ছবি: মোনা চৌধুরী
বাবার ইচ্ছে
ঠাকুর্দা শিবদাস ছিলেন মস্ত উকিল। বিশাল নামডাক। বাবার মতো নিজে উকিল হতে পারেননি বলে বড্ড আফসোস ছিল তারাশঙ্করের বাবা হরিদাসের। খুব ইচ্ছে ছিল ছেলে উকিল হোক।
তারাশঙ্করের বয়স যখন মোটে আট, তখন থেকেই হরিদাস ছেলেকে বলতেন, ‘‘তুমি উকিল হবে। মস্ত বড় উকিল। কাশ্মিরী শাল দিয়ে তৈরি উকিলের শামলা রেখে গেছেন আমার বাবা, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। সেই শামলা মাথায় দিয়ে কোর্টে যাবে। অল্প বয়সে তোমার সওয়াল দেখে লোকে বলবে, হবে না আবার! ওর ঠাকুরদা যে মস্ত উকিল ছিলেন।’’ তারাশঙ্করের ওই আট বছর বয়সেই হরিদাস মারা যান।
স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হবেন
খেলতেন যথেষ্ট ভাল। গ্রামে ভাল ফুটবলার হিসেবে নামও ছিল।
শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেনিস খেলাতেও ছিল সমান দাপট। কলকাতার মাঠে নিয়মিত ফুটবল ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন।
একবার প্রবল বৃষ্টির দিনে এক বন্ধুর সঙ্গে মাঠে মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে ভিড় আর পুলিশের গুঁতোয় প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফিরে এসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর মাঠে যাওয়া নয়। তবে তার পরেও গেছেন। খেলা দেখার নেশা আর ছাড়তে পারেননি।
প্রথম শ্রোতা ছিলেন তাঁর কাজের লোকটি
কলকাতায় তখন একা থাকেন। মনোহরপুকুর লেনে ছোট্ট একটা টিনের ঘর। ভোরবেলা উঠে দূরের টাইমকল থেকে জল এনে রাখতে হত। পাইস হোটেলে দু’বেলা খাওয়া সারেন। ঘরের কাজ করে দেওয়ার জন্য জুটল এক বিনি মাইনের চাকর। নাম ষষ্ঠীচরণ। তার আবার বাবুর প্রতি খুব মায়া। মাঝেমাঝে তারাশঙ্করকে সে বোঝায়, ‘‘বাবু এইসব লেখালেখি না করে একটা চাকরিবাকরি করুন।’’
শুনে মিটিমিটি হাসেন তারাশঙ্কর। বলেন, ‘‘আমি তো এ ছাড়া আর কিছু পারি না রে, ভালও লাগে না।’’
ষষ্ঠীচরণ মুখে এই কথা বললেও বাবুর লেখা গল্প শোনার খুব সাধ। এই ষষ্ঠী তারাশঙ্করের বহু গল্পের প্রথম শ্রোতা ছিল।
শুধু তাই নয়, গল্প শোনার পর যা মতামত দিত তা মন দিয়ে শুনতেন তারাশঙ্কর। এক বার বলেছিলেন, ‘‘বাংলার অতি সাধারণ মানুষদের আমরা আধুনিক লেখক-শ্রেণি যে নির্বোধ বা রসবোধহীন মনে করি, এর চেয়ে ভুল আর কিছু হয় না। যারা রামায়ণ মহাভারত বুঝতে পারে, কৃত্তিবাসী কাশীরামদাসীই শুধু নয়, গদ্য-অনুবাদ— যেগুলির ভাষায় ছাঁকা সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য এবং ভাগবতের কথকতা যারা বুঝতে পারে, তারা একালের লেখাগুলি বুঝতে পারবে না কেন? দেশের ভাষায় লেখা বিষয় যদি দেশের মানুষই না বুঝতে পারে, তবে সে কেমন লেখা?’’
স্পষ্টবাদী তারাশঙ্কর
চিরকাল স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছেন। নিজের অবস্থাকে আড়াল করেননি কোনও দিন।
বড় ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তারাশঙ্করের মনে হল, ভাবী বেয়াইকে নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে জানানো উচিত।
চিঠি লিখলেন, ‘‘আপনাদের অর্থনৈতিক অবস্থা হইতে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা-অসমৃদ্ধ। সেই হিসাবে আমি নিজ হইতেই আপনাকে সর্বাগ্রে সকল কথা খুলিয়াই জানাইতে চাই। আমার পূর্ব পুরুষেরা জমিদার ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি তাহার যাহা পাইয়াছি, তাহার বার্ষিক মুনাফা, আমার অংশে-আন্দাজ ১০০০/ ১২০০ টাকা। চাষের জমি-আমার অংশে ৭৫/৮০ বিঘা। বাগান পুকুর যাহা আছে, তাহা আপনি অবশ্যই জানেন যে-কেবল পল্লীতে ভোগের সামগ্রী, কোনও আর্থিক আয় তাহা হইতে হয় না। বর্তমানে জমিদারির অবস্থাও জানেন। আমার কর্ম্মজীবনে আমি সাহিত্যিক। ... বর্তমানে আমার আয় ৩০০/৪০০ টাকা মাসিক, ইহার অধিক নয়। তবে ইহার একটা স্থায়িত্ব আছে বলিয়া আমি মনে করি। কারণ আমার বইগুলির সংস্করণ দ্রুত শেষ হইতেছে...। কথাগুলি আমার পক্ষে লেখা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে না লিখিয়া উপায় নাই বলিয়াই লিখিতেছি।’’
থেমে গেলেন গণদেবতা
সুস্বাস্থের অধিকারী কোনও কালেই ছিলেন না। অল্পবয়েস থেকেই অনিয়ম, শরীরের ওপর অত্যাচারের কারণে মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
শেষ দিকে সংসারটি যখন সবে একটু থিতু হয়েছে তখনই ঘনঘন অসুস্থতা। রক্তচাপের ওঠানামা, চোখের দৃষ্টি কমে আসা, নার্ভের সমস্যা, পেটের সমস্যায় ভুগছিলেন খুব।
এমনকী রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকে এমনই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে ছয় বছরে ক’দিন সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন হাতে গুনে বলা যায়।
যেহেতু দেশের জন্য সব রকমের কাজ করেছেন, তাই শেষ জীবনেও কোনও কাজে ঘেন্না বলতে কিছু ছিল না। তখন পাইকপাড়ায় নিজের বাড়ি, গাড়ি সব হয়েছে তবু ওই বয়েসেও নিজেই অক্লেশে নর্দমায় দু’হাত ডুবিয়ে নোংরা পরিষ্কার করতেন।
তারপর ভাল করে হাত ধোওয়ারও বালাই ছিল না। ওই থেকেও শরীরে রোগ জীবাণু বাস বাঁধছিল।
সেদিন সন্ধে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। বড় ছেলের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বললেন অনেকক্ষণ। সারাদিনে সুস্থ মানুষটা রাতেই আচমকা আবার অসুস্থ।
ডাক্তার ছুটে এলেন। ব্রেইন ফিবার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে চারদিক। অনেক চেষ্টার পরেও আজীবন লড়াই করা গণদেবতা থেমে গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy