Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পড়াশুনা...

ফার্স্ট বয়ের যন্ত্রণা

রেজাল্টের এভারেস্টে চড়ার উল্লাস তো দু’দিনের! কিন্তু চিরসঙ্গী তার অভিশাপ, খোঁজ পেলেন ঋজু বসু ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’ মফস্সলি একটি আবাসিক স্কুল থেকে বেশ কয়েক বছর আগে মাধ্যমিকে ফার্স্ট পুরনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এটাই মনে হচ্ছিল। ফার্স্ট বয় মানে তো ধরাছোঁয়ার নাগালের সচিন-শাহরুখ! সেই কাঁচা বয়সেই যার হাতের মুঠোয় রংচঙে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। যাকে দেখিয়ে বাপ-মা থেকে স্কুলের স্যারেদের ‘ওর মতো হ’-শুনতে শুনতে কত বার অসহায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠেছি।

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’

মফস্সলি একটি আবাসিক স্কুল থেকে বেশ কয়েক বছর আগে মাধ্যমিকে ফার্স্ট পুরনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এটাই মনে হচ্ছিল।

ফার্স্ট বয় মানে তো ধরাছোঁয়ার নাগালের সচিন-শাহরুখ! সেই কাঁচা বয়সেই যার হাতের মুঠোয় রংচঙে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। যাকে দেখিয়ে বাপ-মা থেকে স্কুলের স্যারেদের ‘ওর মতো হ’-শুনতে শুনতে কত বার অসহায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠেছি।

সেই কৃতী বন্ধুই তার গৌরবগাথার মুখোমুখি হতে কিছুটা আড়ষ্ট। খোঁচাতে গিয়ে লজ্জিত হয়ে যখন প্রায় রণে ভঙ্গ দেব ভাবছি, দেবজ্যোতি (নাম পরিবর্তিত) ম্লান হেসে বলল, ‘কী জানিস, তোরা যেটা গৌরব বলে ভাবতিস, আমার কাছে তখন থেকেই সেটা একটা থাপ্পড় বলে মনে হত! কলকাতার কাছে ভাল স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়তে গিয়ে টের পেয়েছিলাম, ওই চাপ নিতে পারব না! ও-সব আইআইটি-ফাইটি আমার হবে না!”

কিন্তু ফার্স্ট বয়ের শিরস্ত্রাণ যে কাঁটার মুকুট হয়ে বিঁধছে। দেবজ্যোতি বলছিল, ‘‘কষ্ট পেলেও, নিজের অ্যাম্বিশনের গণ্ডিটা তখনই কাটছাঁট করতে বাধ্য হই।’

আসন্ন বিশ্বকাপে (পড়ুন মাধ্যমিক) স্কুলের সেই ব্যাচে দেবজ্যোতি কখনওই ঠিক ব্রাজিল, জার্মানি বা আর্জেন্তিনা ছিল না। তবে নিদেনপক্ষে হল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্কের গোত্রের তো বটেই! দেখা গেল, বয়সে অন্যদের থেকে কিছুটা ছোট, শান্ত-ভদ্র, চিকন গলার ছেলেটিই মাধ্যমিকে স্কুলের সারপ্রাইজ প্যাকেজ।

সে এখন একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার কর্মী। উচ্চ মাধ্যমিকে নামী স্কুলে যন্ত্রণার পরে কলকাতার একটি সাধারণ কলেজে বিএসসি-পর্বে কার্যত অজ্ঞাতবাসে কাটায় সে। এর পরে সিভিল সার্ভিসে প্রথম বারেই উতরে গেলেও তার র্যাঙ্ক খানিকটা নিচুতে ছিল। সরাসরি আইএএস তকমা না-জুটলেও কেন্দ্রীয় সংস্থার চাকরিটা জুটে যায়।

দেবজ্যোতি ফের বলে ওঠে, “এই অবস্থায় যে কেউ ফের আইএএসে বসত! আমি ও-সব ভাবিনি। ওপরের দিকে গেলে তো সেই পলিটিক্সের ঝামেলায় ঢুকতে হত! ঘাট হয়েছে। শান্তির জীবনই ভাল। আমি আর মাপের বাইরে যেতে চাই না।”

ক্লাসের সব ফার্স্ট বয় বা গার্লরা এক রকম হয় না। কিন্তু দেবজ্যোতির ঘটনাটা তাদের অনেকের সঙ্গেই মিলবে। অন্য কেউ যা অর্জন করতে পারলে বর্তে যেত, ওরা সেটুকু করলেও শুনতে হবে, তুমি, কী করে এতটা খারাপ করলে! বা তোমার কাছে আরও ভাল-র প্রত্যাশা ছিল! এটাই কাঁটার মুকুট! জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে নিজের সঙ্গে অদৃশ্য যুদ্ধ। এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। বিখ্যাত মা-বাপের সন্তান, কী গ্ল্যামার-জগতের কোনও নামজাদার আপাত সাধারণ স্বামী বা স্ত্রীকে হয়তো যে ভার বয়ে বেড়াতে হয়।

১৯৮৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম রোশনী সেন, ১৯৯০ সালের মাধ্যমিকে ফার্স্ট সুমন্ত তিওয়ারি বা ১৯৯৫ সালের মাধ্যমিক-সেরা সঞ্জীব বসাকরা কোনও না কোনও মুহূর্তে যা বয়ে বেড়িয়েছেন।

অষ্টপ্রহর সেঁটে থাকা সাফল্যের জমকালো জামদানি ইস্ত্রির ভাঁজ নষ্ট হতে না-দিয়ে পরে থাকা, এমনকী সেটা পরেই ঘুমোতে যাওয়ার যন্ত্রণা কী জিনিস, রোশনী তা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ক্লাস এইট থেকে সাউথপয়েন্টের ফার্স্ট গার্ল রাত জেগে পড়ার জন্য মায়ের বকুনি খেতেন। রেজাল্টকে পাখির চোখ দেখে ভালবাসার ছবি আঁকা, সুইমিং থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক ও জয়েন্টে ফার্স্ট হওয়ার ডাবল-এর সঙ্গে আইআইটি-তেও তিনি সুযোগ পান।

সেখানে গিয়ে যেন অকূল সমুদ্রে পড়লেন। তখন শুনতে হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের টপারের বরাদ্দ প্রেসিডেন্ট্স গোল্ড মেডেলটা না কি ওঁর জন্যই বরাত দেওয়া আছে! রোশনী মেয়ে বলে ঘাড়ের জোয়ালটা আরও ভারী হয়ে উঠেছিল! সহপাঠীরা বলতে কসুর করছেন না, তুই একটা ছেলের সিট কেন নষ্ট করলি বল তো? এর মধ্যে হস্টেলের অসুবিধে, আচমকা নিউমোনিয়া, জন্ডিসের ‘উপহার’, পড়ার অমানুষিক চাপ সদ্য তরুণীকে হার মানতে বাধ্য করল। বছর নষ্ট করে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স বিভাগের নৌকোয় উঠলেন তিনি।

রোশনী অবশ্যই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ফল, আইএএস পরীক্ষার যুদ্ধ সসম্মানে জিতে তিনি এখন রাজ্যে উঁচুতলার আমলা। হেসে বলছিলেন, “এটাই ভাল হয়েছে! আমি ক্রমশ ক্লাসের পড়া থেকে নানা বিষয়ে ডাইভার্সিফাই করেছি, কোনও একটা দিকে আটকে থাকিনি!” কিন্তু আইআইটি-বাসের সেই একটা বছরের কথা ভাবলে এখনও দম বন্ধ হয়ে আসে! রোশনী বলেন, “আমার মেয়েও পড়াশোনায় ভাল! কিন্তু ফার্স্ট হয় না। সেটাই ভাল, নীচে অনেক রিল্যাক্সড থাকা যায়!”

চুড়ো থেকে পদস্খলনের যন্ত্রণাটা চেনেন, পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের টপার সুমন্ত তিওয়ারিও। ক্লাসে বরাবর দুই বন্ধু রাজা মুখোপাধ্যায় ও সুমন্ত তিওয়ারির জন্যই ফার্স্ট ও সেকেন্ডের দু’টো আসন নির্দিষ্ট। মাধ্যমিকে রাজাকে ফেভারিট ধরা হলেও ফার্স্ট হন সুমন্তই। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে রাজা প্রথম হলেন। সুমন্তের কথায়, “এখন ভাবলে ছেলেমানুষি মনে হয়, উচ্চ মাধ্যমিকে সেভেন্থ হয়েছি বলে আমার কী মন খারাপ হয়েছিল।”

সুমন্ত-রাজারা আইআইটি-র পাট চুকিয়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। রাজা সিলিকন ভ্যালিতে পেশাদার। সুমন্ত সাউথ ক্যারোলিনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার গবেষক-অধ্যাপক। তাঁর অভিমত, “সেই ফার্স্ট হওয়ার মধ্যে ছোটবেলার আত্মশ্লাঘাটুকু ছাড়া আর কিস্যু নেই! আইআইটি-তে গিয়েই বুঝেছিলাম, আমি কোনও রামানুজম বা জগদীশ বোস নই। বড়জোর নিজের সেরাটা দিতে পারি!” কিন্তু ১৬-১৭ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে এটা বোঝা যে খুব সোজা কাজ নয় তা জানেন কলকাতার স্কটিশ স্কুল থেকে মাধ্যমিকে প্রথম সঞ্জীব বসাক। দর্জিপাড়ার নিম্নবিত্ত বাড়ির ছেলে সঞ্জীবের বীরগাথা খবরের কাগজের প্রথম পাতার খাদ্য হয়েছিল। বাড়িতে উটকো লোকের ভিড়, কলেজে-পাড়ায় সারা ক্ষণ চেনা-অচেনায় নজরবন্দি সঞ্জীবের জীবনটাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। উচ্চ মাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল করতে পারেননি সঞ্জীব, তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এখন কলকাতায় কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত তরুণ মাধ্যমিকের মেধা-তালিকাকে নম্বর দিতে নারাজ।

টেলিফোনের ও পারে সাংবাদিক, ফের পুরনো-প্রসঙ্গ---- অস্বস্তি নিয়েই কথা বলছিলেন সঞ্জীব। থেমে থেমে বললেন, “প্রথম ১০০ জনের মধ্যেই আসলে তত ফারাক থাকে না। ফের পরীক্ষা হলে বা অন্য কারও হাতে খাতা পড়লে সব উল্টে-পাল্টে যেত!” তেমনই বিশ্বাস দীর্ঘদিন স্কুলশিক্ষার সঙ্গে জড়িত মডার্ন হাই স্কুলের ডিরেক্টর দেবী করেরও। তাঁর মতে, ক্লাসে সেরা নম্বরধারীই যে সব থেকে মেধাবী ধারণাটা ভুল। নিজে লা মার্টিনিয়র ফর গার্লসের ফার্স্ট গার্ল, কিন্তু শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর স্কুল থেকে দীর্ঘ দিন ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড তুলে দিয়েছেন দেবী। বলছেন, আমরা সব বিষয়ের জন্য কুলীন গোত্রের একটা কাট-অফ মার্কস রাখি। গ্রেড দিই! বোর্ডের পরীক্ষায় স্কুলের সেরাদের ব্যাপারে জানতে চেয়ে সাংবাদিকেরা ফোন করলেও আমি জবাব দিই না!

তবু প্রথম হওয়ার সামাজিক অহঙ্কারটার থেকে বেরোতে খুব বেশি লোকে পারেন না!--- বললেন, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। বাস্তব পরিসংখ্যান যদিও বলছে কম বয়সের কৃতিত্বের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের সাফল্যের সম্পর্ক নেই। ধরুন, হোম অ্যালোন ছবির শিশুশিল্পী ম্যাকলে কালকিনের কথা। এইটুকুনি বয়সে কিংবদন্তি, ১৪ বছর বয়সে অভিনয়ই ছেড়ে দিলেন। তারপরে ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিলতা, মাদকসুদ্ধ ধরা পড়ে জেলবাস— অশান্তির জীবন। রামানুজের মতে, “ক্লাসের ফার্স্টদের দুর্ভাগ্য হল, সে জীবনে যত মার খাবে, পুরনো বন্ধু, আত্মীয়রাও হয়তো মনে মনে খুশিই হবে! পড়াতে বসে ভুল করলে নিজের সন্তানও ‘তুমি না ফার্স্ট হয়েছিলে’, বলে বসতে পারে!”

সব ‘ফার্স্ট’রা অবশ্যই এক নন। কিন্তু লাস্ট বেঞ্চ থেকে সব্বাইকেই এক রকম দেখতে লাগে। গর্বিত ‘ব্যাকবেঞ্চার’ তথা গায়ক শিলাজিৎ যেমন বলেন, “স্কুলের ফার্স্ট বয়গুলোর সব ক’টাকে আমার কেমন আনইন্টারেস্টিং লাগত! তেল-চুপচুপে চুল, গোবেচারা! নিজের নোট আগলে রাখে। ‘টিপিনে’ দুধ-পাঁউরুটি খায়!” শুনে অভিজ্ঞ শিক্ষিকা দেবী হাসছেন, অনেক ক্ষেত্রেই উৎকর্ষ নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে যাওয়াটাই ‘ফার্স্ট’রা মোক্ষ বলে ধরেন। নম্বরের মোহে বেচারিরা অনেক সময়েই জীবনের সহজ আনন্দগুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে থাকে।

আবার মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতায় এমন একাধিক ফার্স্ট রয়েছেন, যাঁরা এই বাজার-চলতি ভালছেলে ইমেজটা ভাঙতেই প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। “ভাল স্কুলের ছাত্র কয়েক জনকে দেখেছি, ক্লাসে টিচারদের তৈরি করা চাপ, বন্ধুদের আওয়াজের ভয়ে ইচ্ছে করে পরীক্ষায় খারাপ করে আসছে!”

আগে গেলে বাঘে খায়, কথাটাই তবে অকাট্য সত্য! অন্তত যারা ফার্স্ট হয়েছেন, তাঁরা তা না-হলে কোনও ক্ষতি হত না, এমন বিশ্বাসে যখন প্রায় থিতু হয়ে বসেছি, তখনই কথা হল আইএএস-কর্তা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। “মফস্সলের ছেলে ছিলুম, অঙ্কে কাঁচা, ইংরিজি বড় হয়ে শিখেছি, পরীক্ষার ওই রেজাল্টটাই সারা জীবন লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছিল।”

অঙ্কে ৭৭ পেয়েও মাধ্যমিকে থার্ড হয়েছিলেন আলাপন। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে তাঁদের ব্যাচে তিনিই প্রথম। “মাধ্যমিকের পরেই সাহস পেলাম, আমার ভাল লাগার বিষয়, ভাল লাগার জগৎ নিয়ে জীবন কাটাতে।”

পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও এমএ-র প্রথম আলাপন। তাঁর পুত্র প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলিন্দও সব পরীক্ষায় বরাবরের প্রথম, ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিশ্বাস্য নম্বরের অধিকারী। নম্বর মিলিন্দের কাছেও বোঝা হয়নি, বরং আত্মবিশ্বাসের স্মারক।

প্রথম হওয়ার বিষয়টাকে সাংঘাতিক আমল না-দিলেও তাতে এত বিচলিত হওয়ারও যে কিছু নেই, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য সচিব প্রসাদরঞ্জন রায় সেটা বোঝালেন। “কী মুশকিল, একজনকে তো ফার্স্ট হতেই হবে। ব্যাপারটা অত সিরিয়াসলি না-নিলেই হল।” বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ফার্স্ট বয়, হায়ার সেকেন্ডারিতে সেকেন্ড প্রসাদবাবু।

ফার্স্ট যিনি হয়েছিলেন, সেই বাসন্তীনারায়ণ স্বামীও একসঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স নিয়ে ভর্তি হলেন। পরে ফের প্রসাদরঞ্জনই ফার্স্ট। কিন্তু ‘‘সেটা আমি একটু চটপটে ছিলাম বলে’’---হাল্কা চালে বললেন প্রসাদবাবু। তাঁর কথায়, “আমরা ক্লাস কেটে সিনেমা দেখেছি, খিস্তিখাস্তা করেছি, পড়াশোনাও করতাম। রেজাল্ট জীবনের অঙ্গ। কিন্তু জীবন নয়! এ ভাবেই দেখা উচিত।”

ভিন্ন প্রজন্মের মানুষ, একটি কর্পোরেট সংস্থার উঁচুতলার কর্তা সুপ্রিয় সিংহও সে-ভাবেই জীবনকে দেখেন। “ক্লাস সিক্সে ফার্স্ট হওয়ার সময়ে আমি ও পরীক্ষার র্যাঙ্ক প্রায় সমার্থক ছিল! পরে বুঝতে পারি জীবনটা ঢের বড়।”

সেন্ট জেভিয়ার্সে সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে নাগাড়ে ফার্স্ট হয়েছেন সুপ্রিয়। ক্লাস এইট থেকে বাথরুমে বসে মনে-মনে মাধ্যমিকে ফার্স্ট হলে কী ইন্টারভিউ দেবেন, তার মহড়া দিতেন। ’৯৩ সালে মাধ্যমিকে টেন্থ হওয়ার পরে করুণ চোখে কোনও সাংবাদিক আসে কি না, অপেক্ষাই সার হল! তবে এইচএসে ফার্স্ট হয়ে পুষিয়ে দিতে পেরেছিলেন। পরেও আইআইটির মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট বা আইআইএম জোকা-র সোনার পদকধারী কিন্তু বলছেন, ভাল ‘এগজামিনেশন স্টুডেন্ট’ হওয়াটা তাঁকে এখনও জীবনে চলতে দারুণ সাহায্য করে।

কী ভাবে? সুপ্রিয়ের ব্যাখ্যা, “তখন দশ বছরের প্রশ্ন ঘেঁটে কী আসতে পারে আঁচ করে টার্গেট সেট করতাম। এখনও প্রতি ছ’মাসে দেখি আমি কোথায় দাঁড়িয়ে, কী কী কাজ বাকি! সেই মতো নিজের ডেডলাইন সেট করি!”

কিন্তু ফার্স্ট বয়ের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ জীবনভর তাড়া করার অস্বস্তি অনেকেই কাটাতে পারেন না! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ গল্পটা মনে পড়ল। মফস্সল স্কুলের ফার্স্ট বয় নায়ক মাধ্যমিকেও নাইন্থ হলেন। তার পরে জীবনে বলার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু লোকের মুখে নিজের অতীত গৌরবের কাহিনি যেন ছ্যাঁকা দিত। বাদ্লা রাতে একলা হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবতেন, আ-হা, তুচ্ছ হয়ে বাঁচার কী আনন্দ! নায়কের নাম জোনাকী রেখেছিলেন শীর্ষেন্দু।

স্কুলের ফার্স্ট বয় বন্ধু অনুরোধ করল, প্লিজ আমার নামটা লিখিস না! পুরনো কাসুন্দি নিয়ে নাড়াঘাঁটা ভাল লাগে না রে!

ফার্স্ট বয়’রা শুনছ

• পা যেন মাটিতে থাকে
• ফাঁকতালে ফার্স্ট হওয়ার থেকে সেরাটা দিয়ে থার্ড হওয়াই ভাল
• মনে রেখো, খেলাধুলো, নাচগান, জীবনের সব দিকেই ফার্স্টরা থাকে
• বন্ধু বা আর কাউকে খাটো করে দেখো না
• ক্লাসের পরীক্ষার থেকে জীবন বড়
• সাফল্য সহজ ভাবে নাও, ব্যর্থতাও জীবন
• নিজের ভুলচুক নিয়ে খুঁতখুঁতুনি কমিয়ে হাসতে শেখো
• অন্যদের ঠাট্টায় নিজের সেরাটা লুকিয়ে রেখো না

(ভুক্তভোগীদের পরামর্শের ভিত্তিতে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patrika riju basu first boy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE