চৈত্র মাস। শুক্লা তৃতীয়া। আজ ঝালোয়ার রাজ্যে গঙ্গৌর উৎসব। পার্বতীর কাঠের মূর্তি বহন করে বিরাট শোভাযাত্রা বার হয় রাজবাড়ি থেকে। রাস্তার দু’পাশ লোকে লোকারণ্য। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মহারাজাও আছেন। এই গৌরীপুজোয় রাজায়-প্রজায় কোনও ভেদাভেদ নেই। শোভাযাত্রা এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। উদয়শঙ্কর স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার এক ধারে। এই প্রথম সে দেখছে ঝালোয়ার রাজ্যের গঙ্গৌর উৎসব। এগিয়ে আসছে মশালবাহীরা। তাদের পিছনে ময়ূরপুচ্ছের চামর হাতে একদল মানুষ। চামরের উপর বহুমূল্য গোল আয়না বসানো। হাতির পিঠে রাজবেশে বসে আছেন মহারাজাধিরাজ ভবানী সিংহ।
তার পরে রাজবাড়ির একটা বিরাট দাঁতাল হাতি আসছে কালো পাহাড়ের মতো। হাতিটা শুঁড় তুলে আছে। আশ্চর্য চোখে উদয়শঙ্কর দেখছে সেই হাতির বড় বড় দাঁতের উপরে কাঠের একটা তক্তা পাতা। সেই তক্তার উপর নাচছেন রাজনর্তকী কুকিবাই। তাঁর পিছনে হাতির পিঠের উপরে আরও দু’জন মানুষ বসে। এক জন তবলচি, অন্য জন সারেঙ্গী বাদক। বাজনার তালে তালে রাজনর্তকী হাতির শুঁড়ের উপর আশ্চর্য দক্ষতায় ঘুরে ফিরে নেচে চলেছেন। যেন ভানুমতীর খেলা হচ্ছে উদয়শঙ্করের চোখের সামনে। গঙ্গৌর উৎসবের এই বিস্ময়কর দৃশ্যটি চিরতরে আঁকা হয়ে রইল আগামী দিনের ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের ‘নটরাজ’ উদয়শঙ্করের মনে।
উদয়শঙ্করের জন্ম ১৯০০ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজস্থানের উদয়পুর শহরে। তাঁর পিতা পণ্ডিত শ্যামশঙ্কর তখন ছিলেন উদয়পুর মহারাজার শিক্ষক। শ্যামশঙ্করের পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ শিবের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে পরিবারের সবাই তাঁদের নামের পাশে ‘শঙ্কর’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। পুরো পদবি হরচৌধুরী। যদিও আসল পদবি চট্টোপাধ্যায়।
শ্যামশঙ্করের পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। সংস্কৃত শাস্ত্রে তিনি কাশীর ধর্মমহামণ্ডল থেকে ‘পণ্ডিত’ উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অ্যানি বেসান্তের বিশেষ স্নেহের পাত্র। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও তাঁর ছিল। ছিলেন উচ্চাভিলাষী। রাজস্থানে বসবাস করার একটা মনোগত ইচ্ছা তাঁর ছিল। কারণ, সেখানে রাজা-মহারাজদের বাস। তিনি তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। উদয়পুরের মহারাজের দফতরের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন দেশ দেশান্তরে।
‘কল্পনা’-র দৃশ্য।
উদয়শঙ্করের মা হেমাঙ্গিনী ছিলেন জমিদার-কন্যা। স্বামীর প্রবাসকালে তিনি চলে যেতেন উত্তরপ্রদেশে, তাঁর বাবার বাড়ি। তাঁর বাবা অভয়চরণ চক্রবর্তী ছিলেন প্রভাবশালী জমিদার। তাঁর জমিদারি ছিল গাজিপুরের অন্তর্গত নসরতপুরে। গাজিপুর শহরে ছিল তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকা। তাঁর আরও একটি বাড়ি ছিল বারাণসীর চক অঞ্চলে। জমিদার পরিবারের খেয়াল-খুশির জীবন উদয়শঙ্করের কাছে ছোট থেকেই দৌড়ঝাঁপে ভরে থাকত। যদিও তাঁর জন্ম হয়েছিল উদয়পুরে, তাঁকে সারা বছর ধরে মায়ের সঙ্গে ছুটে বেড়াতে হত নসরতপুর, গাজিপুর, বারাণসী, আবার কখনও ঝালোয়ার। ফলে উদয়ের শৈশব একটু বেশি মাত্রায় অস্থির ছিল।
