Advertisement
E-Paper

আদিখ্যেতা ছিল দাদুর চোখের বিষ

ঘরোয়া শিশির ভাদুড়ী মানুষটা কেমন ছিলেন, জানাচ্ছেন নাতি শুভকুমার ভাদুড়ীঘরোয়া শিশির ভাদুড়ী মানুষটা কেমন ছিলেন, জানাচ্ছেন নাতি শুভকুমার ভাদুড়ী

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৭ ১০:০০

মরা রাজশাহী জেলার নাটোরের লোক। সাতপুরুষ আগে পূর্বপুরুষদের কোনও একজন হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে চলে আসেন।

আমার ঠাকুরদা, মানে শিশির ভাদুড়ীর বাবার নাম হরিদাস। ওই হরিদাস ভাদুড়ী পর্যন্ত আমাদের নিবাস ছিল হাওড়াতে।

তার পর কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত, কখনও পার্শিবাগান, তো কখনও ঘোষ লেন। শেষে ২৭৮ বি টি রোড।

এর আগে যদি যাই, তো দেখি, আমাদের এক পূর্বপুরুষের নাম সুবুদ্ধি খাঁ। উনি ঢাকাতে সুবেদার ছিলেন। সময়টা হয়তো বা মোগল সাম্রাজ্য। আট-ন’ পুরুষ ধরে আমাদের পদবি ছিল ‘খাঁ ভাদুড়ী’। হরিদাসের সময় থেকে খাঁ বাদ দিয়ে লেখা হতে লাগল শুধুই ‘ভাদুড়ী’।

সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যালের বাবা রাজেন্দ্রনাথ আমার ঠাকুরদার পিসতুতো ভাই। যদিও রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুরদার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়। রাজেন্দ্রনাথই গিয়েছিলেন হরিদাসের জন্য পাত্রী দেখতে মেদিনীপুরে। পাত্রী কৃষ্ণকিশোর আচার্যের প্রথম সন্তান কমলেকামিনী। পরে যিনি মা হলেন শিশিরকুমারের। অপরূপ সুন্দরী। মহীয়সী। ঠাকুরদার যে থিয়েটার-প্রীতি তার এক কারণ ছিলেন মা।
হরিদাস পেশার কারণে থাকতেন বর্মা মুলুকে। কমলেকামিনীকে তাই বহু কাল কাটাতে হয়েছে বাপের বাড়ি। দাদামশাই কৃষ্ণকিশোরই তখন শিশিরকুমারের অভিভাবক। দাদামশাই নাতিকে রামায়ণ, মহাভারত থেকে মাইকেল-মধুসূদন পর্যন্ত আবৃত্তি করে শোনাতেন। দুই মামা, দেবকিশোর-ফণীন্দ্রকিশোর। তাঁরা স্থানীয় নাট্যসমাজের সভ্য। নাটকের প্রাথমিক ভাল লাগা মাতুলের কাছে।

শ্রী রঙ্গম থিয়েটারে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়

ঠাকুরদা বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথমা কন্যা অল্প বয়সেই মারা যান। অন্য সন্তানরা পরপর হলেন শিশিরকুমার, তারাকুমার, বিশ্বনাথ, হৃষীকেশ, মুরারিমোহন ও ভবানীকিশোর। আর কন্যা গৌরী।

হরিদাস কলকাতায় বদলি হয়ে এলে প্রথমে ওঠেন সানকিডাঙায়। সেখান থেকে রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটে। শিশিরকুমারকে তখন কলকাতায় এনে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এনট্রান্স পাশ করে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ (আজকের স্কটিশচার্চ কলেজ)।

এর মধ্যেই চলেছে তাঁর আবৃত্তি চর্চা। মাকে নিয়ে থিয়েটার দেখতে যাওয়া। নামকরা অভিনেতাদের নকল করা। মাকে যে কী ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন ঠাকুরদা, তার একটা নমুনা দেওয়া যায়।

সে অনেক পরের ঘটনা। তখন ‘শ্রীরঙ্গম’-এ থিয়েটার করছেন উনি। কোনও এক কর্মীকে বরখাস্ত করেছিলেন কোনও কারণে। কর্মচারী সোজা গিয়ে ধরলেন শিশির-জননীকে। এর পরে মায়ের হুকুমে শিশিরকুমার বাধ্য হন কর্মচারীকে পুনর্বহাল করতে! শিশির কুমার আর উষাদেবীর একমাত্র পুত্র আমার বাবা, অশোক। উষাদেবীর বাপের বাড়ি আগ্রায়। রায়বাহাদুর ড. নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বাবা। ঠাকুরদা বিয়ে করেন আগ্রাতে গিয়েই।

ঠাকুরদার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ভবানীকিশোরের ডাকনাম ছিল পুতু। ঠাকুরদার অনুপস্থিতিতে জোড়াসাঁকো ঠাকুবাড়িতে যোগাযোগের দায় ছিল ওই পুতুরই। সঙ্গে আর ছিলেন মুরারীমোহনও। শেষের জনের সঙ্গে আবার রবিঠাকুরের এতটাই হৃদ্যতা ছিল যে, কবির চলচ্চিত্র সম্পর্কিত একমাত্র চিঠি ওঁকেই লেখা।

‘প্রফুল্ল’ নাটকে শিশির ভাদুড়ী যোগেশের ভূমিকায়

পুতু চলে যান অকালে। অন্য সব ভাই ছিলেন ঠাকুরদার থিয়েটারে। তাঁর মধ্যে অবশ্য বিশ্বনাথ অনেকটাই এগিয়ে।

প্রথম জীবনে মেট্রোপলিট‌ন কলেজে সাত বছর পড়িয়ে ঠাকুরদা নেমে পড়েন পুরোপুরি অভিনয়ে। ক্রমেই জড়িয়ে যান থিয়েটারে।

তখনই উষাদেবীর আকস্মিক মৃত্যু। আমার বাবার বয়স তখন এক বছরও নয়। মা-হারা আমার বাবা মানুষ হতে থাকে ঠাকুমার কাছে। ঠাকুমাকে বাবা ‘মা’ ডাকতেন বহুকাল অবধি।

ছেলে মাতৃহারা। শৈশবের গোড়াতেই। তবু আমার বাবার সঙ্গে যে খুব কোমল, স্পর্শকাতর সম্পর্ক ছিল ঠাকুরদার, তেম‌ন নয়। তাঁর পরিমণ্ডলে দিলীপ রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, যোগেশ চৌধুরী, এঁরা। ‌নজরুল ইসলাম ঠাকুরদাকে এতটাই ভালবাসতেন যে, তাঁর প্রচুর গ্রন্থ তিনি ঠাকুরদাকে উপহার দেন। কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে থিয়েটারে আনেন শিশিরকুমারই। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

তো, এই বৃত্তে ঠাকুরদা এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, সংসারের দায় ইত্যাদিকে তেমন গ্রাহ্যই করতেন না।

টাকাপয়সার জোগানটা অবশ্য দিতেন, কিন্তু কস্মিনকালে এ মানুষ যে বাজার-দোকা‌নের ধার মাড়াবেন না, বলাই বাহুল্য। বাড়িতে তখন জনা কুড়ি সদস্য। তাঁদের দায়ভার বরাবর সামলেছে পরিবারের পরিচারকরা।

ভাইপোদের মধ্যে ঠাকুরদার খুব প্রিয় ছিলেন বেটু। ভাই হৃষীকেষের ছেলে। বাড়িতে কেউ এলে তাঁকে বসতে দেওয়া থেকে আপ্যায়ন করা, ঠাকুরদার দরকারে কোনও বইপত্র বার করে দেওয়া বা তুলে রাখা সব বেটুই করতেন।

ঠাকুরদার জগৎটাই ছিল অন্য। মায়ের কাছে শুনেছি, রাতে শোওয়ার সময় একদিন মা দেখলেন, ঠাকুরদা মাথার কাছে আলো জ্বেলে পড়ছেন। আবার সকালে উঠে দেখলেন, ভঙ্গিটা সেই একই। উনি পড়েই চলেছেন। মা বললেন, ‘‘এ কী, সূর্য তো উঠে গেল!’’ উত্তর এল, ‘‘ও, আচ্ছা, তা হলে আলোটা নিভিয়ে দাও। বইটা রেখে দাও।’’ জগৎ-সংসার নিয়ে এতটাই নির্লিপ্ত!

মা যত দিন দেখেছেন, তত দিন খাওয়াদাওয়াতে বাড়াবাড়ি একবারেই পছন্দ করতেন না ঠাকুরদা। ছিমছাম নিরামিষ হলেই ভাল। খুব প্রিয় ছিল শুক্তো। শুরুর পাতে তেতো। ভালবাসতেন ফল। আর সন্দেশ।

একটা সময় যখ‌ন বাড়ি ছেড়ে মাঝে মাঝেই ‘শ্রীরঙ্গম’-এ থাকতেন, তখ‌ন সিমলে পাড়ার বিখ্যাত দোকান থেকে নিয়মিত গোলাপি প্যাঁড়া খেতেন। সেই সঙ্গে দুধ।

অভিনেতা মানুষ, তা বলে যে বাড়িতে থিয়েটারের সংলাপ আওড়াচ্ছেন, গান করছেন, একটা দিনের জন্যও কেউ এমনটা দেখেনি। কোনও কিছুতেই উচ্চকিত নন। বরং অনাবেগী। আদিখ্যেতার ধারপাশ মাড়াননি কোনও দিন। দেখনদারি তো নয়ই। আর বাস্তব জীবনে? অসম্ভব বৈরাগী, উদাসী!

কীসে কত টাকা গেল, কে যে কী নিল, ঘুণাক্ষরে খবর রাখতেন না। আমাদের বাড়ি থেকে কত জন যে কত কত দামি দুষ্প্রাপ্য বই নিয়ে ফেরত দেয়নি, তারও হিসেব নেই। অথচ এগুলো তো ওঁর অসম্ভব প্রিয় সম্পদ!

একমাত্র সৌমিত্রবাবুকে (চট্টোপাধ্যায়) দেখতাম এ ব্যাপারে একদম সাচ্চা। বই নিতেন। পড়তেন। ফেরত দিতে আসতেন। বিষয় নিয়ে আড্ডাও দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আমার যখন ছ’বছর মাত্র বয়স, ঠাকুরদা চলে যান। ঠাকুরদা সম্পর্কে আমার যা জানা, তার অনেকটাই পারিবারিক সূত্রে, নয়তো পড়ে পড়ে। কিন্তু কিছু কিছু ছবি চোখে এখনও লেগে। আজও যেন দেখতে পাই, বি টি রোডের বাড়ির দোত‌‌‌লার সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন ঠাকুরদা, ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, কথা বলছেন নিচু স্বরে।

ঠাকুরদার ঘরে একটা ছবি থাকতই থাকত। সেটা হল ‌নেতাজির। অন্য কোনও দেশনায়কের ছবি থাকত না কিন্তু। নেতাজি অন্তর্ধানের পর, ২৩ জানুয়ারিতে যত শো করেছেন, প্রত্যেক বারই তা শুরু হয়েছে ওঁর ছবিতে মালা দিয়ে। তার পর ওঁকে নিয়ে আলোচনাসভা। সভা শেষ হলে তবে নাটক।

এত যে পড়তেন, লিখতেন কিন্তু খুব কম। বলতেন, ‘‘কেউ সাহিত্য লেখে, কেউ সাহিত্য বলে। আমি দ্বিতীয় ধাতে পড়ি।’’

ঠাকুরদা ছবি তোলার ব্যাপারে ছিলেন খুব লাজুক। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ ছবি তোলা পরিমল গোস্বামীর। ব্যতিক্রম, জীবনের শেষ ছবিটি। চিরাচরিত পাঞ্জাবি গায়ে ঠাকুরদা ক্যামেরার মুখোমুখি, ছবিটি তুলেছিলেন দীপঙ্কর সেন। ওঁর দাদা অশোক সেন ছিলেন ঠাকুরদার প্রান্তবেলার কাছের মানুষ। অশোকবাবু প্রায়ই আসতেন ঠাকুরদার কাছে। ওঁদের আলাপ জুড়ে থাকত ইউরোপীয় নাটক, তার রঙ্গালয়, কলাকুশলী ইত্যাদি।

’৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঠাকুরদার যখন ছানি অপারেশন হল, তখন আমার বাবা আমাদের নিয়ে বিডন স্ট্রিটে। শিবু বিশ্বাস লেনে। ঠাকুরদা এসে উঠলেন আমাদের কাছে। চলাফেরায় তখন খুব শ্লথ হয়ে গিয়েছেন।

মার্চ মাসে সুস্থ হয়ে তবে ফিরে গেলেন বি টি রোডের বাড়ি। কিন্তু এর পর থেকেই শরীর ভাঙছিল। বয়স তেমন নয়, সত্তর। কিন্তু তখনই পাড় ভাঙার শব্দটা টের পাচ্ছিল বাড়ির অনেকেই। জুনের ৩০, ঠাকুরদা চলে গেলেন রাতবিরেতে। সেই ভোরে কলকাতার একটি কাগজে খবরটা দেখে গোটা শহর যেন ছুটে এল বরাহনগরে!

দিনটা খুব মনে পড়ে। বি টি রোডে থিকথিক করছে লোক । ব্যারিকেড করেও সামাল দিতে হিমশিম পুলিশ। তার মধ্যেই কোনওক্রমে বি টি রোডে ঠাকুরদাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রতনবাবুর মহাশ্মশানে... ভেজা চোখে এক মহাজীবনের শেষ দৃশ্য দেখছে তাঁর ভক্তকুল...

ছবি: পরিমল গোস্বামী

অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Sisir Bhaduri Actor Theatre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy