Advertisement
E-Paper

অঙ্কস্যার

চেহারায়, চরিত্রে একেবারে আলাদা। চিনতে ফেলুদা-ব্যোমকেশ লাগে না। লিখছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তীঅঙ্কের স্যারেরা কাব্যে উপেক্ষিত। আমাদের লেখকরা সংস্কৃত স্যার বা পণ্ডিত স্যার নিয়ে কত মাতামাতি করেছেন। গল্প-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র করেছেন। কিন্তু অঙ্কের স্যার নিয়ে সে তুলনায় কিছুই হয়নি। শিব্রাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কররা সংস্কৃত স্যার নিয়ে লিখেছেন। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘বৈয়াকরণ’ গল্পটি তো এক অনন্য সৃষ্টি। অথচ নারায়ণ সান্যালের ‘প্যারাবোলা স্যার’ ছাড়া কোনও অঙ্ক স্যারের কথা তেমন ভাবে আমি অন্তত জানি না, যদিও অঙ্ক স্যারেরাও নিজস্ব চারিত্রিক ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

অঙ্কের স্যারেরা কাব্যে উপেক্ষিত।

আমাদের লেখকরা সংস্কৃত স্যার বা পণ্ডিত স্যার নিয়ে কত মাতামাতি করেছেন। গল্প-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র করেছেন। কিন্তু অঙ্কের স্যার নিয়ে সে তুলনায় কিছুই হয়নি।

শিব্রাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কররা সংস্কৃত স্যার নিয়ে লিখেছেন। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘বৈয়াকরণ’ গল্পটি তো এক অনন্য সৃষ্টি। অথচ নারায়ণ সান্যালের ‘প্যারাবোলা স্যার’ ছাড়া কোনও অঙ্ক স্যারের কথা তেমন ভাবে আমি অন্তত জানি না, যদিও অঙ্ক স্যারেরাও নিজস্ব চারিত্রিক ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত।

গত ষাটের দশকেও পণ্ডিত স্যারদের দেখলেই চেনা যেত। ধুতি-চাদরে থাকতেন। চাদরে নস্যির গুঁড়ো। চুল ছোট। কারও ছোট টিকি, শুদ্ধ কথায় যা ‘শিখা’। হাতে কাপড়ের ব্যাগ। আজকাল আর পণ্ডিত স্যারেরা নেই। এখন বৈশিষ্ট্যহারা ‘স্যানস্ক্রিট টিচার’। প্যান্টের মধ্যে অনায়াসে গুঁজে দিচ্ছেন শার্ট।

অঙ্কের স্যারদেরও আগে বেশ চেনা যেত। মাথার চুল প্রায়শই আঁচড়ানো থাকত না। জামার বোতাম ছেঁড়া। শার্ট গোঁজা থাকলেও বেল্টের লেজ এলিয়ে ঝুলছে। চোখে ফরমুলা-সন্ধানী উদাস দৃষ্টি।

অঙ্কের স্যাররা চলনে বলনে একটু ছিটেল প্রকৃতিরই হয়ে থাকেন সাধারণত। এবং অঙ্কের ফর্মুলার মতোই আদ্যিকাল থেকে যুগে যুগে প্রায় একই রকম রয়ে গেছেন। টিচার্স রুমের মাস্টারমশাইদের মধ্যে কে অঙ্কের স্যার বুঝতে ব্যোমকেশ-ফেলুদা লাগে না।

অঙ্কের স্যারেরা হয়তো বহিরঙ্গে আলাদা আলাদা। একজন X হলে, অন্যজন Y, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু কমন এলিমেন্ট আছে, যা ব্র্যাকেটে থাকে।

ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অবধি অনেক অঙ্কের স্যার দেখলাম। চাকরিজীবনের শেষ দিকে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসস্টিকাল ইন্স্টিটিউটে যুক্ত ছিলাম। ওই জায়গাটা অঙ্কের কাশীক্ষেত্র। স্যারেরা এক-একজন অঙ্কের শাস্ত্রীমশাই। ওখানে বিশ্বঘোরা অঙ্কের স্যারদের দেখেছি, প্যান্টের উপর ফুলশার্ট ঝুলছে, কিংবা সাধারণ টি-শার্ট গায়ে। ভাঁড়ে চা খেতে খেতে ছাত্রদের সঙ্গে গত রাতের ঝড়ের গল্প করতে করতে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন ফ্লুয়িড ডিনামিক্স কিংবা ক্যায়োটিক মোশন।

