Advertisement
E-Paper

দেড় দিনের দৌড়

হাতে সময় কম। তবু ডাক পাঠাল পাহাড়। খোলা হাওয়ায় নীল-সবুজ-সাদা একাকার। অপার শান্তি। রিশপ, লাভা, লোলেগাঁও ছুঁয়ে এলেন সূর্য্য দত্ত   হাতে সময় কম। তবু ডাক পাঠাল পাহাড়। খোলা হাওয়ায় নীল-সবুজ-সাদা একাকার। অপার শান্তি। রিশপ, লাভা, লোলেগাঁও ছুঁয়ে এলেন সূর্য্য দত্ত  

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
টিফিনদাড়া থেকে সূর্যোদয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা

টিফিনদাড়া থেকে সূর্যোদয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা

প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে চার-পাঁচ পা চড়াই ভেঙেই থামতে হল। জাস্ট পারছি না। প্রবল শ্বাসকষ্ট, দমকে দমকে কাশি। ডিসেম্বরের পাহাড়ি ঠান্ডাতেও ডাবল জ্যাকেট, ফুল স্লিভ শার্ট, থার্মাল গেঞ্জির নীচে ঘামের স্রোত।

গাইড বলেছিলেন, ভোর সাড়ে চারটেয় রেডি থাকতে। সূর্যোদয় দেখাবেন টিফিনদাড়া ভিউ পয়েন্টে। হাতে অ্যাত্তো বড় খুকরি নিয়ে সময় মতোই তিনি হাজির। আমাদের হোটেলের ঠিক পেছনেই খাড়াই জঙ্গল। ‘আপলোগ আইয়ে’ বলে সেই জঙ্গলে তিনি তো অবলীলায় সেঁধোলেন। কিন্তু আমি কী করি!

নেমেই যদি যাই, তবে আসা কেন? সঙ্গীরা বলল, সে ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। দোটানায় শেষমেশ উঠে দাঁড়ালাম। গাইড সমানে বলে চলেছেন, ‘অউর আধা ঘণ্টা।’ যন্ত্রণা-বিরক্তি যখন চরমে, হঠাৎ দেখি গাইড থেমেছেন জঙ্গলের এক কোণে। আঙুল তুলে বলছেন, ‘‘উয়ো দেখিয়ে, থোড়া দিখ রাহা হ্যায়।’’ কখন যেন ফরসা হতে শুরু করেছে আকাশ। কাশি চাপতে চাপতে মুখ তুলে দেখলাম ‘তাকে’। আবছা, ঘুমন্ত।

রিশপের ক্যানভাস

কষ্ট উধাও ওই মুহূর্তেই। তত ক্ষণে জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে। পথ চওড়া, ঢালও কম। রোখ চেপে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই দু’ধারে গাছের দেওয়াল পেরিয়ে একটা পাহাড়ের মাথায় এসে পড়লাম। সামনে প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নস্তূপের মতো একটা কাঠামো। সিঁড়ি ভেঙে তাতে ওঠা মাত্রই নিজেকে বলতে ইচ্ছে হল— ফিরে যাচ্ছিলাম কোন আক্কেলে!

আমার সামনে এক আকাশ কাঞ্চনজঙ্ঘা! ওই তার তুষারে গড়িয়ে পড়ল সূর্যের লাল। লাল থেকে সোনালি, সোনালি থেকে রুপোলি। চেয়ে আছি তো আছিই।

লাভার বৌদ্ধ মঠ

ভোররাতের বিরক্তির সেই শুঁড়িপথ এখন আলোয় আলো। কত ফুল, ফার্ন, পরগাছা! নামার পথে রাস্তা হারালাম। তখনও দেখি, পাশে চলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। নাহ্, রিশপের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি!

সিকিম-টিকিম নয়, রিশপ আমাদেরই কালিম্পঙের এক গ্রাম। এসেছি আগের দুপুরে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গরুবাথান হয়ে (মাঝপথে ব্রেকফাস্ট ধরে) গাড়িতে ঘণ্টা চারেকের সামান্য বেশি। শেষ ৩০-৪০ মিনিট ভয়ঙ্কর খারাপ রাস্তা। ড্রাইভারবাবু জানালেন, এটা বন দফতরের এলাকা। তাদের ভয়, রাস্তা পাকা হলে গাড়ির গতি বাড়বে। ক্ষতি হবে জঙ্গলের। পথ তাই অনাদরেই। কিন্তু খাদের ধার দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে দুলতে দুলতে এই পথটুকু পেরোনোর পরেই একেবারে দৃষ্টিসুখের উল্লাস!

দোতলা ‘হোটেল সিলভান স্টে’ পুরোটাই কাঠের। টানা বারান্দা। ডান দিকে পরতে পরতে সবুজ পাহাড় আর খাদ। বাঁ দিকে, কাছে-দূরে পাহাড়ের ধাপে রংচঙে ঘরবাড়ি। আরও দূরে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটা বরফঢাকা পাহাড়চুড়ো।

তখনই মনে পড়ল, ট্যুরটা মাত্র দেড় দিনের!

