Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
art exhibition

রাজনীতি, প্রেম, বিষাদ, যুদ্ধ ও গণহত্যার রঙিন ক্যানভাস

পেন্টিং, ড্রয়িংয়ে মহাভারতের প্রতিফলন? এই মহাকাব্য ভারতীয় বরেণ্য শিল্পীদের নির্মাণে বহু কাল থেকেই বিধৃত।

মহাকাব্যিক: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘মহাভারত’ প্রদর্শনীর একটি কাজ

মহাকাব্যিক: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘মহাভারত’ প্রদর্শনীর একটি কাজ

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:১২
Share: Save:

মহাভারতের ছবি অতি সুমহান/ চার চিত্রী এঁকেছেন, দেখে পুণ্যবান।

শ্রবণ ও পঠনে মহাভারত এক রকম। যার কেন্দ্রে এত বৈচিত্র, এত রক্ত, অশ্রু, হিংসা, যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটকৌশল, যন্ত্রণা, ক্রোধ, মৃত্যু, প্রেম, ভালবাসা, ক্রূরতা, উন্মাদনা... কী নেই মহাভারতে? ‘মহাভারত না পড়িলে আমাদের দেশের কাহারো শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না’ —বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কিন্তু পেন্টিং, ড্রয়িংয়ে মহাভারতের প্রতিফলন? এই মহাকাব্য ভারতীয় বরেণ্য শিল্পীদের নির্মাণে বহু কাল থেকেই বিধৃত। সম্প্রতি কলকাতা নতুন ভাবে দর্শন করল চার জন সমকালীন শিল্পীর ক্যানভাসে মহাভারতের আশ্চর্য সব আখ্যানপর্বের কুশলী চিত্রকলা। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্পন্ন হল আদিত্য বসাক, জয়া গঙ্গোপাধ্যায়, সমীর আইচ ও চন্দ্র ভট্টাচার্যের মোট ১৮টি বড় ক্যানভাসে ‘মহাভারত’ প্রদর্শনী। সবই অ্যাক্রিলিক। তা ছাড়া কন্টি, টেম্পারা, সিল্ক স্ক্রিন বা রাইস পেপারও প্রয়োজন মাফিক ব্যবহৃত।

কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য গত এক বছর ধরেই মহাভারত নিয়ে একটি বিরাট প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেন। এক বছর শিল্পীরা নানা ভাবে তাঁদের ভাবনাকে দ্বিমাত্রিক পটে কী ভাবে রং-রেখায় আখ্যায়িত করবেন, এই নিয়ে নিরন্তর অনুশীলন করেন, তার প্রত্যক্ষ রূপই এই প্রদর্শনী।

নিজস্ব ঘরানাকে সামলে, সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মহাকাব্যকে তাঁরা খুব সিরিয়াস ভাবেই বড় ক্যানভাসের প্রেক্ষাপটে তৈরি করেছিলেন। দৃশ্যকল্প তাই কারও কাজে কখনও রংহীন, কখনও ধূসর যন্ত্রণার আবহে দীর্ণ, কখনও মৃত্যু-পরবর্তী ভয়াবহতার এক নৈঃশব্দ্যের মেদুরতা। কাহিনিনির্ভর চিত্র দ্বিমাত্রিকতার বিরাট পরিসরে অনেক ক্ষেত্রে সচিত্রকরণের দিকে চলে যায়। পেন্টিং কোয়ালিটিকে পূর্ণ মাত্রায় একটি ধারাবাহিক চিত্রায়ণের মধ্যে রেখে কম্পোজ়িশন ও অ্যারেঞ্জমেন্ট, ব্যালান্স ও স্পেস ডিভিশন, সলিড কালার ও টোনাল ভেরিয়েশন, ক্যারেক্টার ও ড্রয়িংকে অতি সচেতনতায় রক্ষা করতে হয়। চার জনই এই দিকগুলিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন।

আদিত্য বসাকের ভাবনায় মহাভারত এক কথায় ভয়াবহতার আশ্চর্য নিদর্শন। কূটনীতির যুক্তিজাল তাঁকে ভাবিয়েছে। মৃত্যুচেতনায় আচ্ছন্ন আদিত্য কিন্তু তাঁর ক্যানভাসে ওই ভয়াবহ যন্ত্রণাকেই বিধৃত করেছেন। পটে কালো রংকে তিনি এতটা অংশে ব্যবহার করেছেন যে— শোক, নৈঃশব্দ্য, যন্ত্রণা, যুদ্ধোন্মাদনা ও মৃত্যুর প্রত্যক্ষ রূপকে তিনি গভীর এক রূপকে পরিণত করেছেন। কালোকে আশ্রয় করা সাদা, খয়েরি, হলদে, লাল, কমলার মেলানো-মেশানো প্রয়োজনীয়তার মধ্যে আরোপিত চরিত্ররা ভয়ঙ্কর নীরব হয়েও বাঙ্ময়। ‘এন্ড অব ওয়র’-এর এক পাশে স্তূপীকৃত অসংখ্য নর-করোটি, গোটা আকাশের ধূসরতা খানখান করা প্রচুর চিল-শকুনের ওড়াউড়ি, অন্য পাশে একা চোখ বাঁধা কালো পোশাকের গান্ধারী—ছবিতে এই মৃত্যু ও যুদ্ধোন্মাদনার রূপটি যুদ্ধ শেষের মারাত্মক শোকাচ্ছন্নতাকেই প্রকাশ করে। সমকালীনতার প্রেক্ষিতে এক দিকে শতপুত্র হারানো মা, অন্য ছবিতে আবার আধুনিক অনুষঙ্গ-নির্ভর ‘ওয়ারিয়র ওয়ান/টু’ এবং ‘ওথ’। এখানে যুদ্ধোন্মাদের বুকে জ্বলছে জতুগৃহ, উপরে অশুভ মুখ। ‘ওথ’-এ আকাশে জেট প্লেন। রতন থিয়ামের নাটক ‘দ্রৌপদী’ আদিত্যকে এক সময়ে আচ্ছন্ন করেছিল। সেই ভিসুয়াল, নৃত্যশৈলী, পোশাক ও উজ্জ্বল সব রং যেন অবচেতনে ছিল তাঁর। যন্ত্রণার অসাধারণ চিত্রাবলি।

জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্টাইলাইজ়েশন-টেকনিকে এখানে গান্ধারীর মাতৃযন্ত্রণা, ভীষ্মের শরশয্যার আধুনিক রূপারোপ, পাশা খেলা, কৃষ্ণের পক্ষপাতিত্বের ভাবনা, পরিস্ফুট। স্পেসকে প্রাধান্য দিয়েছেন অনেকটা। প্রতীকী ছবি। লালের ব্যবহার অসাধারণ।

অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার নাটকীয় আবহে, আলো-আঁধারি রহস্যের প্রতিমাকল্প অলৌকিক। সাদা-কালোয় অসাধারণ মুহূর্ত সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র ভট্টাচার্য। মহাভারতের পুরাণকল্প তাঁর কাছে প্রায় অস্পষ্ট, তাই তিনি বর্ণের আশ্রয় নেননি। অন্ধকার শূন্যে ভেসে থাকা সাদা ভীষ্মের শরশয্যা অসাধারণ রচনা। প্রেক্ষাপটে চরিত্ররা প্রখর। অনুষঙ্গের প্রতীকী ব্যবহার ও সমকালীন বাস্তবতায় হত্যাদৃশ্যের নীরব ভাষ্য রচনা করছে যেন! দ্রৌপদীর একলা যন্ত্রণাও বিমোহিত করে।

এক্সপেরিমেন্ট, ট্রিটমেন্ট, স্টাইল ও ভিন্ন জ্যামিতিক বিন্যাসের আধুনিকীকরণকে গূঢ় ড্রয়িংয়ের বাস্তবতায় সমীর আইচ নিয়ে গিয়েছেন সমকালীন আঘাতজর্জরিত রণক্ষেত্রের মাঝখানে। সমকালীন অস্থিরতার সামাজিক রূপকে তিনি নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখিয়েছেন। কুরুক্ষেত্রে যেন নিজেই তিনি এক ও অদ্বিতীয়। চশমা, বৈদ্যুতিক প্লাগ ইত্যাদি প্রতীকী ব্যবহারে দেখিয়েছেন বর্তমানকে।

চক্রব্যূহের লাল ঘোড়া, কুরুক্ষেত্রের অনন্ত যুদ্ধ বা রথের চাকা হাতে যুদ্ধোন্মাদ নীল মানব তাঁর আশ্চর্য রচনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art Exhibition Mahabharata মহাভারত
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE