টিম সেই একই। জায়গাও। কুট্টুস তখন ছিল আঠেরো মাসের। গুড়িয়া সাড়ে তিন বছর। গোগোল ছয়। ঠিক সাত বছর পরে আমরা আবার পেলিংয়ে। বিকেলে গাড়ি থেকে নামার সময়েই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। একই হোটেলে ওঠার কারণ একটাই, বারান্দা আর ঘরের জানালার কাচ বেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেন হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়! কিন্তু এখন সন্ধে ছুঁইছুঁই, বৃষ্টির আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ মেঘের ঘন পর্দায় ঢাকা।
ওরা একই রকম আছে। শুধু ঝগড়া। কাল সকালে সিংশোর ব্রিজ না কি ইয়াকসম? সন্ধেয় মোমো আর চিকেন পকোড়াও বিবাদে জল ঢালতে পারেনি। আমরা পূর্ব সিকিমে আসা ইস্তক বৃষ্টি পড়ছে। গুড়িয়া তো বলেই বসল, ‘‘আকাশটা ফুটো হয়ে গেছে।’’ বড়রা কিন্তু বৃষ্টির কথা বলছেই না ভয়ে। কাল সকালটা মাটি হবে না তো! রাত বাড়ল, বাড়ল বৃষ্টিও। পাল্লা দিয়ে ছোটদের ঝগড়া।
আমাদের হোটেলের বন্ধু সোনম ফিরতেই ঝগড়ার ইতি। বারান্দায় বৃষ্টিতে আম্পায়ারের পিচ দেখার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাঁর উক্তি, ‘‘সকালের আগে বৃষ্টি থামবে না। ড্রাইভার গাড়ি আনতে চাইছেন না।’’ সেই শুনে সবারই দৃষ্টি শূন্য।
সুন্দরী ঝর্না
পাহাড়বাসীরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়েন। প্রকৃতির মনও ভাল বোঝেন। রাতে অঝোরে, ভয় ধরানো বৃষ্টি। যে ভয় লেপে ঘুম না আসা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। হোটেলে বন্দি আমরা। বৃষ্টি কমেছে। বিকেলের আহ্বানে ঝকঝকে আকাশে রোদের ঝিলিক। হোটেলের বারান্দা থেকে হঠাৎ চিৎকার কুট্টুসের। কাঞ্চনজঙ্ঘা সকলকে নির্বাক করে দিল!
আমরা গাড়িতে সওয়ার। পেলিংকে টাটা করে ইয়াকসমের পথে। ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরে। রাস্তার দু’ধারের সবুজ এখানে আরও ঘন। শেষ জুনের সকালে আমরা সাদা মেঘের চাদরে ক্রমেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছি। নাম না জানা পাখিরা এখানে আপন খেয়ালে কথা বলে। আছে রাস্তা উপচে পড়া ঝর্নার গান। প্রকৃতির এই তল্লাটে আসা ইস্তক মনে হচ্ছে, নাম না জানা, নাম না দেওয়া কত শত ঝর্না সৌন্দর্য বিলোচ্ছে। এখানকার নাম ইয়াকসম হলেও পোশাকি নাম হতেই পারত ‘নৈঃশব্দ্যপুর’।
কাটহক লেক
একদা সিকিমের রাজধানী ছিল। সময়ের অনিবার্যতায় রাজধানী সরেছে গ্যাংটকে। নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে দিনের দিন রাবংলা, পেলিং ছুঁয়ে ইয়াকসমে পৌঁছনো যাবে। অনেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দর্শনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না বলেই পেলিংয়ে রাত কাটিয়ে ইয়াকসমে আসেন। গ্যাংটক থেকে ইয়াকসম ১৩৪ কিলোমিটার।
এখানে পথই আপনাকে চুপ করিয়ে দেবে। ইলশেগুঁড়ির বৃষ্টিভেজা পথে গাড়ির গতি বাড়ল। মেঘবৃষ্টির আধো আলোয় চালককে থামতে হচ্ছিল। কেননা নীচে তখন পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রামগুলো পেঁজা তুলোর সাদা মেঘের চাদরে অবিরাম ঢেকে যাচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ মেঘ চেরা আকাশ ঠিকরে সূর্যের আলোয় ক্রমেই নীচের গ্রামগুলো দৃশ্যমান হচ্ছিল। আমরা তখনও উপরে আধো আলোর ঘোমটায় ঢাকা। এক আকাশের নীচে প্রকৃতির বিপরীতমুখী এই শোভায় আমরা তখন দিশেহারা।
এখানে উচ্চতা খানিকটা বেশি। প্রকৃতির রূপও ভিন্ন। রোদের ঝিলিক আর নীল আকাশকে সাক্ষী রেখে থামা গেল। চোখ বুলিয়ে ঠাহর করা গেল পাহাড়িগঞ্জের চেহারা। সাইন বোর্ড জানান দিল পৌঁছে গিয়েছি পশ্চিম ইয়াকসমে। হোটেলে মেনু বাতলে আমরা ফের টহলে। ইয়াকসম এক সময়ের রাজধানী বলেই গুরুত্বপূর্ণ এমনটা নয়। এখানকার ইতিহাস সমৃদ্ধ। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে সিকিমে বৌদ্ধ মন্দির তৈরি হয়। এই মন্দিরে খানিক সময় নিয়ে আসতে হবে। একটা সময়ের পরে গাড়ি আর উঠবে না। চড়াই পাহাড়ি রাস্তা। কয়েক কদম হাঁটা পথ। পা যখন দু’দণ্ড বিশ্রাম চাইছে, একটা গাছ চোখ টেনে নিল। অন্তত দুশো ফুটের পাইন গাছটা বিরাট এলাকা জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। পুরাতত্ত্বের সাইন বোর্ড জানান দিল ওই পাইনটিই সিকিমের প্রাচীনতম। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইয়াকসমে এসেছেন দাড়িও ফো। তাঁর আক্ষেপ, ভিসার মেয়াদ শেষ। তাই ইয়াকসম ছাড়তে হচ্ছে। এখানে ইতিহাসের সঙ্গেই রয়েছে চোখ জোড়ানো একাধিক লেক। সেই লেকে আকাশের নীল রং মিশে রঙিন মাছ খেলা করছে।
ইয়াকসম থেকে যাওয়া যায় ট্রেকিংয়েও। সে পথ যদিও অন্য। তবে ইয়াকসম ছাড়লেও সে কি আমাদের ছাড়ে? এখানে প্রকৃতি দু’হাত খুলে সৌন্দর্য ছড়িয়েছে অবিরাম। সেই পাহাড়ি পথ পার হওয়ার আনন্দে দিশেহারা মন তখন শুধুই শেখায় নতজানু হতে।
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে ভাড়াগাড়িতে পেলিং। অথবা সরাসরি মোট ১৩৪ কিলোমিটার দূরত্বে ইয়াকসাম