মনের মতো পৃষ্ঠতলের উপরে গড়া এক কাঠামো, আর তার মধ্যে নিহিত আত্মদর্শন— চিত্র-সাহিত্য হল সেই দর্শনের অন্যতম প্রকাশ। মূলত এই ভাবনা থেকেই চিত্রশিল্পী কৃষ্ণেন্দু চাকীর চিত্রকলার নাম, ‘দ্য কল’। রাধা-কৃষ্ণ সিরিজ়ের এই ডাক কোনও নির্দিষ্ট প্রেমিক বা প্রেয়সীর উদ্দেশে নয়। বিশেষ সম্পর্ক অতিক্রম করা নিগূঢ় এক উপলব্ধিকে বোঝানোর আহ্বান। স্বাভাবিক ভাবেই এর রূপ দিতে শিল্পীকে একটি নির্দিষ্ট দৃশ্যপট অবলম্বন করতে হয়।
দৃশ্যমান পটভূমি বিশ্লেষণের আগে শিল্পীর সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা দরকার। ফাইন আর্টসের ট্রেনিং কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজ থেকে। সৃজনশীল নানা মাধ্যমে নিজেকে বারবার নিয়োজিত প্রথম থেকেই। সাধারণত ডিজ়াইন, ইলাস্ট্রেশন নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। তবে অলঙ্করণধর্মী ছবির থেকে শিল্পীর এ বারের সৃষ্টিগুলি অনেকটাই সরে এসেছে।
সম্প্রতি দেবভাষার সহযোগে চিত্রলেখা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নিবেদন করল কৃষ্ণেন্দুর একক প্রদর্শনী। ক্যানভাসের উপরে ছবির সংখ্যা ছিল ১১টি। এর আগে শিল্পী দু’বার রাধাকৃষ্ণের সিরিজ় করেছেন, পেপার ও সিল্কের উপরে। দু’টির মাধ্যমই ছিল গোয়াশ। ২০১৮-’১৯ সালের পরে এই সিরিজ়ের শেষ প্রদর্শনী এ বার, জানালেন শিল্পী। দীর্ঘ দিন ধরে চলেছিল এই মাধ্যমের (অ্যাক্রিলিক) প্রস্তুতি। তাঁর মতে রাধাকৃষ্ণ একটি চিরকালীন সম্পর্কের প্রতীক, ডিজ়ায়ার। তার মধ্যে রয়েছে নবরসের সমস্ত আবেগ। ছবিতে ট্র্যাডিশন, হেরিটেজ ছাড়াও কোম্পানি পেন্টিং, পোড়ামাটির নির্যাসে মজবুত ভাষা তৈরি হয়। সব ফ্রেমগুলি ১৮”/২৪”-এর হরাইজ়ন্টাল কাজ। এর ফলে দেখার একটা সমান্তরাল সরণি তৈরি হয়।
লাল, নীল, হলুদ তিনটি মৌলিক বর্ণের সংমিশ্রণে ছবিগুলির ভঙ্গিমা ঠিক ভাবে উপলব্ধ হয়। প্রয়োগের স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্যের আকর্ষণ ছিল তীব্র। ইমপ্যাস্টো স্টাইলে ইমপ্রেশন রেখে রেখে করা। সূক্ষ্ম রেখার আধিক্য নেই বললেই চলে। ছবিতে কৃষ্ণ নানা ভাবে বর্ণিত হয়েছে। কখনও সখী, কখনও বন্ধুর বেশে। যেন একে অপরের পরিপূরক। যেমন রাধার পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণ। চুল বেঁধে দিচ্ছে। যা সাধারণত দেখা যায় না। তবে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’তে এর উদাহরণ পাওয়া যায়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় কবি জয়দেব স্পষ্ট বুঝিয়েছেন, এই প্রেম সাধারণ মানুষের কামলীলা নয়। অপার্থিব শক্তির প্রেমগাথা। যেখানে কৃষ্ণ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলেন ‘দেহি পদ পল্লব মুদারম’, অর্থাৎ সমস্ত সামাজিক প্রথার ঊর্ধ্বে এক শাশ্বত সম্পর্ক। সেই দুর্বার সত্তার আকুতি নিয়ে ছবিতে কৃষ্ণের কেশ রূপান্তরিত হয় লম্বা বিনুনির ছন্দে। সৃষ্টি হয় ধর্ম-বর্ণ ছাপিয়ে দেহাতীত এক নিবিড় বন্ধুত্বের।
দেশজ শিল্পকলার প্রতি শিল্পীর যে ঝোঁক, তা শুধু মিনিয়েচারই নয়। টেরা কোটা, ফোক আর্ট, গ্রাফিক্স মিলিয়ে যে ধারণা, সেই সমগ্র অভিজ্ঞতা নিংড়ে কাজে লাগিয়েছেন। ফ্ল্যাট করে রং দিলেও, চাপানোর ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান স্টাইলের প্রভাব দেখা যায়। প্রতিটি ছবির মুহূর্ত, আর্চিং-এর সাপোর্ট নিয়ে অভিষিক্ত হয়েছে। পশ্চাৎপটে অফ হোয়াইটের একটি মনোরম টেক্সচার, যার মধ্যে যুক্ত হয়েছে জ্যামিতিক রেখার আধুনিক টেকনিক। তারই মাঝে আলঙ্কারিক সুকৌশলী স্ট্রোক। সম্পূর্ণ রাজকীয় স্বাদে, লাল ও সবুজ গালিচায় উঠে এসেছে রাধাকৃষ্ণ বনাম ভারতীয় বনেদিয়ানা। একেবারে নতুন দেখা বিরল অভিজ্ঞতা।
প্রথমে ক্যানভাসে আর্থ কালার দিয়ে একটি বেস তৈরি করে, অ্যাক্রিলিকে (এইচডি) চাপানো। গুণগত দিক থেকে এই রং নির্বাচনের কারণ হল ব্রাশিংয়ের দ্রুত স্টাইলকে ফ্রি রাখা। অনেকটা তেলরঙের ব্যবহারের মতো। সতর্কতার সঙ্গে জন্ম দিয়েছেন একাত্মবোধে মৌলিকত্বের বিনিময়। অর্থাৎ একজনের গায়ের রং ও একজনের পোশাকে যেমন এসেছে, আবার একজনের রং আর একজনের শরীর গ্রহণ করছে। চূড়ান্ত ভালবাসার দৃশ্য। দ্বিধাহীন সম্পর্ক পেরিয়ে এক অবারিত দ্বার। অবরোধ-মুক্ত নর-নারীর এই সুস্থ আয়োজনে শিল্পী অকপট। ছবিতে বাঁশের এফেক্টে খিলান, রেলিং, দোলনা, চৌকির মিনিয়েচার উপস্থাপনা। গ্রামীণ চালার মতো আর্চিং। টেরা কোটা মন্দিরের কথাও মনে পড়ে। সব মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, যা ঊনবিংশ শতাব্দীকেও টেনে আনে।
রীতিমতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা মেলে এই প্রদর্শনী থেকে। সম্পর্ক এখন যেখানে সীমারেখায় চলে এসেছে, সেখানে এই প্রদর্শনী দ্ব্যর্থবোধক এবং সামাজিক কল্যাণের একটি নির্দেশনামাও বটে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)