শৈশবে বাগবাজারের কাশিমবাজার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন লাল মলাটের ধারাপাত বইতে কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া ছিল। একে চন্দ্র দুইয়ে পক্ষ ছিল। একক দশক শতক সহস্র অযুত লক্ষ নিযুত কোটি। কোটির পর কী? অর্বুদ। অর্বুদের পর কিছু ছিল কি না মনে নেই।

এখন হাজার কোটি লক্ষ কোটি স্ক্যামের যুগে অর্বুদ-টর্বুদ অচল। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন চলতে পারে। রোগা মতন নগেন স্যার ‘কথায় লিখো’ ‘সংখ্যায় লিখো’ কষাতেন। উনি পঞ্চান্নকে পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে পাঁচপান্ন বলতেন, ছাপান্নকে ছয়পান্ন।

একদিন এক গার্জিয়ান এসে নাকি বলেছিলেন, “ভুল শেখাচ্ছেন কেন?” নগেন স্যার বলেছিলেন, “পাচপান্নোরে পনচান্নো কইলে কি আমনের পোলা লাট হইব? চিড়ারে চিড়া কইলে কি চিড়া পোলাউ হইয়া যায়?”

একটা ছেলে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার পাচপান্ন লিখতে গেলে একটা পাঁচ অন্য পাঁচের ডান দিকে রাখব নাকি বাঁ দিকে?”

নগেন স্যার বলেছিলেন, “আয় দেখাই তরে।”

তার পর বিখ্যাত গাঁট্টা। নিজেই বললেন, “জানস না? নগেন স্যারের গাঁট্টা কম কইরা আটটা খাইবার চাও? কাশিমবাজার যাও।”

ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আর একজন অঙ্কের স্যার পেলাম। ওঁর নাম ছিল কে বি, পুরো নাম সম্ভবত কমল বাগচি। কবি নামেই বিখ্যাত ছিলেন কেবি। কারণ তিনি কবিতায় অঙ্ক করাতেন। ওঁর কাছেই শুনেছিলাম ওমর খৈয়াম কবি এবং অঙ্কবিদ ছিলেন।

কবি স্যার বইয়ে লেখা প্রশ্নের বাইরে কবিতায় অঙ্ক বানিয়ে বোর্ডে লিখে দিতেন। কয়েকটা মনে আছে আজও। যেমন—

তিরিশ টাকায় কিনলি খাসি/লোক ছুটেছে একশো আশি/ সবাই বলে খাবে খাবে/ সমান সমান ভাগায় নেবে/ সাতাশ সের ওজন ধর/ কে কত পয়সা দেবে হিসেব কর।

যদিও এটা সাধারণ গুণ-ভাগের অঙ্ক, কিন্তু তখন সের পোয়া ছটাক এবং টাকা আনা পাই-এর হিসেব বেশ জটিল ছিল। কবি স্যার লসাগু, গসাগু থেকে নল চৌবাচ্চার অঙ্ক, সুদ কষা, ক্ষেত্রফল, বাঁশ-বাঁদরের অঙ্ক নিয়েও কাব্য করতেন। কবি স্যারের একটা নল-চৌবাচ্চার অঙ্ক এ রকম—

চৌবাচ্চা ছিল এক প্রকাণ্ড বিশাল/দুই নলে জল আসে সকাল-বিকাল/ এক নলে পূর্ণ হতে বিশ মিনিট লাগে/ অন্য নলে পূর্ণ হয় না আধা ঘণ্টার আগে/ চৌবাচ্চা পূর্ণের সময় করোগো নির্ণন/ দুই নল খুলে দিলে লাগে কতক্ষণ।

লসাগু-গসাগু-র অঙ্কগুলো বিচ্ছিরি লাগত আমার। একটা বিচ্ছিরি শব্দ আছে বলেই শুধু নয়, কী ঘোঁট পাকানো অঙ্ক সব!

একটা চার্চে এক ঘণ্টা পর পর ঘণ্টা বাজে, একটা স্কুলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্তর ঘণ্টা বাজে, একটা কারখানায় আট ঘণ্টা পর পর সাইরেন বাজে। কখন তিনটে শব্দই একসঙ্গে বেজে উঠবে?

এই ধরনের প্রশ্ন দিয়ে বানানো কবিতার জট ছাড়ানোটা কী ঝকমারি ব্যাপারই না ছিল।

ভাবি, পাটিগণিতের অঙ্কপ্রণেতারা কী সব প্যাঁচানো ভাবনা ভাবতে পারতেন। এঁদের মধ্যে প্রধান দুই কালপ্রিট হলেন যাদব চক্রবর্তী আর কেশবচন্দ্র নাগ। এঁরাও নাকি অঙ্কের স্যারই ছিলেন।

কেশবচন্দ্র নাগ অঙ্ক এবং সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অঙ্ক শেখানোর সুনাম স্যার আশুতোষের কাছে এলে তিনি কে সি নাগকে ভবানীপুরের মিত্র ইন্স্টিটিউশনে নিয়ে আসেন।

স্যার আশুতোষ নিজেও অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন। এমনি এমনি বাংলার বাঘ হয়েছিলেন?

কে সি নাগ একে সংস্কৃত, তার ওপর অঙ্কের ছাত্র ছিলেন, এ জন্যই যত কঠিন অঙ্ক মাথা থেকে বার করতে পেরেছিলেন আমাদের মতো কোমলমতি শিশুদের কষ্ট দেওয়ার জন্য।

কী সব অঙ্ক! একটা ট্রেন এ ধার থেকে ও ধার যাচ্ছে, অন্যটা ও ধার থেকে এ ধারে। একটা হল মেল ট্রেন, অন্যটা লোকাল। ও ধারের ঘড়ি পাঁচ মিনিট ফাস্ট, এ ধারের ঘড়ি আবার তিন মিনিট স্লো, কখন ট্রেন দুটো একে অন্যকে ক্রস করবে... বাপ্ রে..। তার পর তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদর। বাঁদরটা বাঁশ বেয়ে উঠছে আর পিছলে পড়ছে। কখন বাঁদরটা মাথায় চড়বে? বোঝো! আরে, তেল মাখাতে গিয়েছিল কেন অবোধ শিশুদের বিপদে ফেলার জন্য!

পনেরো জন পুরুষ শ্রমিক দশ দিনে একটা দেওয়াল গাঁথতে পারে। চার দিন পর দেওয়াল ভেঙে গেল। এ বার আরও চার জন মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত করা হল। এ বার আরও তিন দিন লাগল। এক জন মহিলা শ্রমিক তিন জন মহিলা শ্রমিকের সমান। প্রথমে কত জন পুরুষ শ্রমিক ছিল। দেওয়ালটা খামোকা ভাঙার কী দরকার ছিল?

সে সময় কৃষ্ণা বসু-শাশ্বতী ঘোষদের মতো নারীবাদীরা থাকলে কে সি নাগ মশাই এত ঝামেলায় যেতে পারতেন না! তিন জন মহিলার সমান একজন পুরুষ? মামদোবাজি?

তবে এটা ঠিক কথা যে কেশব নাগের পাটিগণিতের অঙ্কে গোয়ালাদের দুধে জল মেশানো, মহাজনদের সুদের প্রতি লোভ , ঘিয়ে ভেজাল, ট্রেনের লেট, বিদ্যুতের বিল এরকম নানা সামাজিক প্রসঙ্গ এসে পড়ত। আগে এতটা ছিল না বলে, কে সি নাগের পাটিগণিতের অঙ্কগুলোকে বলা যায় ‘জীবনমুখী অঙ্ক’। আর জীবন আসলে জটিল বলেই না জীবনমুখী অঙ্ক জটিল।

কবি স্যার এই ধরনের অঙ্কে কবিতাকে ছুটি দিয়ে দিতেন। গদ্যের কড়া হাতুড়ি হানতে হত। কঠিন অঙ্ক বড়ই গদ্যময়। কবি স্যার নাকে নস্যি নিয়ে চক হাতে বোর্ডে যেতেন অঙ্ক যুদ্ধে।

যুগে যুগে কিছু অঙ্কে পাকা ছেলে জন্মে যায় বলে আমাদের মতো অঙ্কে কাঁচাদের বড় দুর্দশা। অনুশীলনীর কঠিন কঠিন অঙ্কগুলো নিয়েই ওঁদের যত মাথাব্যথা। আর যুগে যুগে অঙ্ক স্যারেরা ওই মাথাপাকা ছেলেগুলোকেই ভালবাসেন।

ক্লাস সেভেন থেকে শুরু হয়ে যেত অ্যালজ্যাবরা। অ্যালজ্যাবরা শুনলেই কে পি বসুর বইটার কথা মনে পড়ে। যেমন, গ্রামার বই বলতেই পি কে দে সরকার। চারুচন্দ্র চক্রবর্তীরও একটা অ্যালজ্যাবরা বই খুব চলত।

দেবকিঙ্কর রক্ষিত নামে একজন অঙ্কের স্যার আমাদের অ্যালজ্যাবরা করাতেন। জগদীশ বসুর মতো চুল। সেই চুলে চিরুনি পড়ত কম। প্রথম দিনে ক্লাসে এসেই বলেছিলেন, “অ্যালজ্যাবরা হল একটা লুকোচুরি খেলা। আছে, কিন্তু ধরতে হবে। যাকে তুমি ধরতে চাও, তার নাম দিয়ে দাও X”— পাটিগণিতের অঙ্কগুলোও উনি X ধরে শেখাতেন। আগে বয়েসের অঙ্কে যখন বলা হত, তোমার বাবার বয়স এখন তোমার বয়সের চারগুণ। কবি স্যার শেখাতেন, “মনে করো তোমার বয়স এক, তা’হল তোমার বাবার চার।” এই ‘মনে করা’টা বড় কষ্টদায়ক ছিল। এত কষ্ট করে বড় হলাম, আবার হাঁটি হাঁটি পা পা বয়স! এখন তো চলতি ট্রামে উঠছি। অ্যালজ্যাবরায় তবু যা হোক, এক দুই ধরতে হচ্ছে না, X Y তবু মানা যায়।

পাটিগণিতের ফুলবাগানে অ্যালজ্যাবরার ছাগল ঢোকানো কবিস্যারের মনঃপুত ছিল না বলে, দেবকিঙ্কর বাবুর সঙ্গে ওর একটু মন কষাকষির ব্যাপার ছিল। দেবকিঙ্করবাবু কোনও কঠিন অঙ্ক কষতে দিয়ে ডাস্টার উঁচিয়ে বলতেন, “যে যে পারবে তাদের টিপিন বেলায় আলুর দম।” (অঙ্ক করাটাকে বলে কষা। মাংস নরম করতে গেলে কষতে হয়। কেন যে অঙ্ক করা না হয়ে কষা হল কে জানে!) দেখতাম দু’একজন প্রায় রোজ অঙ্কের আলু ভোগ করত। আমরা চেয়ে থাকতাম।

সব অঙ্ক স্যারদের একটা বদভ্যাস হল, গাদা গাদা হোম টাস্ক দেওয়া। ছুটির হোমটাস্কগুলো ছিল বড় ব্যামোর ব্যাপার। স্কুল খুললেই দেবকিঙ্করবাবুর টেবিলে খাতা জমা করতে হত। কেউ কম করলে ঠিক ধরে ফেলতেন। যে ক’টা অঙ্ক কম হয়েছে, তার ডবল হোমটাস্ক ঘাড়ে চাপত।

দেবকিঙ্করবাবু মাঝে মাঝে আবার অঙ্কের খেলাও দেখাতেন। কিছু খেলা মনে আছে। যেমন—

৮১৬

৩৫৭

৪৯২

যে দিক থেকেই যোগ করো ১৫ হবে।

২+২+২=৬, এই ৬ দিয়ে ২২২-কে ভাগ করো। ৩৭ হবে। ৩৩৩, ৪৪৪, ৫৫৫ — সব সংখ্যাই এ রকম করলে ভাগফল হবে ৩৭।

একদিন প্রেয়ারের সময় এক মাছওয়ালা একটা মাছের ব্যাগ নিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দেবকিঙ্করবাবু মাছের ব্যাগ বাজারে ফেলে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।

ক্লাস এইটে বাবা হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ওখানে ভাল ভাল ছেলেদের ভিড়। স্যারেরা কঠিন কঠিন অঙ্ক বেছে বেছে করতে দেন। দ্বিঘাত ত্রিঘাত সমীকরণের ঠেলায় মাথার ভিতর XYZ বিজবিজ করছে। কবি স্যারের প্রভাবে একদিন অঙ্ক খাতায় লিখে ফেললাম— হ্যাবড়া জ্যাবড়া অ্যালজ্যাবরা/আলুকুমড়োর পচা লাবড়া/ তার ওপর ভনর ভনর XYZ মাছি/অঙ্ক ক্লাসে এমনি করেই আছি।

ব্যথা থেকেই তো জন্ম নেয় কাব্য। এটাই আমার প্রথম স্বরচিত কাব্য।

এর পর বিজ্ঞান নিলাম। দু’জন অঙ্কের স্যার ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিকে। গোপালবাবু আর নয়ানবাবু। গোপালবাবু ধুতি পরতেন। নয়ানবাবু শার্ট-প্যান্ট। দু’জনের দু’রকমের স্বভাব। কিন্তু একটা বিষয়ে মিল। যত নজর কঠিন কঠিন অঙ্কের দিকে, আর অঙ্কপাকা ছেলেদের দিকে।

পার্থ, অঞ্জন, উৎপল, শশী এই সব ভাল ছেলেগুলো কঠিন অঙ্ক করার কঠিন প্রতিযোগিতা করত। ছটপুজোর ঠেকুয়ার মতো ওদের আটকে যাওয়া কঠিনতর, কঠিনতম অঙ্কগুলো গোপালবাবু-নয়ানবাবুরা বোর্ডে করে দিতেন। জটিল আঁকিবুঁকিতে বোর্ড ভ’রে যেত। বোর্ডে না কুলোলে দেওয়ালে চলে যেত চক।

বোর্ড ছাড়িয়ে দেওয়ালে চক চলে যেত অনেক অঙ্ক স্যারেরই। স্কটিশচার্চ স্কুলের অমল দত্ত স্যারও এ রকম ছিলেন। পকেট ভর্তি সিগারেট। ক্লাসটুকু বাদ দিলে বাকি সময়টা স্যারের মুখে জ্বলন্ত চারমিনার। ওঁকে কেউ কোনও দিন বসতে দেখেননি। চা ছাড়া খেতেও না। এক হাত মাথার ওপর, অন্য হাত পেটের কাছে নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে বেড়াতেন। চোখ-মুখ-জামা-প্যান্ট ভর্তি চকের গুঁড়ো।

বেঁটে মানুষ, গোড়ালি উঁচু করে ব্ল্যাক বোর্ডের মাথা থেকে অঙ্ক কষা শুরু করতেন মনের হরষে। কখন বোর্ড ছাড়িয়ে কোণের দিকে রাখা ওয়েস্টবিনের ওপরে চলে যেতেন হুঁশ থাকত না। ছাত্ররা আড়ালে তাঁকে অ্যাটিলা ডাকত। একটা সিনেমা এসেছিল ‘অ্যাটিলা দ্য হুন’। হুনদের শাসক। ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি ছিলেন পশ্চিম আর পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের ত্রাস। অ্যাটিলার দয়ামায়া একটু কম ছিল।

স্যারেদের এ রকম অনেক ডাকনাম থাকে, স্যারেরাও জানেন। মধ্য কলকাতার একটি নামী স্কুলের এক ডাকাবুকো অঙ্কস্যারের নাম ছিল গলাকাটা। তিনি ক্লাসে ঢোকা মানেই ছাত্রদের মুণ্ডুপাত। পরীক্ষায় তাঁর হাতে প্রশ্নপত্র যাওয়ার অর্থ, অশান্তির একশেষ। রাতের ঘুম দফারফা।

হরনাথ হাই স্কুলের একজন অঙ্কস্যারের নাম ছিল বোম। উনি কোনও নতুন চ্যাপ্টার শুরু করার আগে ‘ব্যোম কালী’ বলে নিতেন। অন্য একজন স্যারের ডাকনাম ছিল ‘পুঁটকি’। কারণ কিছুই না। নয় দশমিক ছয়, এ রকম না বলে, উনি বলতেন নয় পুঁটকি ছয়। বিভিন্ন অঙ্কস্যারদের অঙ্ক শেখাবার নিজস্ব কৌশল ছিল। একজন অঙ্কস্যার বোর্ডে সরল অঙ্ক কষতেন। সরল অঙ্কের নাম কী করে ‘সরল’ হয় কে জানে! নানা ব্র্যাকেট আর নানা চিহ্নে ভর্তি। উনি বোর্ড অঙ্ক করতেন, স্যারের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদেরও করতে হত। স্যার বলতেন আমার ভুল ধরো। স্যার ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে ভুল করতেন। ভুল ধরতে না পারলেই চেঁচিয়ে উঠতেন, “গাধার দল!” একটি ছেলে একবার ভুল ধরে ফেলেছিল। তাকে বলেছিলেন, “তুই গাধা নোস, ঘোড়া।”

আমাদের সময় উচ্চ মাধ্যমিকে ক্যালকুলাস ছিল না। উৎপলদের দল ক্যালকুলাস নিয়ে উৎপাত শুরু করলে নয়ানবাবু আঁকাবাঁকা ক্যালকুলাস নিয়ে পড়লেন। যা আমার মাথায় ঢুকত না।

অঙ্কের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিএসসি-তে কেমিস্ট্রি অনার্স নিলাম। ওখানেও অঙ্কের হাত থেকে রেহাই নেই। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ছিল অঙ্কে ঠাসা। এই বিষয়টা পড়াতেন সি পি দে। সবাই বলত ছিপি দে। উনি ছিলেন খুব স্টেপিং সচেতন। অঙ্কে স্টেপিং ভুল হলেই রাগ করতেন। এ দিকে সিঁড়িতে প্রায়ই স্টেপিং ভুল করে পড়ে যেতেন। আর সি ঘোষ নামে আর একজন স্যার ছিলেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসে বোর্ড লিখলেন —

১। আতঙ্ক- আ= অঙ্ক

২। X+Y-Z=S

X=আনন্দ, Y=জেদ, Z=ভয়, S=সাকসেস।

উনি একদিন ক্লাসে বলেছিলেন এ বার আমি পিথাগোরাসের তত্ত্ব প্রমাণ করে দেখাব। একটি ছেলে চেঁচিয়ে বলেছিল, “প্রমাণের দরকার নেই স্যার, এমনিতেই বিশ্বাস করি।”

ছেলেটি ক্রমশ স্যারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল। উনি বলতেন, “অঙ্ক হল আনন্দময়।”

অঙ্কে আনন্দ পাওয়া অঙ্কানন্দস্বামী আমার বন্ধুদের মধ্যে একজন আছে। অব্জনীল মুখোপাধ্যায়। ব্যাঙ্কে কাজ করছে। বিয়ে-থা করেনি। বিনে পয়সায় এলাকার ছেলেমেয়েদের আটকে যাওয়া অঙ্ক করে দেয়। বলে, “বিয়ে করলে মুদিখানার ডোবা পুকুরের অঙ্কেই ডুবে থাকতে হত। এখন অঙ্ক সাগরে স্নান করি।”

আর একজন বিবাহিত অঙ্কের অধ্যাপক বলেছিলেন অঙ্ক সলভ্ করলে ওঁর অর্গাজম হয়।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অমল রায়চোধুরীর একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম বেতারে কাজ করার সুবাদে। উনি বলেছিলেন, ভোরে উঠে কিছুক্ষণ অঙ্ক করেন, তার পর চা, খবরকাগজ, আবার অঙ্ক, স্নান, দুটো ভাত, আবার অঙ্ক... টিভি, সিনেমা? ধুর্! সময় কোথায়! কী অঙ্ক? — যা হাতের কাছে পাই।

অনেক অঙ্কপাগল স্যার আছেন, যাঁরা ‘খেয়ে ও খাইয়ে সমান তৃপ্তি’র মতো ইকোয়েশন সল্ভ করে ও করিয়ে আনন্দ পান।

একজন অঙ্ক স্যারকে জানি, আইএসআই-তে আছেন। মেয়ের বিয়ের গয়না ট্যাক্সিতে ফেলে এসে স্ত্রীকে বলেছিলেন, “কী করব বলো, মাথার ভিতরে একটা সলভ্ না হওয়া হাইড্রোস্ট্যাটিসটিক্স বুড়বুড়ি কাটছিল।”

এঁরাই আর্কিমিডিসের উত্তরসূরী। শোনা যায়, আর্কিমিডিস যখন কোনও জ্যামিতির সমাধানে ব্যস্ত, শত্রুসৈন্য খোলা তরবারি নিয়ে সামনে, আর্কিমিডিস বললেন, “মাথা কাটবে? একটু দাঁড়াও, এক্ষুনি ব্যাপারটা সলভ্ হয়ে যাবে।”

পঙ্কে জন্মানো পদ্মফুলকে বলে পঙ্কজ। আর এঁরা হচ্ছেন অঙ্কজ। বঙ্কিমচন্দ্রের জিজ্ঞাসা ছিল, ‘এ জীবন লইয়া কী করিব? কী করিতে হয়?’ এঁরা বলবেন, “কেন? অঙ্ক করিতে হয়।”

এই ধরনের অঙ্কক্ষ্যাপা স্যারেরা বোধহয় আজকের সমাজে কমে এসেছে। এখন অঙ্কস্যারেরা কর্পোরেট। ওঁদের অনেকের কোচিং সেন্টারের সামনে সার সার জুতো, সাইকেল। ওঁদের জিন-ফরমুলা আলাদা। আমাদের এলাকার এক অঙ্কস্যারের কোচিং সেন্টারটির নাম ‘ম্যাথেট্রিক্স’। বছর কয়েক আগে শিক্ষক দিবসের দিন মাইকে বেজেছিল, ‘এক দো তিন চার পাঁচ ছয় ....।’ রাস্তায় বিরিয়ানির অনেক খালি প্যাকেট।

ছাত্রজীবনে আমিও কিছু দিন অঙ্কের স্যার ছিলাম। টিউশন। একটা টিউশন এল, ক্লাস সিক্স। ছাত্রের বাবা বললেন, “রোজই আসতে হবে। ছেলেটা ফাঁকিবাজ। সামনে বসিয়ে রোজই ঘণ্টাখানেক অঙ্ক কষাবেন।”

ছাত্রের বাবার গেঞ্জির কারখানা। বললেন, “পঞ্চাশ দেব।” আমি বললাম, “ষাটের কমে করি না।”

উনি বললেন, “ষাট? মানে ডেইলি দু’টাকা? ঠিক আছে। পড়িয়ে ফেরার সময় ম্যানেজারের থেকে দু’টাকা করে নিয়ে যাবেন।”

ভাবলাম ভাল প্রস্তাব। রোজ দু’টাকা খারাপ কী? হাতখরচা ভালমতো হয়ে যাবে। ১৯৬৮-৬৯ সালে টাকায় দশটা সিঙাড়া। তখন কি বুঝেছিলাম, ডেইলি দু’টাকা মানে রবিবার কিংবা ছুটির দিনগুলোতে পয়সা পাচ্ছি না। হরে দরে পঞ্চাশই দাঁড়াল।

উনি আমার চেয়ে অনেক বেশি অঙ্ক-পাকা ছিলেন।

swapnamoy chakraborty maths teacher patrika anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy