Advertisement
E-Paper

যা কিছু আজ ব্যক্তিগত

শিল্পী তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম গুরু বিকাশ দেবনাথ। এ ছাড়াও সুষেন ঘোষ, শর্বরী রায়চৌধুরী এবং অজিত চক্রবর্তীর কাছেও শিক্ষা লাভ করেছেন শিল্পী।

রেখার আঁচড়ে: শিল্পী তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

রেখার আঁচড়ে: শিল্পী তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

শমিতা বসু

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৩১
Share
Save

দেবভাষার চিত্রলেখা চ্যারিটেবল ট্রাস্টে সম্প্রতি হয়ে গেল তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় একক প্রদর্শনী। নাম ‘অন ব্রোঞ্জ অন পেপার’। তন্ময় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাক্তনী। এখানে শিল্পরসিক দেখতে পেয়েছেন ব্রোঞ্জের কিছু ভাস্কর্য, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে শিল্পীর বেশ কিছু ড্রয়িং। ওঁর ভাস্কর্যের সঙ্গে দর্শক হয়তো কিছুটা পরিচিত। তার মধ্যে মোটামুটি সব কাজই ষাঁড়ের প্রতিকৃতি। ব্রোঞ্জের কাজ। এতে ওঁর দক্ষতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ষাঁড়ের মূর্তি গঠন করেছেন। তার পিঠের উপরে পুরুষ, কখনও বালক আবার কখনও বা নগ্ন নারীমূর্তি। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় করা এ ষাঁড় যেন শিবের নন্দীর কথা মনে করায়, যে অসীম শক্তিধর। কাঁধের উপরে কুঁজ কখনও উঁচু হতে হতে শিল্পীর হাতে শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে। সেখানে আবার এই পশুটির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা প্রকাশ পায়। তার মধ্যে যেন হিংস্রতা নেই বিন্দুমাত্র, যেন শান্ত সমাহিত। মাথা নিচু করা, বশ্যতা স্বীকার করা এক পশু। হঠাৎ একটা ভাস্কর্য চমকে দেয়, যেখানে ষাঁড়টি সামনের দু’টি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু পিছনের পা দু’টিকে আকাশে তুলে দিয়েছে। তাক লাগিয়ে দেওয়া মূর্তি। হয়তো ভাস্কর্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শিল্পী সামনের পা দু’টি স্থির রেখেছেন।

শিল্পী তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম গুরু বিকাশ দেবনাথ। এ ছাড়াও সুষেন ঘোষ, শর্বরী রায়চৌধুরী এবং অজিত চক্রবর্তীর কাছেও শিক্ষা লাভ করেছেন শিল্পী। ড্রয়িং শিখেছিলেন সুহাস রায় এবং যোগেন চৌধুরীর কাছে। প্রথম জীবনে আর্থিক কারণে টেরা কোটায় কাজ করতেন। চাকরি পাওয়ার পরে ব্রোঞ্জে কাজ শুরু করেন। তাঁর কাজে আধুনিক পাশ্চাত্য ভাস্কর্যের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ড্রয়িংয়ে কোনও রকম রং দেখতে পাওয়া গেল না। অবচেতন মনের ছবি সচেতন মন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশন করেন। ওঁর ছবিতে কোনও গল্প নেই। সমস্ত ছবিতেই তাঁর ব্যক্তিগত মনোজগতের প্রতিচ্ছবি আছে। জনৈক কবির ভাষায়, ‘যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’!

সাদা পটভূমিতে হালকা টোনে কাজ করেন শিল্পী। হয় অ্যাক্রিলিকে, নয়তো অন্য কোনও ড্রাই মিডিয়ামে। সম্ভবত সচেতন মন দিয়েই তন্ময় প্রেক্ষাপটে হালকা অথচ রকমারি টেক্সচার সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। সাদা কাগজে ড্রয়িং তিনি সচরাচর করেন না। তার‌ই উপরে দেখা যায় তাঁর অনবদ্য পেন্সিল ড্রয়িং। বহু ইমেজ বা চিত্রকল্প পাশাপাশি স্থাপন করে ছবিগুলো সৃষ্টি। এই রকম পাশাপাশি রাখার ফলে দর্শকের মনে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে বাধ্য। এর মধ্যে গাধা খুব বেশি করে ফিরে ফিরে আসে। হয়তো শিল্পীর প্রিয় পশু। প্রথম জীবন কেটেছে বাঁকুড়ায় গ্রামেগঞ্জে। কাজেই ছবিতে গাছপালা, ফুল, কুকুর, মুরগি, হাঁস এ সবের আধিপত্য। তার পরে ছাত্রজীবনে কলাভবনে থাকার সময়ে সাইকেলে এক গ্ৰাম থেকে অন্য গ্ৰামে যাতায়াত এবং যার ফলে পারিপার্শ্বিকের বেশ কিছু প্রতিচ্ছবি উঠে আসে। কলাগাছ, পুকুর, ঘাট, বাড়িঘর, উড়োজাহাজ... ইত্যাদির উপস্থিতি তাঁর ছবিতে।

তন্ময়ের ছবির প্রোটাগনিস্ট বা মুখ্য চরিত্রগুলো বড়ই অদ্ভুত। একটি চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সম্পর্ক যেন নাটকের সেটের অভিনেতাদের মতো। যদিও ওই ছবিগুলির প্রত্যেকটির নিজস্ব পরিচয় আছে, তবু ওরা একাকী এবং অসহায়। প্রত্যেকটি মূর্তি যেন নিজের নিজের নিঃসঙ্গতার শিকার। কিছু ছবিতে কাটা হাত ছাড়াও এক আদিম নগ্নতা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা অসঙ্গত নয়, বিভীষিকাময় নয়। সেখানে কোনও আঘাত বা ক্ষত দেখা যায় না। তবে তাঁর চিত্রপটে এত সুন্দর ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে কী ফুটে উঠেছে? খুঁটিয়ে দেখলে সেখানে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত বিষণ্ণতাএবং করুণ রসের আভাস। কিন্তু যাতনা বা হিংসার প্রকাশ কোনও ছবিতেই নেই।

কোন শিল্পী তন্ময়কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন প্রশ্ন করে জানা গেল যে, তাঁর অনুপ্রেরণা শুধুই রবীন্দ্রনাথ। শিল্পে এবং লেখায় যাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভার অধিকারী বলে মনে করেন তন্ময়। তাঁর ছবিগুলি যেন সুররিয়ালিজ়মের অবচেতন মন দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য জগৎকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়। শিল্পীমনের অন্তরমহল থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত রহস্যময় জগতের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। এ যেন এক নাটকের দৃশ্য। তাঁর ছবির মুখ্য চরিত্রের পিঠে পাখির মতো সুন্দর বিস্তারিত ডানা আছে অনেক জায়গায়। মনে হয় যেন সে নিজের শরীর এবং মনের খাঁচায় আবদ্ধ এবং সেই কারণেই কিছুটা বিষাদগ্রস্ত।‌ যে রকম ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে ম্যাকবেথের স্বগতোক্তি তাঁর অদ্ভুত জটিল মানসিকতার পরিচয়বাহী। এই ছবিগুলো যেন কিছুটা সেই রকম। সেই কারণেই কি ছবিতে রং নেই? শিল্পরসিকদের তা ভাবায়।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Exhibiton Art

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}