি অব অর্ডিনারি লাইভস’। প্রায় দু’মাস ধরে চলেছিল পেন্টিং, ভিডিয়ো, ইনস্টলেশনের এই স্মৃতিভাণ্ডার।
সমসাময়িক ভারতীয় শিল্পের অন্যতম কণ্ঠস্বর প্রশান্ত সাহু। কঠোর অনুশীলনের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির নীরব শক্তির দিকে তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। কলাভবন এবং বরোদায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সাহু সম্প্রতি শৃঙ্খলা ও সহানুভূতির এক বিরল ভারসাম্য ক্যানভাসে তুলে ধরলেন।
গ্যালারিতে প্রবেশ করতেই দৃষ্টি পড়ে জ্যামিতি এবং ডায়াগ্রামের কাঠামোয়। দেখা যায় সূক্ষ্ম কিছু স্থাপন। যেমন কামারের হাতুড়ি, কুমোরের চাকা, ছুতোরের করাত— সবই স্থাপিত জ্যামিতিক শ্বাসের ছন্দে। তবে এখানে জ্যামিতি কোনও বহির্জগতের রেখা নয়, একটি স্পন্দন, পরিমাপের উপায়।
প্রদর্শনীর সবচেয়ে আকর্ষক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তোলা। উদাহরণস্বরূপ, একজন কারিগরের পূর্ণাঙ্গ চিত্রের পরিবর্তে তাঁদের সরঞ্জাম, রূপরেখার ছায়ায় অর্ধভাসিত। ক্যানভাসে, শরীরের ক্ষীণ ইঙ্গিত প্রযুক্তিগত রেখার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এই অনুপস্থিতি সে অর্থে শূন্যতা নয়। এখানে শ্রম ফিসফিস করে কথা বলে, নিজের অর্থের স্থাপত্য বহন করে। জীবনের এই অদৃশ্য স্রোত নিঃশব্দে আমাদের ছুঁয়ে যায়।
শিল্পীর এই একক প্রদর্শনীটি দর্শনের সামনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন করে। চিত্রপটে যেমন আছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খসড়া, মানচিত্রের নকশা, তেমনই আছে কবিতার মতো আবেগ ও মানবিক সুর। তিনি তাঁর ক্যানভাসকে নির্মাণ করেছেন প্রায় স্থাপত্যের মতো। জ্যামিতিক বিন্যাসে শিল্পীর প্রতিটি রেখা যেন সময়ের স্বাক্ষর। উঠে আসে সমাজের সেই মানুষগুলি, যাঁদের ছাড়া সভ্যতা এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারত না। পটে তারা হয়ে ওঠে প্রকৃত মহাকাব্যিক চরিত্র।
শিল্পে আসার আগে প্রশান্ত সাহু মূলত বৈদ্যুতিক প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ফলে তাঁর কাজে ডায়াগ্রাম, গ্রিড এবং কার্টোগ্রাফিক অঙ্কন নির্ভুল। শিল্পী রূপকের সঙ্গে বাস্তববাদের মিশ্রণ ঘটান বিমূর্ত উপায়ে। যেমন বাসনপত্র, চটি, সরঞ্জামের ব্যবহারে তৈরি হয় প্রতীকী কাহিনি। কৃষক, কামার, কুমোর এবং কারিগর— প্রায়শই যাদের উপস্থিতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অলক্ষিত থাকে, রোম্যান্টিক সুরের বিপরীতে এই শ্রমচক্রের প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাঁর কাজে। মাটি, ধাতু, ঘামের সাথে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকার চিত্রগুলি সাহু একটি স্মারক হিসেবে রাখেন।
প্রদর্শকক্ষের একটি রূপকধর্মী ইনস্টলেশন আকর্ষণ করে। ‘টি টেবল টক’ কাজটি খানিক এ রকম— একটি টেবিলের উপরে টেরাকোটার স্তূপীকৃত চায়ের ভাঁড়। অডিয়ো ক্লিপ-সহ একটি ধারণাও দেওয়া রয়েছে। প্রকল্পটির জন্য স্থানীয় এক কুমোরকে দিয়ে শিল্পী তিন হাজার মাটির কাপ তৈরি করান। বর্জ্য পদার্থের মতো অর্ধেক ভাঙা টুকরোয় পরিণত। টেবিল ঘিরে চা খেতে খেতে যে কথোপকথন, সেটি দীর্ঘ দিন ধরে শিল্পী রেকর্ড করেন। দোকানে আসা মানুষগুলির স্টাডি এবং চা পানের পরে ফেলে দেওয়া ভাঁড়গুলিতে সেইসব লিপিবদ্ধ করা— ‘আরও এক কাপ হবে?’, ‘কী খবর এখনকার রাজনীতির?’ ইত্যাদি। অসাধারণ একটি ভাবনা। বস্তুত কাপে খোদাইকৃত স্বীকারোক্তিগুলি প্রদর্শনীর গতি বাড়িয়ে দেয়। প্রশান্ত সাহু নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে বসিয়ে একটি প্রতীকী সভাস্থল গড়ে তোলেন।
বাঁ-দিক ঘেঁষে রয়েছে দু’টি দীর্ঘ ওয়াল ইনস্টলেশন। শিল্পী সাহুর জন্ম ওড়িশায়। ফলে সেখানকার লোককথা, প্রবাদ এবং গ্রামের গল্প কবিতার হরফ এখানে মেলে ধরেছেন তিনি। মডার্ন টেকনোলজির প্রতিরোধে আদি, অকৃত্রিম জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। আর একটি কাজে দেখি জলাশয় ধরে একটি পাড়ে কতকগুলি বিক্ষিপ্ত চেয়ার। কোনও পুজো বা উৎসবের পরে দায়সারা ভাবে ফেলে রাখা। তার একটি স্কিলফুল প্যাটার্ন। ক্ষয়িষ্ণু একটি স্থানের মানচিত্র— ‘ম্যাপ অব শান্তিনিকেতন’। এ ছাড়া ‘রুরাল লাইফ’-এর দক্ষ ড্রয়িং, ‘ম্যাপিং দ্য নেবারহুড’ বা শিল্পীর যাতায়াতে উঠে আসা জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত প্রক্রিয়াটিকে একটি ডকুমেন্টারি আর্কাইভ বলা চলে।
শিল্পীর কাজগুলিতে জেসো কালারের উপরে ওয়াশের একটা টোন। তার উপরে হালকা কালির গাণিতিক কাঠামো। বড় ক্যানভাসে প্রিন্ট বসিয়ে সেটা ট্রেস করা। তার উপরে ড্রয়িং, স্পেস ছেড়ে আবার কাজ। সব মিলেমিশে একাকার। অ্যাক্রিলিক ছাড়া অয়েল, চারকোলের ব্যবহার এবং মাইক্রোপয়েন্ট পেনের দাগ। রং এসেছে রূপকের ভূমিকায়। যেমন লাল রং শ্রমের উত্তাপ ও সংগ্রামের প্রতীক। শহরের ক্লান্তি ও বঞ্চনার ভাষা ধূসর। অদম্য আশার চিহ্ন নীল।
‘অ্যানসেসট্রাল ফ্র্যাগমেন্টস অর দ্য ডিভিশন অব অ্যানসেসট্রাল ল্যান্ডস’ কাজে দেখা যায়, অতীতের ভূখণ্ড সময়ের ছোঁয়ায় কীভাবে খণ্ড হয়ে যায়, তার এক লিপি। সীমান্ত ও বিভাজনের দ্বন্দ্ব চিত্রিত হয় গ্রাফাইটের সূক্ষ্মতায়। শহর থেকে গ্রাম-পঞ্চায়েতের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে দেখা উপাদানের মধ্যে যে জ্যামিতি লুকিয়ে আছে, সেগুলি তিনি ফুটিয়ে তোলেন। দিনের পর দিন গ্রামীণ ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের চরিত্রগুলি স্কেচবন্দি করে, শিল্পী মনে করিয়ে দেন, সভ্যতার প্রকৃত সৌন্দর্য চাকচিক্যে নয়, রয়েছে ঘাম ঝরানো শ্রমজীবীদের হাতে।
শিল্পীর দর্শন এবং সৃষ্টির জাগরণ তরুণ শিল্পীদের প্রভাবিত করে। এবং তাঁর কাজ শেখায়, ‘ভাঙনেও লুকিয়ে আছে মিলনের বীজ’।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)