Advertisement
E-Paper

‘স্যর’ রাহুল

ব্যাটিংয়ের সময় তাঁর ওপর ভারত ভরসা করলেও, প্রচারের আলো থাকত অন্য কারওর ওপর। করুণ নায়ার-লোকেশ রাহুলের সাফল্যের পরেও ছবিটা বদলায়নি। নীরবে আজও ভারতীয় ক্রিকেটের সেবা করে চলেছেন ‘কোচ’ রাহুল দ্রাবিড়। লিখছেন সায়ন আচার্যব্যাটিংয়ের সময় তাঁর ওপর ভারত ভরসা করলেও, প্রচারের আলো থাকত অন্য কারওর ওপর। করুণ নায়ার-লোকেশ রাহুলের সাফল্যের পরেও ছবিটা বদলায়নি। নীরবে আজও ভারতীয় ক্রিকেটের সেবা করে চলেছেন ‘কোচ’ রাহুল দ্রাবিড়। লিখছেন সায়ন আচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০

কারও সঙ্গে কথা বলেননি।

প্যাড আর গ্লাভস পরে মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামের এক কোণে থমথমে মুখে বসেছিলেন কর্নাটকের এক তরুণ।

করুণ নায়ার।

তত দিনে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়ে গিয়েছে। প্রথম মরসুমে বেশ কিছু ভাল ইনিংসও খেলেছেন। তবু প্র্যাকটিস ম্যাচে তাঁর ব্যাটিং নিয়ে খুশি হননি ‘নতুন কোচ’।

টি টোয়েন্টিতে সাত নম্বরে নেমে আঠেরো বলে বত্রিশ রানের ইনিংস খেলার পরেও শুনতে হয়েছে বকুনি। বেশ কড়া ভাষাতেই বলেছেন, ‘‘অসতর্ক হয়ে খেললে এই টিমে তোমার জায়গা হবে না।’’

অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাজস্থান রয়্যালস-য়ে খেলতে আসা করুণ যখন প্রায় নিশ্চিত যে, সেই আইপিএল-য়ে তিনি দলের বাইরেই থাকছেন, হঠাৎ পিঠে ছোট্ট একটা টোকা।

থমথমে মুখে করুণ পিছনে তাকিয়ে দেখেন, দাঁড়িয়ে তাঁর ‘নতুন কোচ’, এই একটু আগে যিনি প্রচণ্ড বকেছিলেন খারাপ শট খেলার জন্য।

ভদ্রলোকের নাম, রাহুল দ্রাবিড়!

প্র্যাকটিস ম্যাচের পর, ২০১৪-র মার্চের সেই দুপুরে করুণকে নিয়ে অবশ্য আবার নেটে হাজির হয়েছিলেন দ্রাবিড়। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করেও চলেছিল প্রায় ঘণ্টাখানেকের স্পেশ্যাল ট্রেনিং। কিছু খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলতে বলতে ‘নতুন কোচ’ তাঁর ছাত্রকে বলেছিলেন, ‘‘এত ভেঙে পড়লে চলে? বকুনি না খেলে তুমি তো ভাল ক্রিকেটারই হতে পারবে না...’’

কথাগুলো শুনে মৃদু হেসেছিলেন করুণ। কথা দিয়েছিলেন, ভুল শটে আর কোনও দিন নিজের উইকেট ছুড়ে দেবেন না। সেই বছর আইপিএলে সাত নম্বর থেকে সোজা ওপেনিং-য়ে উত্তরণ হয় করুণের। এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রেখে ক্রিকেট বোদ্ধাদের নজরে পড়েন রাজস্থান রয়্যালসের ব্যাটসম্যান।

কাট টু ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬।

চেন্নাইয়ের চিপকে জীবনের তৃতীয় টেস্টেই ৩০৩! তাও আবার নট আউট। টিম হোটেলে পৌঁছে, পঁচিশ বছরের করুণ আবিষ্কার করলেন, তাঁর ফোনের ইনবক্সে হাজির একটা এসএমএস। দুটো শব্দ লেখা শুধু, “ওয়েল ডান”।

প্রেরক রাহুল দ্রাবিড়!

অবশ্য, করুণ একা নন। এই মুহূর্তে ক্রিকেট মহলে ঢুঁ মারলেই এ রকম আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে। দেশের যে কোনও প্রান্তে কোনও নতুন ক্রিকেটার ভাল খেললেই নাকি তাঁর ফোনে পৌঁছে যায়, অনূর্ধ্ব উনিশ ও জাতীয় ‘এ’ দলের কোচ দ্রাবিড়ের উৎসাহ বার্তা।

টিভিতে যাঁর খেলা দেখে বড় হয়েছেন, সেই সুপারস্টার দ্রাবিড় যে তাঁদের সঙ্গে কোনও দিন বন্ধুর মতো মিশবেন তা কল্পনাও করতে পারেননি করুণ, লোকেশ রাহুল, জয়ন্ত যাদব, সঞ্জু স্যামসন কিংবা ঋষভ পন্থরা।

অথচ, বিগত কয়েক বছরে সেই ‘স্যর’-ই নিজের সুপারস্টার ইমেজ সরিয়ে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুনিয়রদের নিয়ে নেটে পড়ে থেকেছেন! শট সিলেকশন ভুল হলে কখনও ছেলেদের কড়া ভাষায় বকেছেন, আবার ঢাকায় অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারার পর, প্রত্যেক ভারতীয় ক্রিকেটারের ঘরে গিয়ে জুগিয়েছেন আত্মবিশ্বাস। “একবারের জন্যও রাহুল স্যর বুঝতে দেন না যে, আমরা ওঁর থেকে এত জুনিয়র। যে কোনও পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করাটা উনিই শিখিয়েছেন,” বলছিলেন অনূর্ধ্ব উনিশ দলের অধিনায়ক ঈশান কিষাণ।

এবং, সেই কারণেই ইয়ং ব্রিগেডের কাছে এত জনপ্রিয় দ্রাবিড়। না হলে কেনই বা, তিনশো তিনের ইনিংস খেলার পর করুণ বলবেন, “রাহুল স্যর না থাকলে এত দূর আসা যেত না…”

অনূর্ধ্ব উনিশ ও ‘এ’ দলটাই ভারতীয় ক্রিকেটের মূল সাপ্লাই লাইন। রাহুল আবার সেই প্লেয়ার তোলার প্রসেসটা চালু করেছে

এমএসকে প্রসাদ (জাতীয় নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান)

কোচ নয়, বন্ধু

৯১ রান। সাত উইকেট।

তবু ব্রিসবেনে সেপ্টেম্বরের সেই সন্ধেয় বিষণ্ণ মুখে ‘রাহুল স্যর’-য়ের ঘরে হাজির হয়েছিলেন জয়ন্ত যাদব। অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের বিরুদ্ধে সিরিজ শেষে জানতে চেয়েছিলেন, কী ভাবে আরও উন্নতি করা যায়।

ছাত্রের সমস্যা শুনে কোচ বলেছিলেন, “যা করছ সেটাই করে যাও। বাড়তি কিছুর দরকার নেই…”

এবং, ঠিক তিন মাস পর মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে দিন ১০৪ রানের ইনিংসটা খেললেন জয়ন্ত, হোটেলে ফিরেই ফোন করেছিলেন দ্রাবিড়কে। ধন্যবাদ জানাতে। পুরোনো বন্ধুর কোচিং দেখতে ‘এ’ দলের সঙ্গে সেপ্টেম্বরে সেই সফরে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন জাতীয় নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান এমএসকে প্রসাদ। দ্রাবিড়ের সঙ্গে যাদব, করুণ নায়ার, হার্দিক পান্ডিয়ার মতো প্লেয়ারদের বোঝাপড়া দেখে মুগ্ধ তিনিও। ‘‘ম্যাচের পরও প্রত্যেক প্লেয়ারের সঙ্গে আলাদা করে সময় কাটায় রাহুল। জুনিয়রদের ভরসা দিতে পেরেছে ও,’’ চেন্নাই থেকে পত্রিকাকে বলছিলেন প্রসাদ।

সেই জন্যই বোধহয় প্রথমে ব্যর্থ হয়েও করুণ, জয়ন্ত, রাহুল-রা নিজেদের প্রমাণ করেছেন ইংল্যান্ড সিরিজে। এবং প্রসাদ মনে করেন, এ়টাই রাহুলের সাফল্য।

“অনূর্ধ্ব উনিশ দলটাই ভারতীয় ক্রিকেটের মূল সাপ্লাই লাইন। রাহুল আবার সেই প্লেয়ার তোলার প্রসেসটা চালু করেছে। এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না,” বলছিলেন প্রসাদ, যিনি সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন ভারতীয় বোর্ডকেও। কারণ, আগে ‘এ’ দলের কোনও নির্দিষ্ট কোচ থাকতেন না। সিরিজ শুরুর আগে কাউকে একটা জুড়ে দেওয়া হতো।

কিন্তু ছবিটা পাল্টায় গত বছর জুলাইতে, যখন দ্রাবিড়কে ‘এ’ দল ও অনূর্ধ্ব উনিশের দায়িত্ব দেয় বোর্ড।

‘‘রাহুল আসার পর অবস্থাটা দেখুন। একের পর এক ট্যালেন্ট উঠে আসছে। টিম ইন্ডিয়া কোচ অনিল কুম্বলে ও রাহুল পুরোনো বন্ধু। তাই টিম-য়ের ব্যাপারে আলোচনা করে এগোতে পারে। এর ফলে আসলে লাভবান হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট,” বলছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান।

তবে, টিম ইন্ডিয়ার প্রাক্তন মেন্টাল কোচ প্যাডি আপটন মনে করেন, মূল সাপ্লাই লাইন তৈরির কাজটা রাহুল শুরু করেছিলেন ২০১২ সালে রাজস্থান রয়্যালসের ক্যাপ্টেন-মেন্টর হিসাবে। ‘‘কোচিংয়ে আসার পর অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটারই মনে করে যে, তারা সব কিছু জানে। কিন্তু রাহুল সব সময়ই উত্তর খোঁজে। নাক-উঁচু না হয়ে, জুনিয়রদের থেকেও নতুন কিছু শিখতে রাজি ও,’’ বলছিলেন আপটন, যিনি বর্তমানে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-য়ের কোচ ও দ্রাবিড়ের সহকর্মী।

রাজস্থান রয়্যালসের সময় থেকে, আপটন-দ্রাবিড় জুটি তুলে এনেছেন অজিঙ্ক রাহানে, করুণ নায়ারদের মতো প্লেয়ারদের, যাঁরা আজ অবাক করছেন ক্রিকেট দুনিয়াকে!

কোচিংয়ে আসার পর অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটারই মনে করে যে, তারা সব কিছু জানে। কিন্তু রাহুল জুনিয়রদের থেকেও নতুন কিছু শিখতে রাজি

প্যাডি আপটন (দিল্লি ডেয়ারডেভিলস কোচ)

সবার কথা শোনো

এত কিছুর মাঝেও কম ঝামেলা অবশ্য পোহাতে হয়নি দ্রাবিড়কে। বছর তিনেক আগে আইপিএল শুরুর আগে জয়পুরের ক্যাম্পে দ্রাবিড়কে হঠাৎ ‘আপনি কিস্যু বোঝেন না’, বলে ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সঞ্জু স্যামসন। দ্রাবিড়ের সঙ্গে তুমুল তর্ক করেছিলেন নিজের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে। রাহুল সেই প্রস্তাব না মানতেই, কেরলের উদীয়মান উইকেটকিপারের এ হেন বিস্ফোরণ।

সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছে সংঘাত আসন্ন, ড্রেসিং রুমের বাইরে গিয়ে সঞ্জুকে বোঝালেন রাহুল স্বয়ং। বললেন, “তোমাকে দু নম্বরে পাঠাব। কিন্তু রান করতে হবে। না হলে অন্য কেউ যাবে তোমার জায়গায়।”

চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন সঞ্জু।

এবং, সেই আইপিএলের সেরা আবিষ্কারের নামই ছিল সঞ্জু স্যামসন।

“রাহুল এ রকমই। জুনিয়র প্লেয়ারকে সব সময় সুযোগ দিতে রাজি। প্রতি মুহূর্তে প্লেয়ারদের চ্যালেঞ্জ ছুড়তে প্রস্তুত। ও সবার কথা শুনবে, তার পর নিজের সিদ্ধান্ত জানাবে। এ রকম সিস্টেম ভারতীয় ক্রিকেটে দেখাই যায় না,” সেই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পত্রিকা-কে বলছিলেন জাতীয় দলের প্রাক্তন ফিজিও জন গ্লস্টার। এই একই পদ্ধতি ‘রাহুল স্যর’ অনুকরণ করেছেন জাতীয় ‘এ’ দলেও। কোনও প্লেয়ারের খারাপ ফর্ম থাকলে, তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় অদল-বদল করেছেন, যতক্ষণ না সে ফর্মে ফেরে।

অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপের সময় বেশ কয়েকটা ম্যাচে রান পাননি অধিনায়ক ঈশান কিষাণ। হঠাৎ ডেকে পাঠালেন দ্রাবিড়, জানতে চাইলেন কী সমস্যা হচ্ছে। “আমার লাইন লেংথ বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। স্যর সব শুনে বললেন, ফুটওয়ার্কটা ঠিক করলেই হবে। তার পর আস্তে আস্তে রানে ফিরি,” মুচকি হেসে বলছিলেন ঈশান।

শুধু মাঠের পারফরম্যান্স নয়। প্রত্যেক প্লেয়ারের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরেও যোগাযোগ রাখেন দ্রাবিড়। ক্রিকেট মহলে অনেকে বলেন, প্লেয়ারদের গার্লফ্রেন্ডের নামও নাকি জানেন ‘রাহুল স্যর’!

গ্লস্টার, আপটন মনে করেন ভারতীয় ক্রিকেটে ‘ক্যাচ দেম ইয়ং’ মন্ত্র যদি চালু করে থাকেন গ্রেগ চ্যাপেল নামক অস্ট্রেলীয়, সেই মন্ত্র সার্থকতা পেয়েছে রাহুলের হাত ধরেই।

তবে নিঃশব্দে। ক্রিকেট কেরিয়ারের মতো এই নতুন উইকেটেও ‘দ্য ওয়াল’ প্রচারবিমুখ। ‘‘জুনিয়র ক্রিকেটাররা যখন ইচ্ছে ওর কাছে পৌঁছে যেতে পারে। এটাই তো আসল কোচিং,’’ বলছিলেন আপটন।

ক্রীড়া মহলে ইদানীং একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘দেশে এখন দু’জন পারফর্মিং কোচ। রাহুল আর পুলেল্লা গোপীচন্দ।’ তবে গোপীচন্দ যেমন পিভি সিন্ধু, কিদাম্বী শ্রীকান্তদের কঠোর অনুশাসনে রাখতে পছন্দ করেন, রাহুল এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী। টিম হোটেলে মধ্যরাতে করুণ নায়ারের সঙ্গে টেবল টেনিস খেলতে নামেন, তো কখনও সরফরাজ খানকে নিয়ে যান প্রাতঃভ্রমণে। এতে প্লেয়ারের কনফিডেন্স বাড়ে, তৈরি হয় টিম বন্ডিং। সাধে কি আর ছাত্ররা আজকাল তাঁকে আড়ালে ‘দোস্ত’ বলে ডাকে!

Rahul Dravid
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy