E-Paper

শিল্পের ত্রিমাত্রিক ভুবন

আশির দশকের কাগজে আঁকা ‘বারারি ওম্যান’, ‘ম্যান অ্যালোন’ কিংবা ‘আনটাইটেলড’ ছবিতে মানুষের অবয়ব স্পষ্ট থাকলেও, তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে রূপক বিমূর্ততায়।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:০৪
স্রষ্টাত্রয়ী: ইমামি আর্ট গ্যালারিতে তিন শিল্পীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

স্রষ্টাত্রয়ী: ইমামি আর্ট গ্যালারিতে তিন শিল্পীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

শিল্পের দরবারে কখনও কখনও ভিন্ন স্রোত এসে বদলে দেয় পারিপার্শ্ব। সম্প্রতি ইমামি আর্ট গ্যালারিতে প্রবেশের পর সেই অভিজ্ঞতাই হল যেন। বিস্তৃত দেওয়ালে সাজানো তিন শিল্পীর কাজ— শিবপ্রসাদ করচৌধুরী, শান্তনু দেবনাথ এবং ফ্রান্সিস নিউটন সুজা। প্রদর্শনীর পরিসরেই বোঝা যায়, এটি কেবল তিন শিল্পীর আলাদা পরিচয় নয়, বরং সময়, প্রজন্ম ও দর্শনের এক পলিফোনিক দৃশ্যকাব্য।

প্রথমেই চোখে পড়ে শিবপ্রসাদ করচৌধুরীর সিরিজ়, “দ্য রিভার ইন দ্য স্কাই”। নামেই লুকিয়ে আছে বৈপরীত্যের কাব্য— নদী, যে সাধারণত ভূমিতে বয়ে চলে, তাকে শিল্পী স্থাপন করেছেন আকাশে। এই রূপান্তরই দর্শককে প্রস্তুত করে দেয় এক অদৃশ্য প্রবাহের সামনে দাঁড়াতে। ষাটের দশক থেকে তাঁর শিল্পচর্চা গড়ে উঠলেও, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে আজ পরিণত করেছে বিমূর্ততার এক নিবেদিত সাধকে। রংই তাঁর একমাত্র ভাষা— কখনও গভীর নীলের ভিতরে সাদার আলো যেন সমুদ্রের গর্জনের মাঝে চাঁদের আভা, কখনও মাটির টোনে লুকিয়ে থাকে গ্রামীণ লোকজ ছাপ।

আশির দশকের কাগজে আঁকা ‘বারারি ওম্যান’, ‘ম্যান অ্যালোন’ কিংবা ‘আনটাইটেলড’ ছবিতে মানুষের অবয়ব স্পষ্ট থাকলেও, তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে রূপক বিমূর্ততায়। পরবর্তী কাজগুলিতে রূপ নেয় রেখা ও জ্যামিতি— বিশেষত ত্রিভুজ, যা তিনি শান্তিনিকেতনে যোগ দেওয়ার পরে আবিষ্কার করেছিলেন স্থানীয় মৃৎশিল্প থেকে। এই সরল মোটিফই হয়ে ওঠে তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় সূত্র। কর্মসূত্রে যেখানেই থেকেছেন, সেখানকার স্থানীয় রূপ আবিষ্কার করেছেন। বিশেষত লোকশিল্পের আদিম রূপই তাঁকে বিমূর্ত পথে চালনা করেছে।

শিল্পীর রেখা কখনও দৃঢ়, কখনও শূন্যতায় মিলিয়ে যায়, র‌ং কখনও বিস্তৃত, কখনও মাটির মতো স্তব্ধ। ফলে তাঁর কাজের সামনে দাঁড়ানো মানে প্রকৃতি, স্মৃতি ও আত্মানুভূতির মাঝে দোদুল্যমান হয়ে থাকা। দর্শক যদি ধৈর্য ধরতে পারেন, তবে আবিষ্কার করবেন অন্তর্লীন এক সেতু, যা দৃশ্যের ভিতর দিয়ে আত্মার কাছে পৌঁছে দেয়।

এই ধারার একেবারে বিপরীতে শান্তনু দেবনাথের ছবি যেন প্রত্যক্ষ জীবনের দগদগে আখ্যান। তাঁর সিরিজ় ‘মরফোলজি অব ওয়াটার’ মূলত গ্রামীণ জলাশয়ের বিলুপ্ত অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে। নদী, খাল, পুকুর— যা এক সময়ে গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল— আজ তা প্রায় অনুপস্থিত। শিল্পীর অভিজ্ঞতায় এই জলাশয়গুলো মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে মিশে থাকলেও, বর্তমান সমাজে তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে।

এই বিস্মৃতির প্রতিচ্ছবি তাঁর ছবিতে বিষণ্ণ ছায়া ফেলে। ‘হাউ উই প্রোটেক্ট’ কিংবা ‘কনস্ট্রাকশন ওভার ওয়াটারবডিজ়’ ছবিতে মানুষের উপস্থিতি সরাসরি নেই, অথচ তার অদৃশ্য উপস্থিতিই প্রকট হয়ে ওঠে। একটি লম্বা আয়তাকার চিত্রে সূত্রা নদীর গভীর খাল যেন এক দিকে প্রাচীন স্মৃতির ধারক, অন্য দিকে ক্ষণস্থায়ী গল্পের আশ্রয়। ইয়েলো অকার, স্যাপ গ্রিন, বার্ন্ট সায়নার মিশ্রণে তিনি নির্মাণ করেছেন জলের ভূখণ্ড, যা জীবনের ক্ষয়িষ্ণু রূপের প্রতীক।

শিল্পীর কিছু ছবিতে ক্লোঁদ মোনের ‘ওয়াটার লিলি’র প্রভাব স্পষ্ট। ছোট ছোট রঙিন স্ট্রোকে জলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেচে ওঠে। আবার অন্য ছবিতে মোনোক্রমিক অন্ধকার যেন গভীর অনুসন্ধানের পথ খুলে দেয়। দর্শক দেখেন, এক দিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য, অন্য দিকে তার মৃত্যুমুখী অবস্থা। এই দ্বন্দ্বই শান্তনু দেবনাথকে নতুন প্রজন্মের ভিড়ে আলাদা করে চিহ্নিত করবে।

আর এই দুই সমকালীন শিল্পীর পাশে যখন হাজির হন ফ্রান্সিস নিউটন সুজা, তখন প্রদর্শনীর দৃশ্যপট এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। প্রোগ্রেসিভ আর্ট গ্রুপের অন্যতম পথিকৃৎ, ভারতীয় আধুনিক শিল্পের এক বিদ্রোহী মুখ— সুজা রেখা ও রঙের নির্ভীক ব্যবহারে আজও দর্শককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তাঁর কাছে সৌন্দর্যের প্রচলিত সংজ্ঞা ভেঙে যায়, কদর্যতাই হয়ে ওঠে সত্যের প্রতীক।

১৯৮৪ থেকে শেষ সময় পর্যন্ত তৈরি কিছু নির্বাচিত কাজ এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। একটি মুখ, সরলরেখায় নির্মিত— বিকৃত নাক, চওড়া চোখ, শক্ত করে ধরা ঠোঁট। ন্যূনতম টানে যে তীব্রতা, তা অন্তর্লীন প্রতিবাদের নগ্ন মুখ। অন্য দিকে ১৯৯৪ সালের একটি কাজ ম্যাগাজিন পেপারে আঁকা শহরের স্থাপত্য ভেঙে পড়ছে। কর্কশ রেখায়, রঙের কোলাহলে ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ম ও রাজনীতির হাহাকার।

তাঁর কেমিক্যাল অল্টারেশনস কৌশলে করা কিছু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্টিল লাইফ’ ছবিটি। কালো পটভূমিতে সাদা কাপ, গ্লাস, বোতলে ছিটকে পড়া কমলা রং— স্টিল লাইফ হলেও, রঙের তীব্র সংঘর্ষে হয়ে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতীক। সুজার ছবির প্রধান অস্ত্র রেখা, রং তার আক্রমণ। শিল্পীর কাজের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শক বাধ্য হন নিজের ভিতরের ভয় ও প্রতিবাদকে চিনে নিতে।

এই প্রদর্শনী কেবল তিন শিল্পীর কাজের সমাহার নয়, বরং সময় ও দর্শনের ভিন্ন স্রোতের মিলন। শিবপ্রসাদ করচৌধুরীর বিমূর্ত জ্যামিতি, শান্তনু দেবনাথের জলাশয়ের অন্তর্লীন শোক এবং সুজার বিদ্রোহী রেখা— সব মিলে গড়ে ওঠে শিল্পের বহুবচন কাব্য। দর্শক অস্থির হয়ে উঠবেন— এটাই এই প্রদর্শনীর সার্থকতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Emami Art Gallery Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy