E-Paper

সীমানা ছাড়িয়ে নতুন দিগন্ত

শহরের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে অমিত ভড়ের কাজ বেশ পরিচিত। ড্রয়িংয়ের জোরে পার্সপেক্টিভ এবং আলোছায়ার সুচারু টোন, শিল্পীর মেধা ও ধৈর্য প্রমাণ করে।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৫ ০৮:৫১
মগ্নতা: চারুবাসনায় ফ্রিউইংস দল আয়োজিত এক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

মগ্নতা: চারুবাসনায় ফ্রিউইংস দল আয়োজিত এক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

শিল্পীদল ফ্রিউইংস নিবেদিত ‘বিয়ন্ড দ্য এজ’ নামক প্রদর্শনীতে এ বার ১২ জন শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন কয়েকজন আমন্ত্রিত শিল্পীও। সম্প্রতি সেই আয়োজন করা হয়েছিল চারুবাসনার গ্যালারি চিত্তপ্রসাদে। জন্মলগ্ন থেকে দলটি নিজেদের সদস্য ছাড়াও বিশিষ্ট শিল্পীদের ছবি রাখার ব্যবস্থা করে তাদের প্রদর্শনীতে। এ বারের পরিকল্পনায় রাখা হয়েছিল যোগেন চৌধুরী, তাপস কোনারের মতো বরিষ্ঠ শিল্পীদের কাজ।

সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে যোগেন চৌধুরী প্রতিনিয়ত যে উদাহরণ রাখেন, তা আগামীর কাছে নিঃসন্দেহে প্রেরণার বিষয়। এই প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর ওপেকধর্মী রেখার জীবন। তবে সেই রেখা কোনও সূক্ষ্ম রেখা নয়। মোটা দাগের আলোড়ন তোলা মুখভঙ্গি, যে অভিব্যক্তির দূরদর্শিতা দর্শককে ভাবাতে পারে। তাপস কোনারের ফর্মে বৌদ্ধ দর্শনের প্রতিচ্ছবি এসেছে চোখেমুখে। সৌরমণ্ডল জুড়ে কল্পনার পাখা মেলেছে জীবজগতের রং। ব্যাল্যান্সিং পথে ফর্মের ছন্দ ধেয়ে চলেছে অলিখিত সঙ্গীতের দিকে।

শহরের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে অমিত ভড়ের কাজ বেশ পরিচিত। ড্রয়িংয়ের জোরে পার্সপেক্টিভ এবং আলোছায়ার সুচারু টোন, শিল্পীর মেধা ও ধৈর্য প্রমাণ করে। অন্য দিকে, প্রবাল সি বড়াল একজন সিনিয়র শিল্পী। তাঁর কাজের ধারায় ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র দেখা যায়। বস্তুত সেই ভিন্নতা শিল্পী সম্পর্কে আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে।

লাইনের স্ট্রেংথ নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাজ করেন সুবিমলেন্দু বিকাশ সিনহা। যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু নিয়েই কাজ করেন। অতিরিক্ত কিছু নেই। ছবিতে রঙের ভূমিকায় প্রথমেই যেটি মনে হয়, তা হল, যথার্থ রং নির্বাচন। পশ্চাৎপটে গ্রন্থিমালার মতো আঁকিবুঁকির যে ফর্ম এসেছে, তাতে শিল্পী বস্তুজগৎকে উপেক্ষা করতে পারেননি। এর পরে মূল ফোকাসে গড়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ রেখা-সমন্বিত একটি নিরপেক্ষ ফর্ম। অনায়াসেই যার চলাফেরা। সে কখন কী রূপ নেবে, বলা মুশকিল। শিল্পী সুবিমলেন্দুর কথায়, রেখা যেমন ইস্পাতের চেয়েও কঠিন হতে পারে, আবার হাওয়ার চেয়েও হালকা হতে পারে। তাঁর কাজে ধরা পড়ে এই দর্শন।

সিনেমা ও ওটিটির পর্দায় অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ লোকনাথ দে। অভিনয় নেশা হলেও, ছোট থেকেই ছবি-ভাস্কর্যের প্রতি ছিল তাঁর টান। লকডাউনের অফুরন্ত অবসর সেই শখকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ এনে দেয়। শুরু হয় রং, তুলি নিয়ে কাজ। নিজেকে মুক্ত ভাবে মেলে ধরার প্রক্রিয়ায় মেতে ওঠেন শিল্পী। এই প্রদর্শনীটিই তাঁর প্রথম। সময়জনিত ঘাত-প্রতিঘাতের মুখগুলি উচ্চারিত হয়েছে নানা ব্যঞ্জনায়। বিশেষত ‘অভয়ার অংশ’। আতঙ্ক ঘিরে রয়েছে চোখেমুখে। গাঢ় রঙে সন্নিবিষ্ট, এ-ফোর সাইজ়ের ছবিগুলি অ্যাক্রিলিকে করা। চিত্রপট বাছাইয়ে কোনও নির্দিষ্ট কাগজ নয়, যে কোনও বাতিল বা প্যাকিংয়ের কাগজও সাপোর্ট হিসেবে এসেছে। স্টাইলের বিচারে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, শিল্পচর্চায় লোকনাথের প্রবেশ খুব সাম্প্রতিক নয়। হয়তো অভিনয় এবং তুলিকলার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার প্রক্রিয়া পরস্পর সম্পৃক্ত। কোন ও না কোনও ভাবে শিল্পচেতনা ফুটে ওঠেই।

ক্যানভাসের উপরে চারটি রেড ও ক্রোম ইয়ালোর আধারে আঁকা কাজে দেখা যায় ষাঁড়ের ক্ষিপ্র ভঙ্গি। বাপ্পা ভৌমিকের এই ‘বুল’ সিরিজ়ের কাজগুলিতে ব্রাশিংয়ের দক্ষতা অনুমান করা যায়। এ ছাড়া প্রদর্শনীতে ছিল বরুণ পোদ্দারের নজর কাড়ার মতো স্কাল্পচার। বিভিন্ন ফর্মের চারটি ভাস-ই সেরামিকের। ভাসের শরীর জুড়ে মসৃণতা।

দলের প্রধান সদস্যদের মধ্যে আবীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিভিত্তিক কাজগুলি চোখ টানে। ব্যাকগ্রাউন্ডের আবছা লেপন ছবিতে পার্সপেক্টিভ তৈরি করেছে। প্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা অনুরাধা ভট্টাচার্য মূলত কর্পোরেট জগতের মানুষ। আকাশের রং নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন, তাকে বুঝতে চেষ্টা করেন। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে উঠে আসে পৃথিবী থেকে দেখা সেই আকাশের ক্যানভাস। শিল্পীর এই কাজগুলিতে এক ধরনের স্বাধীনতা, মুক্ত ভাবনা অনুভব করা যায়।

জলরঙে রিমঝিম সিনহা দাশগুপ্তের সিটিস্কেপের নতুন দৃষ্টিকোণ মন্দ লাগে না। চেষ্টা বা পরিশ্রমের বিকল্প নেই, এই বিশ্বাসে এগিয়ে যান এই শিল্পী। ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সুদীপ্ত অধিকারী গতির সৃষ্টি করেন। তাঁর স্কেচি স্টাইলের জলরঙে প্রায়শই সেটি দেখা যায়। একটা অনায়াস, চটজলদি ব্যাপার থাকে সুদীপ্তর কাজে, যা দৃষ্টিসুখ তৈরি করে।

অভিজ্ঞদের সঙ্গে একাসনে ছবি সাজানো কম কথা নয়। তরুণ শিল্পীদের সেই সাহস জোগানোর নেপথ্যে অবশ্যই রয়েছে অভিজ্ঞ শিল্পীদের অপার উৎসাহ। স্বাভাবিক ভাবেই ফ্রিউইংসের কাজে তাই আশ্বাস মেলে। তবে যে কোনও শিল্পের শেষ কথাই হল মগ্নতা। এই দলও সেই দীক্ষায় এগিয়ে চলুক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Art exhibition

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy