সম্প্রতি মায়া আর্ট স্পেস উপস্থাপন করল, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘আলপনা রিইম্যাজিনড’, অর্থাৎ আলপনার পুনর্নির্মাণ। এই মুহূর্তে বাংলার আলপনা শিল্পের সেরা ধারক ও বাহক তিনি। সুদীর্ঘ চর্চার শৈল্পিক যাত্রায় তিনি ফুটিয়ে তোলেন নির্ভেজাল এক রূপকচিত্র। গ্রামবাংলা উৎসারিত শিল্পীর আত্মচেতনায় ভেসে ওঠে কাল্পনিক আঁকিবুঁকি।
আলপনা প্রধানত মহিলারাই করতেন একটা সময়ে। শুভ কাজে ঘরে ঘরে আলপনা দেওয়ার চল বহু দিন থেকে। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গ থেকে সুকুমারী দেবীকে এনে শান্তিনিকেতনে আলপনা চালু করেছিলেন। নন্দলাল বসুর হাত ধরে আলপনা ভিন্নমুখী হয়। আর সেই ধারা চালিয়ে নিয়ে যান নন্দলাল বসুর কন্যাদ্বয় গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেন। ক্রমে ননীগোপাল ঘোষ, প্রণব রায় এলেন। বর্তমানে সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। রূপ, রস, গন্ধে বিভোর শিল্পীর মানসলোকে জন্ম নেয় নিত্যনতুন নকশা। বস্তুগত না হয়েও, নিজস্ব ভঙ্গিতে তারা অর্ঘ্য নিবেদন করে।
আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য দেবতার শরণাপন্ন হতেন বাড়ির মহিলারা। এই ব্রতপালনের প্রাথমিক রীতিই আলপনা দেওয়া। উৎসব, পুজো-পার্বণ ছাড়াও তুলসীমঞ্চ আলপনা দিয়ে সাজানোর রেওয়াজ ছিল বারো মাস। তার উপরে পা দিত না কেউ। এতে আলপনার প্রতি অলিখিত এক সম্ভ্রম তৈরি হয়। শিল্পী সুধীরঞ্জনের স্মৃতিতে রয়েছে, কী ভাবে তাঁর মা, দিদিমা গোবর নিকোনো মেঝেয় বা উঠোনে আলপনা দিতেন। সেই আলপনা অবশ্য শিল্পীকে বিশেষ টানেনি ছোটবেলায়। ১৯৭৫-এ শান্তিনিকেতন এসে ছাতিমতলার আলপনা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন সুধীরঞ্জন। তাঁর মনে তৈরি হয়েছিল আলোছায়ার এক অনুভব, যা একেবারেই স্বতন্ত্র।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে শিল্পীর ৪০টি ছবি ও চারটি সরা নিয়ে সুন্দর ভাবে সেজে উঠেছিল প্রদর্শকক্ষের দেওয়াল। নেপালি পেপার, মাউন্ট বোর্ডের উপরে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ ধারণার গোয়াশ বা ওপেক কালার। সুষম বণ্টনের অভিজ্ঞ বিন্যাস। পিটুলি গোলা বা ব্রাশে অভ্যস্ত আঙুলগুলি বুঝিয়ে দেয়, পরিশ্রমের পট কীভাবে উর্বর হয়।
এই ধারায় নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেবেন, তা কোনও দিন ভাবেননি শিল্পী। ছবি নিয়েই তাঁর আগাগোড়া পড়াশোনা। জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভারতী থেকে পেন্টিংয়ে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে শান্তিনিকেতনে আসেন। পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী সেজান, ভ্যান গঘ, মাতিস এবং মন্দ্রিয়ানের ছবির প্রতি প্রবল টান তৈরি হয়। সুধীরঞ্জন তখন করতেন তেলরঙের ছবি। শিক্ষক দিনকর কৌশিক সেটি লক্ষ্য করে তাঁকে দেখালেন পোস্ট কার্ডে আঁকা নন্দলাল বসুর গাছের স্টাডি। একের পর এক ছবি দেখে অভিভূত তিনি। সেখানকার জলবায়ু, আকাশ, বাতাস, ঋতু, গাছ-পালা, ফুল, ফলের সঙ্গে হল নতুন করে পরিচয়।
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য শিল্পীকে ফিরতে হয় কলকাতায়। প্রচুর ফিগারেটিভ কাজ করতেন। কিন্তু ফেলে আসা আলপনার ছাপ তাঁর ভেতরে প্রবেশ করে গিয়েছে তত দিনে। ১৯৮৩-তে চাকরির কারণে পুনরায় শান্তিনিকেতনে আসার পরে সেই ছাপ স্থায়ী আকার নেয়। উৎসব অনুষ্ঠান-রীতির সঙ্গে যুক্ত করেন নিজস্ব ছবির পাঠ। ফলে তাঁর আলপনা জীবনমুখী হয়ে ওঠে। ক্রমে ক্রমে নান্দনিক সৌন্দর্যে পরিণত হয় তাঁর কীর্তি।
প্রধানত রবীন্দ্রনাথের গান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আলপনাকে সাজান শিল্পী। নকশাকেন্দ্রিক হলেও পেন্টিংয়র গুণ এসে যায়। হয়তো এক সময়ে ছবি আঁকতেন বলেই। প্রদর্শনীতে ছিল আকন্দ, পলাশ, এলাচ ফুলের স্টাডি। দীর্ঘ প্যানেলের বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীতের ছবিতে শিল্পীর ঋতুবোধের প্রতি সম্ভ্রম জাগে।
যেমন ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন’-এ প্রকৃতির রুক্ষ মেজাজ। দুরত্ব প্রতিষ্ঠায় কঠিন রেখার ফর্ম। ফুলপাতার ছন্দোময় পরিবর্তনে উন্নীত হয় বিমূর্ত ছক। ‘মেঘ ও পৃথিবীর’ চিত্রকল্পে অপার্থিব সৃষ্টির ঝরে পড়া। জলের ঢেউয়ে তৈরি হয় নকশার চাদর। শিল্পীর ‘বৃক্ষরোপণ’ জাঁকজমকপূর্ণ একটি দিনলিপি। ঘন ডিজ়াইনে আপ্যায়িত ‘লোটাস’ যেন অন্ধকারে মোক্ষলাভ।
আর একটি নিবেদন— তালগাছ ছায়ায় একটি নকশাকৃত মাটির বাড়ি, যেটি ১৯৩০-এ গড়ে ওঠা নন্দলাল বসু কর্তৃক একটি সমবায় প্রকল্প, নাম কারুসঙ্ঘ। লক্ষ্য, ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে কাজ করা এবং বিক্রি করে লব্ধ টাকা বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে দেওয়া। উদ্দেশ্য, সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো। গ্রামীণ জীবনে সৃজনশীল দিক আনা।
শিল্পী সুধীরঞ্জনের প্রতিটি রচনায় মাপ, ওজন এবং নন্দনতত্ত্বের রস ঘুরেফিরে দেখার মতো। কোনও স্কেল বা কম্পাস ব্যবহার করেননি। বদলে, সুতোর সাহায্য নেন। এটি আগেই শান্তিনিকেতনে প্রচলিত। বিপরীতমুখী বেয়ে ওঠা নকশার রসায়নবোধ আকৃষ্ট করে।
ব্রতকথার আলপনায় শিশুচিত্রের মতো সারল্য ফুটে ওঠে। বিশেষ ছকের প্রবেশ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু ভিন্ন ধারা ও সূক্ষ্ম পথে শান্তিনিকেতনের রেখা নিয়ন্ত্রিত হয়। ধর্মীয় বন্ধনে না গিয়ে শিল্পী তাঁর কাজে আনেন বাংলার প্রকৃতি ও ঋতু পরিবর্তনের অনন্য মোটিফ। ফুল,পাতা, পাখি এঁকেবেঁকে মিলিত হয় নান্দনিক সৌন্দর্যে। এই রূপ-সৌন্দর্য আমরা অজন্তাতেও পাই।
সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা উপাসনাগৃহের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজ দেশ-বিদেশে সমাদৃত। মাটিতে থাকা আলপনা এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাটিক, সেরামিক, লেদার সর্বত্র আলপনার ছক অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। মন্দিরের ভাস্কর্য, নকশা এবং প্রাচ্যের নমুনা নিয়ে এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হয়।
শিল্পীর কথায় জানা যায়, কোভিডের সময়ে আগ্রহীদের কথায় অনলাইন ক্লাস নিতে শুরু করেন তিনি। বন্দি জীবনে সামান্য হলেও আলপনা চর্চা বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে আসে, যা আজও অব্যাহত। শিল্পসৃষ্টির পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে চলেছে অবসরপ্রাপ্ত শিল্পী সুধীরঞ্জনের শিক্ষাদান।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)