সূর্য ডোবার আগেই চাপাতে হল থার্মাল ইনার। রাত বাড়লে ঠান্ডাও নাকি নেমে আসবে তিন-চার ডিগ্রিতে। সন্ধে ঘন হতে তাই কম্বলই সম্বল। রান্নাঘর থেকে আড্ডাঘরে অফুরন্ত চিকেন মোমোর সাপ্লাই। রাতের আকাশ তখন তারায় তারায় ছয়লাপ। হিমশিম নীরবতা, দূরের পাহাড়ে মিটমিটে আলো।

এরই মধ্যে টিফিনদাড়ার প্ল্যান ফাইনাল। সেই মতো ভোররাতে ওঠা। গরম জল মিলবে সকাল ৯টা থেকে ঘণ্টা দুয়েক। ঝটপট স্নান-ব্রেকফাস্ট। যাব নেওড়া ভ্যালি।

রিশপ থেকে লাভা ট্রেক করে অনেকে। আমরা গাড়িই নিলাম। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তার শেষটুকু প্রায় শুরুর মতোই বেয়াড়া। ওই এবড়োখেবড়ো পাকদণ্ডী বেয়েই অগত্যা নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানে অবতরণ।

নেওড়া ভ্যালির পথ বেয়ে

পেল্লায় উঁচু আর বুড়ো গাছ যত। রডোডেনড্রন, ওক— সবই নাকি আছে। আর আছে অর্কিড। জঙ্গলে ঢুকতে টিকিট লাগে, গাইডও। সে পর্ব চুকিয়ে হাঁটা শুরু। রাস্তা মোটামুটি সহজ। ডাইনে-বাঁয়ে অজস্র বাঁশঝাড়। কোথাও কোথাও বেশ ঘন। গাইড বলছেন, এই পথ বেয়ে ভুটানেও যাওয়া যায়। আমাদের দৌড় অবশ্য কিছুটা ওপরে একটা ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত। কপালে থাকলে নাকি রেড পান্ডা কি বিরল কাঠঠোকরাও দেখা যাবে (কিছুই দেখিনি শেষ পর্যন্ত)। কে একটা বলল, ‘‘বাঁশবনে তো বাঘও থাকে!’’ ভাগ্যিস। নেওড়া ভ্যালি আসার জঙ্গুলে রাস্তাটাতেই তো এক বার মোবাইল ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সত্যিকারের ডোরাকাটা!

পচা পাতার স্তূপ মাড়িয়ে কিছুটা চড়াই-উতরাই করে, পৌঁছনো গেল ভিউ পয়েন্টে। আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা— টিফিনদাড়ার চেয়ে একটু যেন অন্য রকম। সামনেই খাদ। খাদে আধঝোলা বুনো ফুল। আর তার পরেই ঘন জঙ্গলে ঢাকা যে পাহাড়গুলো শুরু হয়েছে, তারা সবাই যেন অদ্ভুত এক নীলচে চাদর মুড়ি দেওয়া। এ কি আকাশেরই নীল? না কি কুয়াশা? গাইড তখন বলছেন, ‘‘দূরের পাহাড়টায় তৈরি হচ্ছে সিকিমের প্রথম এয়ারপোর্ট।’’

বনপর্ব সমাপ্ত। দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম লাভার কাগিয়ু থেকচেনলিং মনাস্টেরিতে। একটু চড়াই উঠে অনেকটা জায়গা জুড়ে বৌদ্ধ মঠ। আধুনিক ক্লাসরুমে পাঠ চলছে নবীন সন্ন্যাসীদের।

মঠ থেকে বেরিয়ে লাভার বাজারেই মোমো-থুকপায় লাঞ্চ। খুচরো কেনাকাটা। রিশপে ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে চারটে। আজ আমাদের বন-ফায়ার। হইহই-গান-গল্পে আরও একটা দুরন্ত সন্ধে। তার পরে নিখাদ বাঙালি ডিনার— মাছ-ভাত-ডিম, যার যা ইচ্ছে। রান্না নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই।

পরের দিন হোটেল ছাড়লাম বেলা বারোটা বাজার আগেই। রাতে ট্রেন। ফিরছি তাই লোলেগাঁও ছুঁয়ে। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা উজিয়ে গিয়েই একটা ধাক্কা— এখানকার বিখ্যাত ঝুলন্ত সেতুটা মেরামতির জন্য আপাতত বন্ধ। খাদটাদ নয়, জঙ্গলের মধ্যেই কাঠ, তার আর দড়ির তৈরি ব্রিজে চড়ে খানিকটা শূন্যবিহারের বন্দোবস্ত। তা ব্রিজ না থাক, আঁকাবাঁকা পথ আছে! যাচ্ছিলাম সেই পথ ধরেই। আচমকা দেখি, কেউ নেই ত্রিসীমানায়!

বেশ ঠান্ডা। দু’-একটা পাখির ডাক আর অচেনা কিছু শব্দ বাদ দিলে এই ভরদুপুরেও চরাচর নিঝুম। ভয় করছে না। ভাল লাগছে নৈঃশব্দ্যের মুখোমুখি বসতে।

ডেলো বাংলোয় দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোচ্ছি যখন, রোদ পড়ে আসছে। টেনশন। ট্রেন পাব তো!

স্পিডোমিটারের কাঁটা বেশ চড়িয়ে, হেডলাইটের আলোয় গাড়ি ছুটছে শিলিগুড়ি। বোধহয় চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ চেয়ে দেখি, বাঁ দিকে তিস্তা। দুই পাহাড়ের মাঝখানে ক্ষয়াটে এক চাঁদ। চিকচিকে রুপোলি জল।

আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হল।

কীভাবে যাবেন

ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি কিংবা বিমানে বাগডোগরা। দু’জায়গা থেকেই রিশপ যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করা যাবে। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে নিউ মাল জংশনে নামলে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া হল। গাড়ি মিলবে সেখান থেকেও। এ ছাড়া লাভা পর্যন্ত শেয়ারের গাড়ি রয়েছে শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে। সে ক্ষেত্রে লাভা থেকে আবার গাড়ি।

কখন যাবেন

জুন থেকে সেপ্টেম্বর বাদে যে কোনও সময়ে। তবে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবরটা জানা থাকলেই ভাল।

কোথায় থাকবেন

রিশপ ও তার আশপাশে অনেক হোটেল আছে, হোম স্টে-ও।

Travel and Toursim Lava Lolegaon লোলেগাঁও
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy