Advertisement
E-Paper

মায়ের জীবনী লিখব না মা পছন্দ করবেন না

কত কত প্রশ্নের ঝাঁপি রয়েছে বাঙালি জীবনের চির রহস্যময়ী নায়িকা সম্পর্কে। কেন বেছে নিয়েছিলেন এই জীবন? নিজের শবদেহ সম্পর্কে কী নির্দেশ ছিল তাঁর? মায়ের মৃত্যুর ৮০ দিন বাদে প্রথম মুখ খুললেন মুনমুন সেন। সামনে গৌতম ভট্টাচার্য। কত কত প্রশ্নের ঝাঁপি রয়েছে বাঙালি জীবনের চির রহস্যময়ী নায়িকা সম্পর্কে। কেন বেছে নিয়েছিলেন এই জীবন? নিজের শবদেহ সম্পর্কে কী নির্দেশ ছিল তাঁর? মায়ের মৃত্যুর ৮০ দিন বাদে প্রথম মুখ খুললেন মুনমুন সেন। সামনে গৌতম ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫

পত্রিকা: শুনেছি গত জন্মদিনেও আপনার মা ‘হসপিটাল’-এর গানটা গেয়েছিলেন, এই ‘সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’।

মুনমুন: তাই? হতে পারে। আমার ঠিক মনে নেই।

পত্রিকা: এমনিতে কী করতেন উনি জন্মদিনে? এই যে কাগজে কাগজে বিশেষ সুচিত্রা সেন সংখ্যা বার হয়। চ্যানেল খুললেই ওঁর গান বাজতে থাকে। সবই উনি দেখে গিয়েছেন। একটা রেশ নিশ্চয়ই তো ওঁর উপর পড়ত...

মুনমুন: তেমন কিছু নয়। উনি ওঁর নিজের মতোই থাকতেন। যেমন আর পাঁচটা দিন ওঁর কাটত। হয়তো ভিজিটার্স কিছু বেশি আসত। খুব জোর আত্মীয়স্বজন। মাসি বা মাসির মেয়েরা এল। রিয়া-রাইমার সঙ্গে গল্প করলেন।

পত্রিকা: আপনার জন্মদিন ২৭ মার্চ। আপনার মায়ের ৬ এপ্রিল। মাত্র আট-ন’দিনের এ-দিক ও-দিক। কখনও আপনাদের জয়েন্ট বার্থ ডে পার্টি হয়েছে?

মুনমুন: নাইস থট। কিন্তু কখনও সে ভাবে ভাবা হয়নি।

পত্রিকা: শুনেছি আপনার ফিল্মে নামা নিয়ে ওঁর খুব আপত্তি ছিল।

মুনমুন: ইয়েস, শি ওয়াজ লিভিড।

পত্রিকা: ধরেই নেওয়া যায় আপনার বাঁকুড়া থেকে দাঁড়ানো নিয়েও ওঁর তীব্র আপত্তি থাকত।

মুনমুন: অ্যাবসোলিউটলি। মা নিশ্চয়ই আমার জন্য খুব চিন্তিত হয়ে পড়তেন।

পত্রিকা: আগেকার দিনে ফিল্মস্টারদের রাজনীতিতে আসার এই অভ্যাসটা তত হয়নি। তবু সুচিত্রা সেন কখনও রাজনীতিতে নামার ডাক পাননি?

মুনমুন: পেয়েছিলেন। সেভেনটিজ্ কি আর্লি এইট্টিজ্ হবে। কংগ্রেস ওঁকে চেয়েছিল।

পত্রিকা: গেলেন না কেন?

মনুমুন: শি ওয়াজ নেভার ইন্টারেস্টেড। এমন নয় যে কোথায় কী হচ্ছে উনি খোঁজ রাখতেন না। যথেষ্ট রাখতেন। রাজীব গাঁধী মারা যাওয়ার খবরটা উনিই আমায় প্রথম ফোন করে জানিয়েছিলেন। তখনও অর্ধেক লোকে খবর পায়নি।

পত্রিকা: কোথা থেকে জেনেছিলেন উনি?

মুনমুন: নো আইডিয়া। আই সাপোজ কেউ ওঁকে ফোন করে খবর দিয়েছিল।

পত্রিকা: কেউটা কে হতে পারে?

মুনমুন: ওঁর দু’একজন এডিটর বন্ধু ছিলেন। তাঁদের কেউ হতে পারে।

পত্রিকা: এই যে বাইরের জগতের সঙ্গে টানা ছত্রিশ বছর যোগাযোগ না রেখে স্রেফ অন্দরমহলে কাটিয়ে দিতে পারা। এটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার।

মুনমুন: ছত্রিশ বছর কেন?

পত্রিকা: তাই তো দাঁড়াচ্ছে। ‘প্রণয় পাশা’ রিলিজ করেছিল ১৯৭৮ সালে। তার কিছু মাস পর থেকেই তো উনি লোকচক্ষুর আড়ালে।

মুনমুন: নট রিয়েলি। এইট্টিজেও উনি নিয়মিত বেরিয়েছেন। রিয়া-রাইমাদের নিয়ে এসি মার্কেট-টার্কেট যেতেন। আমার যত দূর মনে পড়ছে আর্লি নাইনটিজ থেকে উনি মোটামুটি বাড়িতেই থাকা শুরু করলেন। খুব কম বেরোতেন-টেরোতেন। সো আই গেস্ টোয়েন্টিফোর ইয়ার্স হবে পাবলিক আই-এর বাইরে থাকা।

পত্রিকা: বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তো অবশ্যই। বলিউডেও এমন স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাসের কথা কেউ কখনও শোনেনি বা দেখেনি। মা-কে কখনও জিজ্ঞেস করে দেখেছেন? কেন চির অন্তরালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

মুনমুন: আপনারা যেটা চির অন্তরালে বলে থাকেন। বা অনেকে যেটা বলে থাকে, আড়ালে চলে গিয়ে নিজের স্টারডম রেখে দেওয়া, দ্যাট কেম ভেরি ন্যাচরালি টু হার। আই ডোন্ট থিঙ্ক দেয়ার ওয়াজ আ গ্রেট ডিল অব স্ট্র্যাটেজি ইনভলভড্ ইন দিজ্। কোনও চতুর ফন্দিটন্দি ছিল না। ওঁর মনে হয়েছিল ওঁর জীবনের একটা অংশ অভিনয় ছিল, যেটা আর নেই। শেষ হয়ে গিয়েছে। সো শি হ্যাড মুভড্ অন। উনি আর পিছনে ফিরে তাকাননি। লোকে এই যে বলে ইমেজ অটুট রাখার জন্য সরে যাওয়া আমার শুনলে অবাক লাগে। কেন তাঁরা স্বাভাবিক ভাবে ভাবতে পারেন না! আচ্ছা আমরা কি যে স্কুলে-টুলে পড়েছি সেখানে আবার যাই? আমায় বলুন তো?

পত্রিকা: হয়তো নিয়মিত যাই না। কিন্তু যেতে তো ইচ্ছে করে। বা গেলে তো অসম্ভব নস্ট্যালজিয়াও অনুভব করি।

মুনমুন: উনি সে ভাবে ভাবেননি। ওঁর মনে হয়েছিল যেটা পিছনে চলে গেছে সেটা চলে গেছে। তাকে নিয়ে আর টানাটানি করার মানে হয় না।

পত্রিকা: তা-ও কখনও মনে হয়নি একবার আমার কর্মভূমিটা ঘুরে দেখি। এনটিওয়ান বা টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয় যাই, দেখি কেমন আছে?

মুনমুন: বললাম তো, মা নেভার লুকড্ ব্যাক। আমার নিজের কখনও মনে হয় না, যে সব স্টুডিয়োয় কাজ করেছি সেগুলো গিয়ে দেখে আসি।

পত্রিকা: টিভিতে নিজের পুরনো ছবিটবি দেখলে ওঁর নস্ট্যালজিক লাগত না?

মুনমুন: আমার কখনও মনে হয়নি উনি সেগুলো চালিয়ে দেখেছেন বলে। বরঞ্চ কোনও ভিজিটর সেগুলো নিয়ে কথা বলতে-টলতে গেলে আমি ওঁকে বিরক্ত হতেও দেখেছি। এক এক সময় হয়তো ভাবতেন অমুকের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। তার পর আবার ডিসিশন চেঞ্জ করতেন। বলতেন, সেই তো এলে আবার বলবে, অমুক ছবিতে আপনাকে তমুক লেগেছিল। ওটাতে ওই সিনটায় আপনি যা করেছিলেন।

পত্রিকা: উত্তমকুমার মারা যাওয়ার আগে ওঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না?

মুনমুন: মনে হয় না। উত্তমকে আমি মাত্র একবার আমাদের বাড়িতে দেখেছি। মা-কে কোনও একটা ফাংশনে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। এর বাইরে কখনও দেখিনি।

পত্রিকা: মারা যাওয়ার পরেও মা-কে কখনও উত্তম নিয়ে কথা বলতে শোনেননি?

মুনমুন: হয়তো এক-আধবার হাল্কা কথা হয়েছে। কিন্তু বিরাট কোনও ডিসকাশন কখনও হয়নি। আমার এক এক সময় মনে হয়েছে উত্তমকুমার হয়তো মায়ের খুব ফেভারিট কলিগ। কিন্তু রোজকার বন্ধু বলতে যেটা বোঝায়, সেটা উত্তম ছিলেন না। বরং সঞ্জীবকুমার ওয়াজ আ ফ্রেন্ড। কলকাতা এলে সঞ্জীব আমাদের বাড়িতে থাকতেনও।

পত্রিকা: সারা দিন কী করতেন আপনার মা?

মুনমুন: নিজের মতো থাকতেন। একটা সময় কাগজ পড়তেন। টিভিতে নিয়মিত নিউজ চ্যানেল দেখতেন। তার পর সেটাও বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেন।

পত্রিকা: নিউজ চ্যানেল দেখা বন্ধ করে এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেল চালাতেন?

মুনমুন: না, না, সেটার তো কোনও প্রশ্নই নেই।

পত্রিকা: বাংলা সিরিয়াল-টিরিয়াল দেখার প্রশ্ন নেই!

মুনমুন: নাহ্। তবে গান শুনতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষ করে।

পত্রিকা: তাই?

মুনমুন: হ্যাঁ, ওঁর খুব পছন্দের গায়ক ছিল শ্রীকান্ত আচার্য। বলতেন, ছেলেটার গলাটা খুব মিষ্টি। একবার একটা ফাংশনে দেখা হতে শ্রীকান্তকে বলেও ছিলাম সেটা। ও বোধহয় বিশ্বাস করেনি।

পত্রিকা: কম্পিউটার ছিল ওঁর ঘরে?

মুনমুন: না। ও সব করেননি। তবে মোবাইল একটা শেষের দিকে ছিল ওঁর।

পত্রিকা: বলছেন কী! সুচিত্রা সেনের মোবাইল ছিল? লোকে জানলে তো শুধু অনর্গল ডায়াল করে যেত!

মুনমুন: মোবাইল ছিল কিন্তু ইউজ করতে দেখিনি কখনও।

পত্রিকা: একটা রহস্য রহস্যই থেকে গিয়েছে।

মুনমুন: কী?

পত্রিকা: এত প্রাইভেট এবং ডমিনেটিং একজন মানুষ।

মুনমুন: হু।ঁ

পত্রিকা: তিনি স্ব-ইচ্ছায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন কেন?

মুনমুন: শুধু তো মমতা নন। বছরখানেক আগে বেলভিউতে উনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন, তখন আমাদের গভর্নর গোপালকৃষ্ণ গাঁধী দেখতে গিয়েছিলেন। জাস্ট খবর নিতে এসেছিলেন। মায়ের ঘরে এমনি এমনি যেতে চাননি। আমি যখন মাকে গিয়ে বলি, উনি নিজে থেকেই বলেন, ওঁকে নিয়ে এসো। মমতার বেলাতেও তাই। সিএম খবর নিতে এসেছেন জানতে পেরে মা-ই দেখা করতে চান।

পত্রিকা: সেটার কারণটা কী মনে হয়?

মুনমুন: মনে হয় দুজনের ক্ষেত্রেই ওঁরা কে এবং কী কী কাজ করেছেন, সে সব সম্পর্কে মায়ের যথেষ্ট ধারণা ছিল।

পত্রিকা: শুনেছি আপনার মা টিভিতে ক্রিকেট দেখতেন? উনি নাকি সচিনের খুব ফ্যান ছিলেন!

মুনমুন: সচিনের ফ্যান কি না বলতে পারব না। বাট একটা সময় শি ইউজড্ টু ওয়াচ ক্রিকেট। খুব ভালবাসতেন।

পত্রিকা: এমএল জয়সীমার মৃত্যু-পরবর্তী জীবনীতে রয়েছে কলকাতায় রঞ্জি খেলতে আসা হায়দরাবাদ টিমের অনুরোধে উনি নাকি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে দেখাও করতে গিয়েছিলেন।

মুনমুন: হতে পারে। যত দূর জানি ওঁদের জন্য জয়সীমাকে এক বোতল শ্যাম্পেনও পাঠিয়ে ছিলেন। জয়সীমা-পটৌডি এঁদের উনি চিনতেন। ইনফ্যাক্ট একবার যুদ্ধের সময় ক্রিকেটারদের সই করা একটা ব্যাট উনি কিনেছিলেন। এতে দে ওয়্যার এক্সট্রিমলি টাচড্।

পত্রিকা: উনি মারা যাওয়ার পর টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিকে সে ভাবে আশেপাশে দেখা গেল না। অনেকেরই মনে হয়েছে এর কারণ টালিগঞ্জের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

মুনমুন: যোগাযোগ তো সত্যিই ছিল না। উনি যাঁদের ভাল চিনতেন-টিনতেন তাঁরা বেশির ভাগই তো মারা গিয়েছেন।

পত্রিকা: এই যে ওঁর একজন একজন করে সঙ্গী বিচ্ছেদ হচ্ছিল... উত্তমকুমার থেকে শুরু করে প্রিয় বন্ধুরা সব হারিয়ে যাচ্ছিলেন ওঁর জীবন থেকে। এই এক-একটা মৃত্যু কতটা আলোড়িত করত ওঁকে?

মুনমুন: গৌতম, ইউ মাস্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, এই ইন্টারভিউটা দিচ্ছি মানে এই নয় যে মা-র লাইফে কী কী ঘটেছিল, আমি সব উজাড় করে বলে দেব। কিছু কিছু জিনিস খুব প্রাইভেট। সেগুলো প্রাইভেটই থাক।

পত্রিকা: উনি মারা যাওয়ার অনেক আগেই কিছু দিন পর পর একটা সময় গুজব রটত, সুচিত্রা সেন মারা গিয়েছেন। আর সেটা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ত। জানতে পারতেন আপনারা?

মুনমুন: জানতাম। অনর্থক গুজব রটছে জানতাম।

পত্রিকা: আমাদের ধারণা ছিল উনি মারা গেলে লোকচক্ষুর অন্তরালে মিডিয়াকে আড়ালে রেখে ওঁর সৎকার করা হয়ে যাবে। পরে লোকে জানতে পারবে। সত্যিই এ রকম কোন পরিকল্পনা ছিল?

মুনমুন: না, তবে উনি বারবার বলেছিলেন, আমাকে অন্য কোথাও নিয়েটিয়ে যেয়ো না। আমি যেন সোজা যেতে পারি।

পত্রিকা: মানে আমার শবদেহ রবীন্দ্রসদন বা নন্দনে রেখোটেখো না।

মুনমুন: আই গেস্ ইট মেন্ট যে আমার নতুন জার্নিতে যেন আমি সোজা রওনা হয়ে যেতে পারি।

পত্রিকা: মেয়ে হিসেবে নিজের কোথাও একটা স্যাটিসফ্যাকশন হয় যে আপনার মা বহির্জগতের কাছে অধরা থাকতে চেয়েছিলেন এত বছর। মৃত্যুর পরেও তিনি তো অধরাই থেকে গেলেন। কোনও টিভি চ্যানেল তাঁর ছবি তুলতে পারল না। কোনও ফোটোগ্রাফার ওঁর ছবি পেল না। শ্মশানযাত্রী সকলেও ভাল করে মুখটা দেখতে পেলেন না। প্রাইভেট যেমন ছিলেন সে ভাবেই চলে গেলেন।

মুনমুন: মনে হয় ঠিকই যে মা হয়তো এটাই চেয়েছিলেন আর মেয়ে হিসেবে এই কর্তব্যটা আমি করতে পেরেছি। কিন্তু মমতা পাশে না দাঁড়ালে কাজটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।

পত্রিকা: মায়ের ঘরে এখন ওঁর ছবি টাঙিয়েছেন?

মুনমুন: হ্যাঁ, হ্যাঁ টাঙিয়েছি। বেঁচে থাকার সময় তো করতে দেননি। বলেছিলেন, আমি মারা গেলে তোমার যা ইচ্ছে কোরো।

পত্রিকা: আর বেঁচে থাকতে ওঁর কথাই তো ছিল শেষ কথা!

মুনমুন: ওরে বাবা। শি ওয়াজ ভেরি স্ট্রং মাইন্ডেড।

পত্রিকা: আপনাদের একসঙ্গে তোলা কোনও রিসেন্ট ছবি নেই?

মুনমুন: না।

পত্রিকা: কেন?

মুনমুন: আমি নিজে ওঁর প্রাইভেসিকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করেছি। কখনও বাড়তি উঁকিঝুঁকি দিইনি। নিজের মা হলেও না। তবে রিসেন্টলি ওঁকে রাজি করিয়েছিলাম যে মা, তুমি আমি রিয়া-রাইমা মিলে চলো একটা গ্রুপ ছবি তুলি। তার পর সেটা নাহয় সবাইকে দেখাব।

পত্রিকা: উনি রাজি হয়েছিলেন?

মুনমুন: স্ট্রেঞ্জলি, উনি হেসে বলেছিলেন ঠিক আছে। তুমি যখন বলছ শিয়োর তুলব। অ্যাজ লাক উড হ্যাভ ইট, ছবিটা আর তোলাই হল না। এখন ভাবলে আফসোস হয়।

পত্রিকা: আপনাদের একসঙ্গে লাস্ট ছবি কবে তোলা?

মুনমুন: কবে...কবে... বছর সাতেক তো হবেই।

পত্রিকা: ছবিটা তোলা হল না ভাবলে খারাপ লাগে।

মুনমুন: সবচেয়ে খারাপ লাগে যে সামান্য একটা কাশি হচ্ছিল বলে নার্সিং হোমে ভর্তি করলাম। সেখান থেকে আর বাড়ি ফেরত আনা গেল না। আমি ভাবতেই পারিনি যে মা-কে আর ফেরত আনতে পারব না।

পত্রিকা: হ্যাঁ ফেরত এলেন শববাহী গাড়ির সঙ্গে।

মুনমুন: বেল ভিউ থেকে বাড়িতে এনেছিলাম। এক মিনিটও নষ্ট করিনি। সঙ্গে সঙ্গে কেওড়াতলা।

পত্রিকা: ওপরে ওঁর ঘরে নিয়ে যাননি কেন?

মুনমুন: চেয়েছিলাম যত তাড়াতাড়ি হোক, কাজটা হয়ে যাক। ওঁর কথা মতোই ওঁর নতুন জার্নিতে আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। শ্মশানে বসেও ভাবছিলাম কী অসম্ভব সহ্যশক্তি। নার্সিংহোমে যখন ওই রকম মোটা মোটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে তখনও মুখে হাসি। আমি যখন বলেছি, মা, লাগছে? তখনও বলছেন না। অসম্ভব কারেজ ছিল। কোনও কিছুতে ঘাবড়াতেন না।

পত্রিকা: তাই?

মুনমুন: ইয়েস। একবার টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো থেকে বেরোবার সময় এক দল মস্তান ওঁকে ঘিরে ধরেছিল। মা তখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন। ঘোর নকশালরাজ ছিল সেই সময়। অন্য কেউ হলে ভয়ে অস্থির হয়ে যেত। মা তাঁদের প্রচণ্ড ধমকে গাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন।

পত্রিকা: আজ উনি নেই। ওঁর ফ্ল্যাটের লাগোয়া আপনার দরজা। বার বার মনে পড়ে না?

মুনমুন: প্রতি সেকেন্ডে মা-কে মিস করি।

পত্রিকা: শোনা যায় আপনার মায়ের ভেতরে একটা গভীর শোক ছিল। সেই শোক সারা জীবন তিনি আর ভুলতে পারেননি।

মুনমুন: সেটা আবার কী?

পত্রিকা: ওঁর নাকি এক পুত্রসন্তান হয়েছিল। জন্মের কিছু দিন পরেই সে মারা যায়।

মুনমুন: এটা কে বলল?

পত্রিকা: আপনার মায়ের ওপর লেখা একটা বইতে পড়েছি।

মুনমুন: আটার রাবিশ বললে কম বলা হয়। কত আজগুবি গল্প যে মা-কে নিয়ে লেখা হয়েছে কোনও সীমা-সংখ্যা নেই। মায়ের কোনও বাচ্চা জন্মে মারা গিয়েছিল বলে কোনও দিন শুনিনি। ইয়েস আই হ্যাড আ বেবি হু ডায়েড প্রিম্যাচিওরলি। মা কোথা থেকে এর মধ্যে এল?

পত্রিকা: আপনি একবার বলেছিলেন, সুচিত্রা সেন বলিউড নয়, সব সময় হলিউড অভিনেত্রীদের কথা বলতেন।

মুনমুন: অ্যাবসোলিউটলি। মা ভীষণ ভালবাসতেন। লিজ টেলর, ইনগ্রিড বার্গম্যান, সোফিয়া লোরেন এঁদের ছবি দেখতে। আমাকে সব সময় বলতেন।

পত্রিকা: মানে স্টাইল অ্যান্ড ফ্যাশনে হলিউডই ছিল ওঁর বেঞ্চমার্ক?

মুনমুন: অফকোর্স। আমার মা ভীষণ স্টাইলিশ ছিলেন। ওঁর সেন্স অব ফ্যাশন আমার ছোটটার মধ্যে আমি কিছুটা দেখতে পাই।

পত্রিকা: লোকে তো বলে ব্যক্তিজীবনেও হলিউডকে তিনি অনুসরণ করতেন। গ্রেটা গার্বো একই ভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন বাইরের জীবন থেকে। একেবারে অন্তরালে থাকতেন। আপনার মা যা করেছেন। ওঁকে তাই অনেকে ‘গ্রেটা গার্বো অফ ইন্ডিয়া’ বলত।

মুনমুন: আমার মনে হয় না গার্বোর সঙ্গে এই তুলনাটা ফেয়ার। গার্বোর ইংরেজি বলায় সমস্যা ছিল। সামাজিক জীবনে মেলামেশা করায় সেটা একটা সমস্যা। আমার মায়ের সেই প্রবলেম ছিল না। লোকে আর একটা ব্যাপার বুঝতে ভুল করে। তা হল মা কোনও দিনই খুব সোশ্যাল ছিলেন না। কেরিয়ার পুরোদমে চলার সময়ও উনি খুব কম বেরোতেন। শি ওয়াজ নেভার আ সোশ্যাল পার্সন। ওঁর পৃথিবীটা ছিল আমাদের নিয়ে। মেয়ে, নাতনি, বন্ধুবান্ধব, ইন্ডাস্ট্রির দু’চারজন মানুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সেই সোসাইটিটা একেবারে কমে গিয়েছিল। ওঁর বন্ধুবান্ধব বেশির ভাগই মারা যান। তাই মনে হয়েছিল বুঝি সবার আড়ালে পর্দানশিন। তা তো সত্যি সত্যি ছিলেন না।

পত্রিকা: আপনি কি জানেন টালিগঞ্জে একটা সময় চালু রসিকতা ছিল, রাইমাকে বিয়ে করো। তার পর যে-ই দিদিমা আশীর্বাদ করতে আসবেন, ধড়ফড় করে উঠে বোলো, ম্যাডাম, সব কিছু শুধু এই মুহূর্তটার জন্য!

মুনমুন: হা হা...মা একটা সময় রাইমাকে বলতেন ঠিক আছে, এখন বিয়ে কোরো না। তার পর মা-ই আবার মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে আমায় বলা শুরু করলেন, “কী ব্যাপার, ও বিয়ে করবে না? আমার জামাইকে আমি বরণ করব না?” জানি না, মৃত্যুর কোনও আভাস পেয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু কথাটা হঠাৎ করে বলেছিলেন।

পত্রিকা: মনে করুন আজ ফিল্মে আবির্ভাব ঘটছে রমা সেনের। পারতেন মানিয়ে নিতে? এই ২৪x৭ নিউজ চ্যানেল সারাক্ষণ গায়ের ওপর। আনন্দ প্লাস-য়ের ফোটোগ্রাফার অহরহ ফোন করছে, ম্যাডাম কখন ফার্স্ট লুক-এর ছবি তুলতে আসব?

মুনমুন: মনে হয় না উনি হ্যান্ডেল করতে পারতেন বলে। মিডিয়ার কাছে চিরকাল কার্যত উনি অধরা ছিলেন। প্রেস-কে কখনও খুব কাছে ঘেঁষতে দেননি। আমার ধারণা এই অ্যাটিটিউডটা যখনই উনি জন্মান, ওঁর থাকত। তা ছাড়া সময়টাই অন্য রকম ছিল। একেবারে ডিফারেন্ট এরা। মায়ের সামনে কেউ সিগারেট ধরাত না অবধি। তবে ভাল ছবি হয়তো আরও পেতেন। এখন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কত ভাল ভাল কাজ হচ্ছে। ভাল ভাল ডিরেক্টর এসেছে। মধ্যিখানে একটা লম্বা সময়, যখন উনি কাজ ছেড়ে দিলেন, সেখান থেকে অঞ্জন চৌধুরী ‘শত্রু’ ছবি নিয়ে আসা পর্যন্ত ভাল কোনও কাজই হচ্ছিল না। আমার মনে হয় আধুনিক সময়ে এলে সেটা হত না। ভাল কাজের জন্য এত বড় টাইম গ্যাপের মধ্যে ওঁকে পড়তে হত না। এখন কত ভাল ভাল ব্রাইট একঝাঁক ডিরেক্টর রয়েছে। সৃজিত, মৈনাক, টোনি, কৌশিক...মা একটা সময় ভাল স্ক্রিপ্ট পাচ্ছিলেন না। আমি বরং জোর করতাম। করো না, করো না... উনি বলতেন ধুর, স্ক্রিপ্ট আগে পছন্দ হোক।

পত্রিকা: আপনি নিজে কখনও মায়ের জীবনী লিখবেন না? কন্যার লেখা মৃত্যু-পরবর্তী বায়োগ্রাফি!

মুনমুন: না, আমি প্রচুর ছবি দিয়ে একটা বই করব হয়তো। যেখানে ছবির সঙ্গে ছোট স্টোরির মতো লম্বা ক্যাপশন থাকবে। কিন্তু বায়োগ্রাফি নয়।

পত্রিকা: সে কী! আপনি তো ওঁর অথেন্টিক জীবনী লেখার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ লোক...

মুনমুন: আমার মনে হয় না কাজটা ওঁর একেবারেই পছন্দ হবে বলে। শি ওয়াজ আ ভেরি প্রাইভেট ওম্যান। আমি সেই প্রিভেসিকে ওঁর মৃত্যুর পরেও সম্মান দিতে চাই।

পত্রিকা: আপনার ইন্টারভিউয়ের একটা হেডিং সাজেস্ট করুন না।

মুনমুন: কোন ইন্টারভিউয়ের?

পত্রিকা: এই যেটা দিচ্ছেন!

মুনমুন: এই হেডিংটা দিতে পারেন। দ্য স্টোরি অফ আ ভেরি বিউটিফুল ওম্যান।

পত্রিকা: আপনি তো একটা সময় খুব মন দিয়ে ফোটোগ্রাফি করতেন। কখনও মা-র স্পেশ্যাল ছবিটবি তুলেছেন?

মুনমুন: একবার তুলেছিলাম মুম্বইয়ের একটা ম্যাগাজিনের জন্য। মা মেক আপের জন্য রেডি হচ্ছেন।

পত্রিকা: ফোটোগ্রাফার হিসেবে ওঁর কোন অ্যাঙ্গেলটা সবচেয়ে ভাল ছিল?

মুনমুন: যে কোনও অ্যাঙ্গেল থেকে। শি ওয়াজ ভেরি বিউটিফুল।

পত্রিকা: আরে সেরা সুন্দরীরও তো একটা ফেভারিট অ্যাঙ্গেল থাকে। কারও লেফ্ট প্রোফাইল। কারও রাইট প্রোফাইল। কারও একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল... ওঁর ক্ষেত্রে কোনটা ছিল?

মুনমুন: সেটাই তো বলছি। দেয়ার ওয়াজ নো সাচ অ্যাঙ্গেল। এমন নয় যে দারুণ গয়নাগাটির শখ ছিল। এমন নয় যে সারাক্ষণ দামি শাড়িটাড়ি পরে থাকতেন। গায়ত্রী দেবীকেও তাই দেখেছি। মা বা গায়ত্রী দেবী ওঁদের বাড়তি কিছুর দরকার পড়ত না। সুন্দর মুখটাই ছিল সবসব চেয়ে বড় গয়না। দ্যাট বিউটিফুল ফেস ওয়াজ গুড এনাফ!

শুনে পুরো ছিটকে গিয়েছিলাম কেন? বলছেন শ্রীকান্ত আচার্য

সালটা বোধহয় ২০১২। নিকো পার্কের কাছে একটা ‘অ্যাওয়ার্ড সেরিমনি’। সেখানে আমি দু’-তিনটে পুরস্কার পেয়েছিলাম।

মঞ্চে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুনমুন সেন। পুরস্কার হাতে তুলে দিয়ে মুনমুন সেন আমায় কনগ্র্যাচুলেট করার পর নিচু গলায় বললেন, “আপনার সঙ্গে দেখা হয় না। তাই বলাও হয় না। একটা কথা বলি, আমার মা কিন্তু আপনার গান খুব পছন্দ করেন।” এর আগে মুনমুন সেনের সঙ্গে আমার একটা পোশাকি আলাপ ছিল। কিন্তু তাতে এ সব কিছু শুনিনি।

সে দিন কথাটা শুনে পুরো ছিটকে গিয়েছিলাম। সুচিত্রা সেন?... আমার গান...পছন্দ করেন?...আমি কোন হরিদাস...!! অবিশ্বাস্য তো লাগছিলই, তার সঙ্গে দমবন্ধ করা ভাল লাগা, তোলপাড় করে দেওয়া উত্তেজনা। এমনিতে আজও টিভিতে ওঁর ছবি হলে ছাড়ি না। কত লক্ষ বার যে ‘সপ্তপদী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দেখেছি... গুনে বলতে পারব না। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ দ্য বেস্ট লাগে।

ছোটবেলা থেকেই আমি ওঁর ফিল্মের পোকা। ওঁর লিপে সন্ধ্যাদির (মুখোপাধ্যায়) বহু গান আমার অসম্ভব পছন্দের। এখনই দুটো গান মনে আসছে ...‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’, ‘জানি না ফুরাবে কবে’। এতটাই শ্রদ্ধামিশ্রিত সেই ভাললাগা যে, গুনগুন গাইতেও ভয় পাই। তেমন একজনের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আমাকে বহু দিন আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। আমার মা, বউ, এমনকী ছেলের উপরও তার রেশ ছড়িয়ে ছিল।

শুনেছি, উনি ভক্তিমূলক গান নাকি পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতও। যদি সত্যিই কোনও দিন ওঁকে গান শোনানোর সুযোগ পেতাম, আর ইচ্ছেটা যদি আমার ওপরই ছেড়ে দেওয়া হত...তা হলে হয়তো ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ বা ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’-র মতো কিছু একটা গাইতাম। ভক্তিমূলক হলে নিঃসন্দেহে শ্যামাসঙ্গীত। এবং অবশ্যই পান্নালালের (ভট্টাচার্য)। হতে পারত, ‘দোষ কারও নয় গো মা’। হয়তো ওঁর ভাল লাগত। জানি না।

suchitra sen munmun sen goutam bhattacharjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy