তা হলে কি ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে কখনও খেলেননি গোষ্ঠ পাল? উপরের কাহিনিটা শোনার পরে প্রশ্নটা করা গেল গোষ্ঠ-পুত্র নীরাংশুবাবুকে। তাঁর মুখে পরবর্তী ঘটনাটাও জানা গেল। গোষ্ঠ পাল ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছিলেন, আবার খেলেনওনি!
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তখন কুমোরটুলি, শ্যামপার্কে ছোট ছোট প্রতিযোগিতা খেলত। ওই সময়ে গোষ্ঠ পাল ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু... এখানে একটা বড় ‘কিন্তু’ আছে! ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তখনও ভারতীয় ফুটবল সংস্থায় (আইএফএ) নাম নথিভুক্ত করায়নি। যে কারণে হয়তো পরবর্তী কালে গোষ্ঠ পাল ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে কোনও দিন খেলেননি। ‘‘তবে ইস্টবেঙ্গল ওদের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে বাবার নামই বলে,’’ বলছিলেন নীরাংশুবাবু, ‘‘আমি রাজস্থানের হয়ে খেলার সময়ে এক বার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ঢুকে বাবার ছবি টাঙানো দেখেছিলাম। যেখানে লেখা ছিল, ইস্টবেঙ্গলের প্রথম অধিনায়ক।’’
(৬)
মোহনবাগান ও গোষ্ঠ পাল নামটা প্রায় সমার্থক হয়ে যাওয়ার পিছনে নানা কারণ ছিল। হয়তো গোষ্ঠবাবু মোহনবাগানের হয়ে কোনও বড় ট্রোফি জিততে পারেননি, কিন্তু ক্লাবকে তিনি ঐতিহ্যের চুড়োয় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ব্রিটিশরা তখন রীতিমতো সমীহ করত ভারতের এই দলটিকে। ১৯১৩ সালে মোহনবাগান ক্লাবে যোগ দেওয়ার দু’বছরের মধ্যে ‘বি’ ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে যায় মোহনবাগান। ১৯১৫ সালে চতুর্থ এবং পরের বছরই রানার-আপ হয়। ওই সময় থেকে ধীরে ধীরে ১৯১১ সালের শিল্ডজয়ী তারকারা সরে যেতে থাকেন ময়দান থেকে। যার ফলে ১৯২১ সালে মোহনবাগানকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে গোষ্ঠবাবুর উপরে। সেই দায়িত্ব সামলেছিলেন পরের পাঁচ বছর। গোষ্ঠবাবুর নেতৃত্বে আরও এক বার কলকাতা লিগ জেতার খুব কাছে এসেও রানার আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মোহনবাগানকে। ১৯২৩ সালে আবার আইএফএ শিল্ড জেতার সামনে এসে পড়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু ফাইনালে ক্যালকাটা এফসি-র কাছে হেরে যায়। সে দিন বৃষ্টিতে মাঠ খেলার প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কাদা মাঠেই গোষ্ঠ পালদের বাধ্য করা হয় খেলতে। খালি পায়ে সে দিন বুটপরা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেনি মোহনবাগান।
১৯২৩ সালে রোভার্স কাপে খেলার সুযোগ হয় মোহনবাগানের। এবং গোষ্ঠ পালের নেতৃত্বে চোখধাঁধানো ফুটবল খেলে ফাইনালে পৌঁছে যায়। কিন্তু হেরে যায় ডারহাম লাইট ইনফ্যান্ট্রির কাছে। দু’বছরের মধ্যে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড কাপে খেলার আমন্ত্রণ পায় মোহনবাগান। ১৯২৪ সালে প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় গোষ্ঠ পালের নাম, যাঁর নেতৃত্বে পরে কলম্বো সফরে যায় ফুটবল দল।
এই সময়ই গোষ্ঠ পাল থেকে জন্ম নেয় দুর্ভেদ্য ‘চিনের প্রাচীর’। যে নামে এখনও পরিচিত ভারতীয় ফুটবলের এই কিংবদন্তি। কিন্তু কী ভাবে নামকরণ হয়েছিল ‘চিনের প্রাচীর’? কলকাতা ফুটবলের আনাচকানাচে খোঁজ নিলে দুটো তত্ত্ব উঠে আসছে। এক, তাঁর খেলা দেখে ভক্তরাই একটা সময় ডাকতে শুরু করেন ওই নামে। আর অন্য তত্ত্বটা হল, রোভার্স কাপে গোষ্ঠ পালের খেলায় মুগ্ধ এক ইংরেজ সাংবাদিক বলে ফেলেছিলেন, ‘‘হি ইজ় অ্যাজ় সলিড অ্যাজ় দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না।’’ এর পরে ‘দ্য ইংলিশম্যান’ সংবাদপত্রে গোষ্ঠ পালকে তিনি ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ বলে উল্লেখ করেন। এই ফুটবলারের সঙ্গে প্রথম আলাপে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত বলে উঠেছিলেন, ‘‘তুমিই তা হলে সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল!’’
একশো বছর পার হয়ে গেলেও যে নাম একটুও ফিকে হয়ে যায়নি।
গোষ্ঠ পালের ফুটবল জীবনে দুটো অপূর্ণতা সম্ভবত থেকে গিয়েছিল। মোহনবাগানের হয়ে বড় ট্রোফি না জিততে পারা এবং তাঁর আমলে ক্লাবের লোগো বদল না হওয়া। লোগো বদলটা কী রকম? নীরাংশুবাবু শোনাচ্ছিলেন সেই কাহিনি। মোহনবাগানের প্রথম লোগো ছিল গাছের তলায় বাঘ বসা। কিন্তু ১৯১৮ সাল নাগাদ রাজস্থান ক্লাব তাদের প্রতিষ্ঠার সময়ে সেই একই লোগো ব্যবহার করে। মোহনবাগান ক্লাবের আবেদনেও সেই লোগো বদলানো হয়নি। মোহনবাগান কর্তারা তখন পালতোলা নৌকার নতুন লোগো তৈরি করেন। ঠিক হয়, একটা বড় ট্রোফি জেতার পরে লোগো বদল হবে। ‘‘বাবার আমলে সেই বড় ট্রোফি আসেনি, তাই তখন লোগোও বদল হয়নি,’’ আক্ষেপ নীরাংশুবাবুর।
(৭)
রাজনীতিবিদ অতুল্য ঘোষ এক বার বলেছিলেন, ‘‘গোষ্ঠ পাল হল, জেল না খাটা এক স্বাধীনতা সংগ্রামী।’’ কথাটা নির্ভেজাল সত্যি। গোষ্ঠ পাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন মাঠের সবুজ ঘাসে। খালি পায়ে ফুটবল খেলে তিনি ব্রিটিশদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠবাবুর লড়াই দেখতে তখন মাঠে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। গুলি না চালিয়েও তিনি ইংরেজদের ‘রক্তক্ষরণ’ ঘটাচ্ছেন, যেটা ব্রিটিশ রাজের কাছে একটা অশনি-সঙ্কেত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এর পরে শুরু হয় ছলে-বলে-কৌশলে মোহনবাগানকে নানা ভাবে আটকে দেওয়ার খেলা। যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে এসেছেন গোষ্ঠ পাল। তাঁর ফুটবল জীবনের শেষটাও হয় এক ‘অসহযোগ আন্দোলন’-এর মধ্য দিয়ে।
১৯৩৫ সাল। ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলছে মোহনবাগান। যখনই বিপক্ষ বক্সে বল নিয়ে উঠছেন মোহনবাগানের ফুটবলাররা, রেফারি বাঁশি বাজিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন। একটা সময় আর সহ্য হয়নি গোষ্ঠবাবুর। তিনি দলের সবাইকে নিয়ে মাঠেই শুয়ে পড়েন এবং খেলতে অস্বীকার করেন। তৎকালীন আইএফএ কর্তারা ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেননি। তদন্ত হয় গোষ্ঠ পালের বিরুদ্ধে। এর পরে সেই বছরেই যবনিকা নেমে আসে এই কিংবদন্তির ফুটবল জীবনে। এরও আগে ১৯৩৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দলকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল গোষ্ঠবাবুর। সেখানেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে শামিল
হন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সরকারি কারণ ছিল, চোট পেয়েছিলেন তিনি।
গোষ্ঠবাবুর জনপ্রিয়তা কতটা সুদূরপ্রসারিত ছিল, তা একটা ঘটনাতেই বোঝা যায়। তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। ১৯৪৮ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় আসছেন গোষ্ঠ বাবুর মা নবীন কিশোরী। গোয়ালন্দয় তাঁকে আটকায় পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ। বৃদ্ধার প্রতি কোনও সহানুভূতি না দেখিয়ে তারা সুটকেসের তালা ভেঙে ভিতরের জিনিস ঘাঁটতে শুরু করে। তখন হঠাৎ এক অফিসারের চোখ পড়ে একটি ছবির উপরে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেন, ছবির ওই লোকটি আপনার কে হয়? বৃদ্ধা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘আমার পোলা। ওর কাছেই তো যাচ্ছি।’’ শোনার পরে ওই অফিসার নতুন তালা কিনে সুটকেসে লাগান। নিজে এসে নবীন কিশোরী দেবীকে ট্রেনের জানালার পাশে বসিয়ে দিয়ে যান। পরে ছেলেকে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, তুই করস কী?’’ গোষ্ঠবাবু উত্তর দেন, ‘‘কিসুই না। শুধু বল লাথাই।’’ এই বল লাথিয়েই কিন্তু ইংরেজদের হৃৎকম্প ধরিয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল।
(৮)
গোষ্ঠবাবু শুধু ফুটবলেই নয়, ক্রিকেট, হকি, টেনিসেও সমান দাপট দেখিয়েছিলেন। মোহনবাগানের হকি, ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন। এক বার ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছেন। পরেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রথমে বিপক্ষ দল কোনও আপত্তি জানায়নি। কিন্তু গোষ্ঠবাবু এক ওভারে দু’উইকেট নেওয়ার পরে ঝামেলা শুরু হয়। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়রা জানিয়ে দেন, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গোষ্ঠ পালকে ক্রিকেট খেলতে দেওয়া যাবে না। মোহনবাগানও মাঠ ছেড়ে উঠে যায়। শুধু সেই ম্যাচেই নয়, তার পরে বছর ছয়েক খেলা বন্ধ ছিল দু’দলের মধ্যে।
১৯৬২ সালে প্রথম ফুটবলার হিসেবে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান গোষ্ঠ পাল। সেই পুরস্কার নেওয়ার সময়ে গলাবন্ধ কোট পরতে হত। সেটা জানার পরে গোষ্ঠ পাল রাষ্ট্রপতির আপ্তসহায়ককে চিঠি লিখে জানান, তাঁর পক্ষে গলাবন্ধ কোট পরে পুরস্কার নিতে আসা সম্ভব নয়। যে চিঠির জবাবে আপ্তসহায়ক লেখেন, ‘‘আপনি যে পোশাক পরেই আসবেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাতেই খুশি হবেন।’’
খেলাধুলোর গণ্ডিতেই শুধু আবদ্ধ থাকেননি গোষ্ঠ পাল। একটি সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। সিনেমার নাম ছিল ‘গৌরীশঙ্কর’। হঠাৎ কেন সিনেমা করার সিদ্ধান্ত? নীরাংশুবাবু বলছিলেন, ‘‘বাবার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ওই সিনেমার পরিচালক বাবার বন্ধু ছিলেন। উনি অনুরোধ করায়, বাবা রাজি হয়ে যান।’’
(৯)
১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল। ‘ফুটবল দেবতা’ সে দিন তলিয়ে গিয়েছিলেন চিরঘুমের গভীরে। মোহনবাগানের জার্সি ও পতাকায় মোড়া তাঁর শবদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে আসা হয়, নিমতলা ঘাটে মানুষের ঢল নেমেছিল। চিতায় শায়িত দেহ ধীরে ধীরে আগুনের গ্রাসে চলে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! পা দুটো তো পুড়ছে না। আর এক কিংবদন্তি ফুটবলার শৈলেন মান্না সে দিন শ্মশানে দাঁড়িয়ে গোষ্ঠবাবুর ছেলেকে বলেছিলেন, ‘‘এ হল গোষ্ঠদার পা। এ কি সহজে পুড়বে!’’
তাঁর নামে ডাকটিকিট বেরিয়েছে, রাস্তার নামকরণ হয়েছে। কিন্তু পরিবারের একটা আক্ষেপ এখনও যায়নি। নীরাংশুবাবুর আবেদন, ‘‘বাবার অনেক পুরস্কার-স্মারক আমি মোহনবাগান ক্লাবের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে অনেক কিছুই আর পাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলো যদি ফিরে পেতাম!’’
ইডেন গার্ডেন্সের উল্টো দিকে চোখ পড়লে দেখা যাবে তাঁর মূর্তিটা। সুবিশাল চেহারা, ৪৮ ইঞ্চি বুকের ছাতি। পায়ের পেশি দেখে চমকে উঠতেন প্রতিপক্ষ দলের ফুটবলারেরা। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বল নিয়ে। খালি পায়ে যিনি লড়ে গিয়েছিলেন সে যুগের বুটপরা ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিরুদ্ধে। লড়েছিলেন স্বজাতির হয়ে। জাতীয়তাবোধের মশাল জ্বালিয়েছিলেন সবুজ ঘাসে।
তিনি সত্যিই মাঠের দেবতা। দুর্ভেদ্য ‘চিনের প্রাচীর’। গোষ্ঠ পাল।
তথ্য সহায়তা: পরিসংখ্যানবিদ হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়