উদয়শঙ্কররা ছিলেন সাত ভাই। বড় উদয়শঙ্কর, তার পর একটি ভাই হয়ে মারা যায়। সেজ রাজেন্দ্রশঙ্কর। তার পর দেবেন্দ্র ও ভূপেন্দ্র। ভূপেন্দ্রর পর আর একটি ভাই ছিল, মাত্র ৯ মাস বয়সে সে-ও মারা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যে ভয়ঙ্কর স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দিয়েছিল বিশ্ব জুড়ে, সেই রোগ ছিনিয়ে নিয়েছিল তাকে। আদর করে হেমাঙ্গিনী তার নাম দিয়েছিলেন পুচনী। হেমাঙ্গিনীর শেষ সন্তান রবিশঙ্কর।
ছোটবেলায় উদয়শঙ্কর খুবই দুরন্ত, ডানপিটে ছিলেন। মেধাবী হলেও লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। রাজবংশের বৈভব ও পরিবেশ তাঁকে প্রাচুর্যের মধ্যে বাঁচতে শিখিয়েছিল। ফলে তিনি যা চাইতেন তা-ই পেতে অভ্যস্ত ছিলেন। কারও শাসনে বাঁচা তাঁর সহ্য হত না। এ দিকে গাজিপুরের স্কুলে তাঁর বন্ধুদের নানা বদনাম ছিল, যা শুনে হেমাঙ্গিনী এবং শ্যামশঙ্কর খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। এমনই একটা সময় গাজিপুরের ড্রয়িং মাস্টার অম্বিকাচরণ মুখোপাধ্যায়ের নজরে পড়েন উদয়শঙ্কর। তাঁর ছবি আঁকার সহজাত ক্ষমতা দেখে অম্বিকাচরণ অবাক হয়ে যান। তিনি উদয়শঙ্করের দায়িত্ব নেন। এই অম্বিকাচরণ ক্রমশ উদয়শঙ্করকে ছবি আঁকতে শেখানো, বাঁশি বাজানো, ম্যাজিক দেখানো ইত্যাদি কলাবিদ্যার দিকে ঠেলে দেন।
১৯১৬ সালে যৌবনের শুরুতে উদয়শঙ্করকে দেখা যায় ঝালোয়ার রাজ্যে পড়াশোনা করতে। ঝালোয়ার মহারাজের স্টেট অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর, পর্তুগিজ পিন্টো সাহেবের কাছে বেহালা শিখছেন। সেই বয়সে তাঁর রূপ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর ডানপিটে স্বভাবও অন্য মাত্রা পেয়েছিল। ঝালোয়ারের রাজকুমার উদয়শঙ্করের সমবয়সি ছিলেন। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছিল। দু’জনে টেনিস খেলতেন। যদিও উদয়শঙ্কর আগে কখনও টেনিস খেলেননি তবু তিনি রাজকুমারকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি টেনিস খেলেন। শুনে উদয়শঙ্করকে খেলায় আহ্বান করে বসেন রাজকুমার। দেখা গেল রাজকুমারের সঙ্গে সমানে সমানে টেনিস খেলে গেলেন উদয়শঙ্কর। রাজকুমার খুশি হয়ে তাঁকে একটি বাঘের ছানা উপহার দেন। বাঘটি দেওয়ার সময়ে রাজকুমার বলে দিয়েছিলেন, এই বাঘ কিন্তু বড় হয়ে ন’ফুটের মতো লম্বা হবে। উদয়শঙ্কর ভয় না পেয়ে সেই বাঘের ছানা বাড়িতে নিয়ে এসে পুষতে শুরু করলেন, নাম রাখলেন টিবু।
উদয়শঙ্করের কাণ্ডকারখানা দেখে হেমাঙ্গিনী ও শ্যামশঙ্কর তাঁকে মুম্বইয়ের জে জে স্কুল অব আর্টে চিত্রকলা শেখার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হওয়ার মুখে। তৎকালীন মুম্বইয়ের গুজরাতি শিল্পপতি মতিলাল ওয়াডিলাল শা একটি ছাত্রাবাস তৈরি করেছিলেন জৈন ধর্মের ছেলেদের জন্য। শ্যামশঙ্কর ঝালোয়ার রাজার সাহায্য নিয়ে উদয়শঙ্করের জন্য সেই ছাত্রাবাসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ষাট টাকা মাসোহারায় (যা দিতেন রাজা) উদয়শঙ্কর রওনা দিলেন মুম্বইয়ের উদ্দেশে। কিন্তু তার কিছু দিন পরেই লন্ডন থেকে শ্যামশঙ্করের চিঠি পেলেন উদয়শঙ্কর। ১৮০ পাউন্ডের একটি ব্যাঙ্ক ড্রাফট পাঠিয়ে তিনি লিখেছেন, “টাকা পেয়েই তুমি এখানে চলে এসো। তুমি রয়্যাল কলেজ অব আর্টসে ভর্তি হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল স্যর উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে আমি চিনি।”
জে জে স্কুল অব আর্টের পাঁচ বছরের শিক্ষাক্রম মাত্র দু’বছরে শেষ করে ১৯২০ সালের ১৯ অগস্ট উদয়শঙ্কর বিদেশ রওনা হলেন। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে শ্যামশঙ্কর তাঁর ব্যবসায়ী বন্ধু মেহমুদকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন উদয়শঙ্করকে নিতে। এই সময়ে ঝালোয়ারের রাজাও ছিলেন লন্ডনে। কেনসিংটন গার্ডেন্সে বিরাট একটি বাড়ি তিনি ভাড়া নিতেন লন্ডনে এলেই। সেখানেই উঠেছিলেন উদয়শঙ্কর।
কেনসিংটন প্যালেসে তখন আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্যর রদেনস্টাইনের উদ্যোগেই রয়্যাল কলেজ অব আর্টসের কমনরুমে উদয়শঙ্করের সঙ্গে পরিচয় হল রবীন্দ্রনাথের। উদয়শঙ্করের বিলেতবাস তাঁর পিতার কারণে আর পাঁচজন ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ভারতীয়ের মতো ছিল না। ঝালোয়ারের মহারাজের দেওয়ানের পরিচয় ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছে বিশেষ সুবিধাভোগীর মর্যাদা এনে দিয়েছিল। পরোক্ষ ভাবে পিতার সেই মর্যাদার সুবিধা উদয়শঙ্করও ভোগ করতেন। ফলে লন্ডনের ইঙ্গবঙ্গ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে উদয়ের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল খুব সহজে।
সে সময় লন্ডনের ভারত দফতরের শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা ছিলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের পুত্র নির্মলচন্দ্র সেন। তাঁর স্ত্রী রানি মৃণালিনী সেন ও লেডি দোরাবজি টাটা উদয়শঙ্করকে ধরে বসলেন ‘ইন্ডিয়া ডে’-তে তাঁকে অংশগ্রহণ করতে হবে। উদয়শঙ্কর সেই অনুষ্ঠানে ঠিক কী করবেন বুঝতে না পারলেও পিছপা না হয়ে ঠিক করলেন তিনি শিবসেজে মঞ্চে নাচবেন। ওয়েম্বলের প্রেক্ষাগৃহে সে দিন উদয়শঙ্করনটরাজ সেজে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং ইংরেজ দর্শকেরবাহবা কুড়িয়েছিলেন। নিজের খেয়ালবশে সে দিন যা তিনি করেছিলেন বুঝতেও পারেননি নিজের আগামী দিনের পরিচয়ের ভিত্তি নিজ হাতেই স্থাপন করলেন।
অদূর ভবিষ্যতে উদয়শঙ্করের এই ‘শিবনৃত্য’ দেখে বিদেশি সমালোচকরা লিখলেন, “Shankara is Shankara himself”।
উদয়শঙ্করের জন্ম রাজস্থানের উদয়পুর শহরে।
আশ্চর্যের কথা, লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব আর্টসের এক জন ছাত্র নেহাত উপরোধের ঠেলায় সেই শিবনৃত্য করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের ভাবনা ও পরিকল্পনায়। তখন নাচ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। ভারতীয় নৃত্যের ব্যাকরণ, শ্রেণি বিভাগ, বিভিন্ন নৃত্যশৈলী, নৃত্যধারার ইতিহাসও তাঁর জানা ছিল না। শুধু তা-ই নয়, তিনি ভারতীয় নৃত্য তখনও অবধি প্রত্যক্ষই করেননি। কিন্তু ছোট থেকে নানা বিদ্যা তিনি খুব সহজেই শিখে নিতে পারতেন। সে টেনিস খেলা হোক, ছবি আঁকা, ম্যাজিক দেখানো অথবা নৃত্য। এ ব্যাপারে তাঁর ছিল ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা।
কেশবচন্দ্র সেনের পুত্রবধূ উদয়শঙ্করকে রুশ নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। উদয়শঙ্করকে দেখামাত্র পাভলোভার পছন্দ হয়ে যায় এবং তাঁকে নিজের দলে নিতে চান। এর পরেই পাভলোভার নাচের দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন উদয়শঙ্কর। লন্ডনের কভেন্ট গার্ডেন রয়্যাল অপেরা হাউসে অনুষ্ঠিত হল দু’টি নৃত্যানুষ্ঠান, ‘ওরিয়েন্টাল ইম্প্রেশন: হিন্দু ওয়েডিং ও রাধাকৃষ্ণ’। রাধা আনা পাভলোভা, কৃষ্ণ উদয়শঙ্কর। সে দিনের সেই সন্ধ্যায় অসংখ্য দর্শকের সম্মিলিত করতালির সামনে জন্ম হল ভারতের আধুনিক নৃত্যের রূপকার উদয়শঙ্করের।
আনার দলের সদস্য হয়ে পরবর্তী ন’মাস উদয়শঙ্কর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে নৃত্য পরিবেশন করলেন। পাভলোভা ও তাঁর জুটির নৃত্য গোটা আমেরিকাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিল। সেই সফরের সাফল্য এতটাই ছিল যে এক একটি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি হত বিয়াল্লিশ হাজার ডলার (আজকের হিসেবে প্রায় ছত্রিশ লক্ষ ভারতীয় টাকার সমান)।
মার্কিন সফরের এই সাফল্য উদয়শঙ্করকে শিখিয়েছিল কী ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ এক নৃত্যদল দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে। তিনি মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলেন আগামী দিনে আনা পাভলোভার মতোই নিজের দল তৈরি করবেন বলে। কিন্তু মার্কিন সফর শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে উদয় ভয়ঙ্কর আর্থিক সমস্যার মুখে পড়লেন। আনার দলে থাকাকালীন তিনি মাসে দুশো ডলার মাইনে পেতেন। তাই বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দেন। এ দিকে তিনি অসম্ভব বিলাসী। খরচ করে ফেলেছেন সব টাকাই। এখন তাঁর রোজগার নেই। আর্থিক সাহায্য পাবেন কোথায়? শ্যামশঙ্করকেও তিনি কিছু জানাতে রাজি ছিলেন না। ক্রমশ মানসিক অবসাদ উদয়কে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এক দিন লন্ডনের টেমস নদীর ব্রিজ থেকে মরণঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তে এক পুলিশকর্মীর তৎপরতা তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়।
পরবর্তী প্রায় দশ বছর (১৯২০-’২৯) উদয়শঙ্করের জীবন ছিল ভেসে চলা নোঙরহীন এক নৌকার মতো। খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য তাঁকে যেখানে-সেখানে নাচের অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। পাভলোভার দলছুট দুই সঙ্গী শকি ও অ্যাডেলেডকে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন একটি নৃত্যদল, যার নাম ছিল ট্রায়ো। এই দল প্রথমে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন নাইট ক্লাবে মাঝেমধ্যে নাচিয়ের চাকরি পেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। অবশেষে মরিয়া হয়ে তাঁরা তিন জন ইংল্যান্ড ছেড়ে প্যারিসে এসে হাজির হলেন ১৯২৪ সালে। তাঁরা আশা করেছিলেন প্যারিস তাঁদের হতাশ করবে না। তবে খুব সহজে সেই সাফল্য আসেনি। উদয়শঙ্কর ভারতীয় নৃত্য হিসেবে দর্শকদের সামনে যা পরিবেশন করতেন তা কোনও ভাবেই ভারতীয় ছিল না।
তবু চেষ্টা করছিলেন পাভলোভার মতো ‘ভারতীয় এক ব্যালেরিনা’ দর্শককে দেখাতে। তিনি তখন নিজের ইচ্ছেমতো নাচ তৈরি করে নাম দিতেন ‘শিব’, ‘ইন্দ্র’ বা ‘রাধাকৃষ্ণ’। এ ভাবেই নিজের অজান্তে ‘আধুনিক ভারতীয় নৃত্যপ্রণালী’ আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন উদয়শঙ্কর। ১৯২৩-এর শেষ থেকে ১৯২৯ সাল অবধি বেপরোয়া উদয়শঙ্কর নিজের শিল্পের সন্ধানে লন্ডন, বার্লিন, ইটালি, প্যারিসের ক্লাব-রেস্তরাঁয় অশৈল্পিক পরিবেশের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে এক সময় ইউরোপকে জানাতে পেরেছিলেন, ‘আমি উদয়শঙ্কর, আমি ভারতের প্রথম আধুনিক নৃত্যশিল্পী, আমি এসেছি, আমাকে দেখো’।
প্রবাসে থাকা বা বেড়াতে যাওয়া ভারতীয়দের দৌলতেই তিনি জনপ্রিয়তা পান। যেমন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে হঠাৎ এক দিন এক রেস্তরাঁয় দেখা হয়ে গিয়েছিল উদয়ের। আবার কোনও এক দিন প্যারিসের ‘আর্ট ডেকরেটিভ’-এ মধ্যরাতে দু’টি নাচ ‘অসি নৃত্য’ ও ‘জলবহনকারী’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ধনকুবের ব্যারন দ্য রথচাইল্ড। তিনি উদয়শঙ্করকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের প্রাসাদে। এক সন্ধ্যায় রথচাইল্ডের প্রাসাদে উদয়শঙ্কর পরিবেশন করেছিলেন তাঁর নতুন নৃত্য, ‘ইন্দ্র’। মাত্র চার-পাঁচ মিনিটের সেই পরিবেশনে ব্যারনের অতিথিবর্গ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যে ভাবে উদয়শঙ্কর নিজের শরীরে কম্পনের ভঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা দেখে রথচাইল্ড করমর্দন করে উদয়শঙ্করের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্কের একটি চেক।
এই সময়ে আর এক মহিলার সঙ্গে উদয়শঙ্করের আলাপ হয়। তিনি জাঁ রনসে, এক জন দক্ষ নৃত্যশিল্পী। তিনি উদয়শঙ্করকে অনুরোধ করেন তাঁর দুই ছাত্রীকে ভারতীয় নৃত্য শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। এঁদের এক জন মিশেল দ্য মুর, অন্য জন সিমন বারবিয়ে। সিমনকেই উদয় নতুন নাম দেন ‘সিমকি’। সিমকির সঙ্গে সুইৎজ়ারল্যান্ডের জ়ুরিখ শহরের ‘কুরশাল থিয়েটার’-এ নৃত্য পরিবেশনের পর উদয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপ করতে আসেন ভাস্কর ও শিল্প ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অ্যালিস বোনার। প্রায় দশ বছর পরে উদয়শঙ্করকে ভারতে ফিরিয়ে আনেন বোনার। ১৯২৯ সালে উদয়শঙ্কর, বোনার ও সিমকি এসে পৌঁছন মুম্বই বন্দরে।
দেশে ফিরে একটা প্রশ্ন উদয়কে চিন্তায় ফেলেছিল, ইউরোপ তাঁকে চিনলেও নিজের দেশে তিনি অপরিচিত। ফলে দেশের শিল্প-সাহিত্য মহলে নিজের নাচ প্রতিষ্ঠিত করার একটা তাগিদ অনুভব করতে শুরু করেন তিনি। সেই কাজের প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ইম্প্রেসারিয়ো হরেন ঘোষের। মনে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টস বা প্রাচ্য চিত্রকলা ভবনে উদয়শঙ্করের প্রথম একক নৃত্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন হরেন ঘোষ। নিমন্ত্রণ পেয়ে অবনীন্দ্রনাথ নাকি পরিহাস করে বলেছিলেন, “পুরুষমানুষ নাচবে তা-ও দেখতে হবে?” হরেনের উদ্যোগেই উদয়শঙ্করের আধুনিক ভারতীয় নৃত্যর সঙ্গে কলকাতার নামীদামি বিদগ্ধ মানুষেরা প্রথম পরিচিত হয়েছিলেন।
শিল্পী অর্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলি সংক্ষেপে ও সি গাঙ্গুলি দর্শকের সঙ্গে উদয়শঙ্করের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই অনুষ্ঠানে উদয়শঙ্করের নাচ দেখে মোহিত হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। উদয়শঙ্করের নাচে মুগ্ধ হয়ে তাঁর দলের সঙ্গে যুক্ত হন সরোদবাদক তিমিরবরণ। সে দিনের দর্শকেরা মনে করেছিলেন, অনেক দিনের অবহেলিত ভারতের নৃত্যকলাকে জগৎসভায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়তো উদয়শঙ্করের পক্ষেই সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানে উদয়শঙ্করের নাচের সঙ্গে বাজনায় সঙ্গত করেছিলেন কলকাতার খ্যাতনামা যন্ত্রী বেন্টেলম্যান ভ্রাতৃদ্বয়। নিজেদের তৈরি স্বরলিপি অনুসারে এক ভাই বাজিয়েছিলেন বেহালা, অন্য জন পিয়ানো। নাচের শেষে উদয়শঙ্করের সঙ্গে আলাপ করেন তিমিরবরণ। তাঁর মনে হয়েছিল উদয়শঙ্করের ওই নাচের সঙ্গে বেন্টেলম্যান ভ্রাতৃদ্বয় যে সুরসঙ্গত করেছেন, তা অত্যন্ত বেমানান। এর পর তিমিরবরণের সরোদ এবং তাঁদের ‘ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা’ শোনেন উদয়শঙ্কর। তা শুনে মুগ্ধ উদয়শঙ্কর পরের দিনই অ্যালিস বোনারকে সেই বাজনা শোনান এবং তিমিরবরণকে নিজের দলের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। তিমিরবরণের সুর সংযোগ উদয়শঙ্করের নাচকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল। উদয়শঙ্করকে নিয়ে সারা ভারতে সাড়া পড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ভারতীয় নৃত্যর বাইরে গিয়েও নৃত্য যে একটা স্বাধীন শিল্প হয়ে উঠতে পারে সেটাই প্রথম দেশের মানুষ দেখেন।
বিষ্ণুদাস শিরালী ও তিমিরবরণকে নিয়ে উদয়শঙ্করের গোটা পরিবার এ বার ইউরোপ ভ্রমণের উদ্দেশে রওনা দেয়। এই ভ্রমণের স্মৃতিচারণ রবিশঙ্করের লেখায় পাওয়া যায়, “... প্যারিসেই দাদা শুরু করলেন ওঁর সমস্ত রচনাকর্ম, যা কিছু ওঁর মাথায় ছিল। যা কিছু ভারতে দেখে এসেছেন, সে কথাকলি, সে মণিপুরী, ছৌ, অল দ্য ফোক ডান্সেস, অল দ্য ভিলেজ ডান্সেস, যা কিছু চিত্রকলা, ভাস্কর্য, দেশের নানা প্রান্তের মানুষের মুভমেন্টস, তাদের কস্টিউমস... অ্যালিস বোনার নিজেও ভাল ভাস্কর এবং চিত্রকর ছিলেন, তিনি ভারতের যেখানেই গেছেন দাদার সঙ্গে সেখানেই মেয়েদের দুল, গলার হার, কোমরের বিছে, দেহের নানা অঙ্গের অলঙ্কার, পায়ের পায়েল, পোশাক সব সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া প্যারিসের ওই বাড়ি তখন ছেয়ে গেছে ভারত থেকে আনা হাজার হাজার মিটার কাপড়ে। ভাবো, শ’দেড়েক ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি এত সব। যেন ভারতীয় সংস্কৃতিকেই তার নিখুঁত ডিটেলে গড়ে তোলার এক যজ্ঞ চলছে সেখানে।”
অ্যালিস বোনারের চেষ্টায় উদয়শঙ্কর প্যারিসে একটি নাট্যদল তৈরি করলেন যার নাম ছিল, ‘কোম্পানি উদয়শঙ্কর দ্য ডান্স মুইজিক হিন্দুস’। এই দলে ছিলেন সিমকি। ১৯৩০-’৪২ সাল অবধি এই দলটি সারা ইউরোপ জুড়ে ৮৮৯টি নৃত্যানুষ্ঠান করেছিল। ১৯৩১ সালের ৩ মার্চ প্যারিসের ‘সজেঁলিজে রঙ্গালয়’-এ উদয়ের নতুন দলের প্রথম অনুষ্ঠান হয়। এই পর্বে তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ডেও গিয়েছেন অনুষ্ঠান করতে। ইংল্যান্ডে উদয়শঙ্করের নাচ দেখে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রবন্ধু এল্মহার্স্ট ও তাঁর স্ত্রী ডরোথি এবং ডরোথির কন্যা বিয়াট্রিস। এই ডরোথি যেমন রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন উদ্যোগের জন্য আর্থিক সাহায্য করেছিলেন, তেমন উদয়শঙ্করের নাচের দলকেও সাহায্য করেন।
‘রাধা-কৃষ্ণ’ ব্যালেতে আনা পাভলোভার সঙ্গে উদয়।
এই পর্বেই ১৯৩১ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল বিরাট আকারে। সেই প্রদর্শনীতে উদয়শঙ্কর ও তাঁর সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। এক দিন উদয়শঙ্কর তাঁর গোটা টিম নিয়ে সেই প্রদর্শনী ঘুরতে ঘুরতে কলকাতার বাঙালি উদ্যোগপতি অক্ষয়কুমার নন্দীর ‘ইকনমিক জুয়েলারি ওয়ার্কস’ স্টলে হাজির হন। সুন্দর সুন্দর হাতির দাঁতের জিনিস ও ভারতীয় অলঙ্কার দেখে চমৎকৃত হন। সেই স্টলেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অক্ষয়কুমারের মেয়ে অমলার। উদয়শঙ্কর তাঁদের প্যারিসের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীকালে অমলা তাঁর দলে যোগ দেন। ক্রমশ অমলা হয়ে ওঠেন উদয়শঙ্করের দলের অপরিহার্য একজন নৃত্যশিল্পী। দু’জনের পরিচয় ক্রমশ প্রণয়ে পরিণত হয়। ১৯৪২ সালে উদয়শঙ্কর-অমলার বিয়ে হয়। ওই বছরেই তাঁদের পুত্র আনন্দশঙ্কর জন্মায়। ১৯৫৪ সালে জন্ম হয় কন্যা মমতাশঙ্করের।
১৯৩৭ সালে উদয়শঙ্কর কলকাতায় আসেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাচ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে আশীর্বাদ করেন। প্রসঙ্গত, উদয়শঙ্করের বহু আগে রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় ভারতীয় নৃত্যের গণ্ডির বাইরে এসে আধুনিক নৃত্যশৈলী নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন, যা আজ রবীন্দ্রনৃত্য নামে পরিচিত।
এর পর রবীন্দ্রনাথেরই অনুপ্রেরণায় ১৯৩৯ সালে হিমাচল প্রদেশের আলমোড়ায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি সারা ভারত থেকে নামীদামি নৃত্য ও সঙ্গীতগুরুদের আমন্ত্রণ করে আনেন। আলমোড়ার এই কেন্দ্রটি ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে আজও। এই প্রতিষ্ঠানের গুরুকুল ও ছাত্রদের নিয়েই উদয়শঙ্কর তৈরি করেছিলেন ভারতের একমাত্র নৃত্যনির্ভর চলচ্চিত্র ‘কল্পনা’, যা আজও পৃথিবী জুড়ে ক্লাসিক চলচ্চিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে উদয়শঙ্কর সৃষ্টি করেছিলেন ‘গ্রেট রিনানসিয়েশন’, ‘ইটার্নাল মেলডি’, ‘গৌতম বুদ্ধ’ (রঙিন ছায়ানৃত্য), ‘অসম ব্যালে’, ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘প্রকৃতি ও আনন্দ’-সহ আরও কয়েকটি ছোটবড় নৃত্যনাট্য। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নৃত্যমঞ্চ থেকে উদয়শঙ্করকে হঠাৎই বিদায় নিতে হয়। এর কয়েক বছর পর তিনি আবার ফিরে আসেন তাঁর জীবনের শেষ কীর্তি ‘শঙ্করস্কোপ’ নিয়ে। সেটিও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষরস্মৃতি।
১৯৭৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৭৬ বছর বয়সে উদয়শঙ্কর প্রয়াত হন। তার আগে ১৯৬০ সাল থেকে তিনি কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। ওই বছর তাঁকে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৭৫ সালে ‘দেশিকোত্তম’ পান তিনি। উদয়শঙ্কর ছিলেন এক জন অমোঘ স্রষ্টা। ভারতের ধ্রুপদী ও লোকনৃত্যর এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তৈরি করেছিল আধুনিক ভারতের নৃত্যশিল্পকে, যা একাধারে তুরীয় আবার রহস্যময়। একাধারে পৌরাণিক আবার অন্য দিকে আধুনিক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)