Advertisement
E-Paper

সুনীলের অপচয়

তাঁর স্বপ্নের উপন্যাস কি লেখা হয়েছিল শেষমেশ? কেন চেয়েও করতে পারেননি কথ্য ভাষায় মহাভারত রচনা! অতিলিখন, স্তাবকদের স্তুতিই কি তাঁকে আন্তর্জাতিক হতে দিল না? উত্তর খুঁজলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যশক্তিদা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, তা’ও রক্ষে, সুনীল মোটে একবেলা লেখে, দু’বেলা লিখলে সে যে কী দাঁড়াত! কখনও সখনও সুনীলদা’র সামনে কথাটা হলে সুনীলদা ওঁর ট্রেডমার্ক মার্কা হাসিটা হাসতেন হুঁ হুঁ করে। এক-একবার মৃদু প্রতিবাদও করতেন, তা হলে মদটা খাওয়া হত কখন? দিনে একবেলা করে লিখে এবং বেড়ানোর দিনগুলোয় কোনও বেলা না লিখেও সুনীলদা যে সম্ভার রেখে গেছেন, তা শুনি আয়তনে ছাপিয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলীকেও। শেষ দিকে এ নিয়ে কিছু বললে একটু হাসি-হাসি লজ্জা-লজ্জা ভাব আসত মুখে।

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

শক্তিদা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, তা’ও রক্ষে, সুনীল মোটে একবেলা লেখে, দু’বেলা লিখলে সে যে কী দাঁড়াত!

কখনও সখনও সুনীলদা’র সামনে কথাটা হলে সুনীলদা ওঁর ট্রেডমার্ক মার্কা হাসিটা হাসতেন হুঁ হুঁ করে। এক-একবার মৃদু প্রতিবাদও করতেন, তা হলে মদটা খাওয়া হত কখন?

দিনে একবেলা করে লিখে এবং বেড়ানোর দিনগুলোয় কোনও বেলা না লিখেও সুনীলদা যে সম্ভার রেখে গেছেন, তা শুনি আয়তনে ছাপিয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলীকেও। শেষ দিকে এ নিয়ে কিছু বললে একটু হাসি-হাসি লজ্জা-লজ্জা ভাব আসত মুখে। স্বভাবত স্বাভাবিক ওঁর এই মুখটা দেখলে আরও ভাল লেগে যেত ওঁকে। এত লিখে এত নাম করেও এত ভাল মানুষ থেকে যাওয়া লোক তো বেশি হয় না।

গতকাল, গত পরশুর কথা না, সেই কবেকার ১৯৭২-এর। একটা ইংরেজি কাগজের জন্য সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম ওঁর। খুব আক্ষেপ করছিলেন যে, বড্ড বেশি লেখা হয়ে যাচ্ছে। ‘দেশ’-এ ধারাবাহিক, সাপ্তাহিক কলাম, ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’-এ পুজো সংখ্যার উপন্যাস, নানা পত্রপত্রিকায় কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদি ইত্যাদি। বললেন, “কী মনে হয় জানো, মানিকবাবুর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে সব লেখা বন্ধ করে দেব।

লেখা বন্ধ দূরে থাক, বাকি চল্লিশ বছর ধরে সুনীলদার লেখা শুধু বেড়েই চলল, বেড়েই চলল। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ হয়তো হল না, কিন্তু ওই সময়ই ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ বা ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর মতো সুবৃহৎ, সুলিখিত, সুগবেষিত, সুনন্দ উপন্যাস তিনি লিখে ফেলেছিলেন। ‘আমিই সে’, ‘তোমার তুলনা তুমি’, ‘রাণু ও ভানু’ বা ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এর মতো দাগ কাটা উপন্যাস, অজস্র নিবন্ধ-প্রবন্ধ, কয়েকটি নাটক এবং অসংখ্য কবিতাও তিনি লিখলেন। তবু ‘ভালবাসার জন্য আমার কাঙালপনা আর গেল না’ পঙ্ক্তিটির মতো ওঁর মনে ও কানে চিরকাল বেজে চলল ওই আক্ষেপ, “আরেকটু সময় নিয়ে, আরেকটু ধরে যদি লিখতে পারতাম, ইস্।”

ওঁর মৃত্যুর এক বছর আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ঘুরে ফিরে প্রসঙ্গটা আসতে সুনীলদা এক মজার যুক্তি খাড়া করলেন, যেটা জীবনের শেষ আট-দশ বছর খুব আওড়াতেন।

বললেন, “দু’বারের বেশি তিনবার আমি কাউকে না বলতে পারি না। যারা লেখার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে তারা এটা জেনে গেছে। ফলে লেখা কমাব কী করে বলো?”

লেখার বহরে সংযম আনতে পারলে সুনীলদা কী মাপের লেখা লিখতে পারতেন বলা মুশকিল। তবে যেটা বোঝা একেবারেই মুশকিলের না, তা হল বড় মাপের লেখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবটাই ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা ছিল ওঁর মধ্যে। অদম্য প্রাণশক্তি, নানা বিষয়ে অফুরন্ত কৌতূহল, জীবন উপভোগের ক্ষমতা, তীব্র রসবোধ, নিরবধি লেখার অভ্যাস, অবিরত পড়ার চর্চা, এক আশ্চর্য রসময় গদ্যের দখল, নিপুণ কবিতার ভাষা, মুহুর্মহু নাট্য রচনার কৌশল, এবং এই সব কিছুকেই বাঁধার মতো এক ওস্তাদ কল্পনাশক্তি। সব কিছুই বেশি বেশি থাকাটাই কি শেষে কাল হল সুনীলদার? আয়ুষ্কাল তো পেলেন রবিঠাকুরকে ছুঁই ছুঁই উনআশি। তা হলে? বড় কিছু করার আকাঙ্ক্ষাও কম ছিল না। অতিলিখন, যা তিনি আযৌবন অপছন্দ করে এসেছেন, তাই তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে এল জীবনসায়াহ্ন অবধি।

ফলে ওঁর সেই স্বপ্নের উপন্যাসটা লেখা হল কি হল না জানি না, অন্তত বেদব্যাসের লক্ষ শ্লোক মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক গদ্যানুবাদটুকু হল না। সেদিনটা আজও ভুলিনি। সকালের কাগজে বেরিয়েছে সুনীলদার লেখা হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশকৃত মহাভারতের তেতাল্লিশ খণ্ড বঙ্গানুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাযুক্ত সমালোচনা। সেই লেখারই প্রশংসা করতে সহকারী সম্পাদকদের ঘরে এসেছিলেন সংস্থার এক কর্তা। ওঁর ভাল লেগেছে জেনে সুনীলদা সলজ্জভাবে হাসলেন। কর্তা বললেন, “ইচ্ছে হয় না আধুনিক গদ্যে গোটা মহাভারতটা অনুবাদ করতে?”

সুনীলদা বললেন, “হয়ই তো, খুব হয়। তা’হলে হাতের কাজগুলোও তো ছাড়তে হয়!”

কর্তা বললেন, “সব ছাড়ুন। মহাভারত করুন।”

ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে দেখে সুনীলদা রসিকতা করে বললেন, “কাগজও তো লাগবে অনেক।”

কর্তাও ছাড়ার পাত্র নন। বললেন, “অসুবিধে কী! বলছি, এক লরি কাগজ পৌঁছে যাবে আপনার ওখানে।”

কর্তা চলে যেতে অনেকক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে বসেছিলেন সুনীলদা। শেষে ঘোর থেকে বেরিয়ে বললেন, “কী বলছ? লেগে গেলে হয়, না?”

কী যে আনন্দ হল কাজ ওঁর মাথায় ঢুকেছে জেনে! বলেই ফেললাম, “তাহলে আর কোনও লেখাই ধরার থাকবে না। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র আক্ষেপও চলে যাবে।”

জানি না, শেষ পর্যন্ত সুনীলদা কেন মহাভারতে হাত দিলেন না, ‘সানন্দা’ পত্রিকার জন্য ওঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেবার সময় কথাটা তুলেছিলাম। তার একটু আগেই মৃত্যুর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, একেক সময় ভাবি, তেষট্টি বছর বয়স হল, অনেক দিনই তো বাঁচা হল। এখন মরে গেলেই বা ক্ষতি কী?”

বললাম, “মহাভারত অনুবাদ না করে মারা যাবেন?”

সুনীলদা হাসলেন, “আর বোধহয় হল না। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।”

খুব ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু বলতে পারিনি সেদিন, “একটি পত্রিকায় তৃতীয় অঙ্ক অবধি শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ অনুবাদ করেই ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন কুড়ি বছর আগে? ওটা শেষ করবেন না?”

যদিও এটা সত্যি যে সুনীলদার মহাভারত না-ধরা আর রোমিও-জুলিয়েট’ শেষ না-করা বলতে গেলে ব্যতিক্রম, কারণ নিজেই বলেছিলেন একবার, যে কোনও লেখা শুরু হয়ে গেলে বড় একটা বাতিল করেন না। বাতিল যা হয় তা কবিতা লিখতে গিয়ে। তা হলে শেক্সপিয়রের লাইন উদ্ধৃতি করে আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন কেন ‘অর্ধেক জীবন’?

সুনীলদার যুক্তি ছিল, শেক্সপিয়রের পঙ্ক্তির যুক্তি মেনে নিয়েই জীবনের বাজে অভিজ্ঞতাগুলো বাদ দিয়ে মনে রাখার মতো কথাগুলো লিখতে চেয়েছেন। কিন্তু যেটা ওঁর বলার অপেক্ষায় ছিল না, তা হল ওঁর বিপুল সংখ্যক উপন্যাস ও অধিকাংশ কবিতা এবং অজস্র রম্যরচনায় উনি ওঁর জীবনটাই ধরে রেখেছেন। ‘অর্ধেক জীবন’ ওঁর জীবনের কতটা বলতে পেরেছে জানি না, তবে উপন্যাস-গল্পে নিজের জীবনের কথা চেলে চেলে আত্মজীবনীর এক বিকল্প উনি অনেক আগেই রচনা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেখানেও কি জীবনের সব ‘রট্ন’ (শেক্সপিয়রের ভাষায়) বা ‘বাজে’ (সুনীলদার ভাষায়) বৃত্তান্ত ছুঁয়ে যেতে পেরেছেন?

সুনীলদা লেখক শ্রীপান্থর কাছে কবুল করেছিলেন, না পারেননি। বলেছিলেন, এত প্রেমের দৃশ্য এঁকেছি, কিন্তু শরীরের সম্পর্ক দেখাতে গেলে কলম আটকে যায়। কেন? না, নিজের শরীরটাই কীরকম অস্থির হয়ে ওঠে। ওটা সাহেবরাই পারে।

এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, “ভাবি, যেটা আড়ালের দিক সেটা আড়ালে রাখাটাই তো ভাল।”

খুবই প্রিয় ছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘অটোবায়োগ্রফি’, কিন্তু স্বীকার করতেন, জীবনের সব ভাললাগা, মন্দলাগা, জয়-পরাজয়, প্রেম-ঘৃণা, উচ্চতা-নীচতা, দোষগুণ, মহত্ত্ব-ক্ষুদ্রতা, ওভাবে বলা অসম্ভব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া বললেন একদিন, গাড়িতে যেতে যেতে, কখনও কি ভেবেছিলাম নিজের কথা এ ভাবে কখনও ঢেলে বলতে হবে? আমার স্মৃতি খারাপ না, তা বলে সাল, তারিখ, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজেকে নিয়ে লেখার কথা মাথাতেই আনতে পারি না।

আসলে সুনীলদার চরিত্রের মাধুর্যই হল একটা আলগা ছন্দ, সরল মেজাজ, নিজেকে সারাক্ষণ একটা কেউকেটা, গুরুত্বপূর্ণ মনে না-করা প্রকৃতি। তা বলে ওঁর কি ইগো ছিল না? ভয়ঙ্কর ছিল। প্রায় সত্যজিৎ রায়ের মতোই, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়র মতো। যে-অহং নিজেকে দেখানো বা অন্যকে দাবানোর জন্য নয়, বুকপকেটের সোনার ঘড়ির মতো ঘন ঘন বার করে লোক দেখানোর জন্য নয়। এ-অহং নিজের মতো রীতি ও স্বভাবকে অটুট রাখার জন্য, নিজের স্তর ও ক্ষমতাকে বেঁধে রাখার জন্য এবং স্ববিরোধ শোনালেও খুবই সত্যি, নিজের নির্জনতা, লাজুকতা ও দুর্বলতার প্রতিরক্ষার জন্য।

সুনীলদার স্বাভাবিক জীবনটাই একটা সময় থেকে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। দুনিয়ার সবাইকে নিজের সময় বেটে দেওয়াটা কর্ণের দান হয়নি— যা নিয়ে ‘কর্ণকুন্তী সম্বাদ’ লেখা যায়— গৌরী সেনের দান হয়েছিল। একে অক্লান্ত লেখা, সন্ধেকালে মাথা ছড়ানোর পান-আড্ডা, তার ওপর যে-চায় তাকেই সময় নয়তো লেখা দেওয়া। একটা সময় ওঁর আগের নিকট-বন্ধুরা অনেকটাই দূরে চলে গিয়েছিল, সে নিঃসঙ্গতা সুনীলদা’ ভরিয়েছিলেন নতুন, নতুন বন্ধু সমাগমে। যাদের কাছে সুনীলদা এক প্রতিষ্ঠান বিশেষ, সব ত্রুটির উর্ধ্বে, কোনও স্তুতিই যাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। চিরকাল যে-সুনীলদাকে দেখেছিলাম খুব ন্যায্য প্রশংসাতেও বিব্রত হন, তিনি এসব সহ্য করে নিচ্ছেন। সময়ের দাসত্ব করবেন না বলে যিনি কোনও দিন ঘড়িই পরলেন না (বিয়ের সায়মা ঘড়িটা এক মদের আসরে খোয়া গিয়েছিল, পরে পুলিশে রিপোর্ট করতে গিয়ে নেশার ঘোরে ঘড়ির নাম বলেছিলেন কখনও পার্কার, কখনও শেফার্স, কখনও পাইলট!), তিনিই ডাক পেলে বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে-কোনও সমিতির সভাপতি, কমিটির চেয়ারম্যান বা আসরের মধ্যমণি হওয়া ধরলেন। শেষে সাহিত্য একাদেমির সভাপতি হয়ে অজস্র সময় খোয়ালেন হিল্লিদিল্লি করায়। যখন এসব করছেন, তখনও ওঁর ভেতরে কালান্তক রোগটা বাসা বেঁধে আছে, কিন্তু সুনীলদা তাতে ডরাননি, কাউকে জানতেও দেননি, এতটাই বীরত্ব ও সহ্যশক্তি ধারণ করতেন। তা বলে সময়টা যে বাঁধা পড়ছে, এই ভয়ভাবনা থাকাটা কি ভাল ছিল না?

সে-ভয় থাকলে (শুনেছি রোগটা নাকি প্রথম ধরা পড়ে আমেরিকায় ওঁর মৃত্যুর সতেরো বছর আগে, ঠিক যখন আমি সানন্দার সাক্ষাৎকারে মৃত্যু প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি) উনি মহাভারত অনুবাদে কী ‘রোমিও-জুলিয়েট’ শেষ করায় হাত দিতেন কি না জানি না, অন্তত পায়ের তলার শর্ষে একটু ছাড়তেন, বা রাত্রি শাসন করা মজলিশে কিছুটা বেড়ি পরাতেন, আট দশ-গ্লাস পাটিয়ালা পেগ হুইস্কির রেশন কমালেও কমাতেন এবং — এটাই বড় লাভ হত— হয়তো ওঁর নিজস্ব ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় হাত দিতেন।

সুনীলদার সময় ও ক্ষমতার অপচয় নিয়ে সাতকাহন গাওয়াটা মূর্খামি, কারণ এক জীবনে ভদ্রলোক যে-বিচিত্র সাহিত্যভাণ্ডার সৃষ্টি করে গেলেন তা অকল্পনীয়। ওঁকে পড়তে এত ভাল লাগেই বলে ওঁর সৃজনগুরুত্ব অনেক সময়ই চোখ এড়িয়ে যায়। সমস্যাটা ওঁর দিক থেকে দেখলেও মন্দ হয় না।

সুনীলদা তখন সেই সময়’ ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন ‘দেশ’-এ। আনন্দবাজারে একটা ঘরে ওঁর সঙ্গে বসে কাজ করি। একদিন ‘দেশ’ থেকে একজন এসে খুব বিনীতভাবে বললেন, “এবারের কিস্তিটা কি কাল পাওয়া যাবে? একটু চাপ আছে।” সুনীলদা অমায়িক হেসে বললেন, “দেখি। আসলে লেখাটাও তো হতে হবে।”

সেই সন্ধ্যায় ওঁর সঙ্গে অটোমোবিল ক্লাবে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে কথা হচ্ছিল রবার্ট গ্রেভস-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আই ক্লডিয়াস’ নিয়ে। তখনও শেষ করতে কিছুটা বাকি ওঁর। সুয়েটোনিয়া-এর ‘টুয়েলভ্ সিজার্স’ কিংবা প্লুটার্কের ‘লাইভজ্ অফ দ্য গ্রেট রোমানাজ্’ কী ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে উপন্যাসে এই সব কথা হচ্ছিল। সুনীলদা হঠাৎ বললেন, “আমি কিন্তু কোনও আপস করছি না। কারণ বেঙ্গল রেনেসাঁটা কতখানি কী সেটা বাজিয়ে দেখার আছে।”

সেদিন ক্লাব থেকে বেরুনোর মুখে ইউরিনালে আমি আর সুনীলদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দেখি ঘুমে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ওঁর। কেন জানি না, জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, বাড়ি গিয়ে কি ‘আই ক্লডিয়াস’ ধরবেন? সুনীলদার ঠোঁটে সিগারেট, চোখ বোজা, বললেন, “কী করে হবে বলো? কাল সকালে তো কিস্তি লিখতে হবে!”

আরেকবার পুরীর সমুদ্রে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্নান করছি। তখন ওখানে ওঁকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তোলা হচ্ছে। তার চিত্রনাট্য লিখেছিলাম বলে তার অনেক কিছুই বাজিয়ে নিতাম নির্জন সৈকতে স্নান করতে করতে। ঢেউয়ের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে এরকমই একটা প্রশ্ন ছিল: ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ আর পূর্ব-পশ্চিম’-এর পর কি মনে হচ্ছে উপন্যাসের কাজ অন্তত শেষ?”

সুনীলদা দেখলাম লাফিয়েই যাচ্ছেন ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের ওপর, সমুদ্রের দিকে মুখ করে। শেষে জল থেকে উঠে আসার সময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নামানো স্বরে বললেন, “তোমার ওই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হচ্ছে— না, হয়নি। তা হলে তো উপন্যাস লেখাই বন্ধ করতে হবে।

বললাম, “ইচ্ছে করে না, জীবনের শেষ বড় কাজ বলে একটাই উপন্যাস ধরে পড়ে থাকতে?

ওরকম বরাত কি কেউ দেবে?

অন্যের বরাতে কেন? নিজেই নিজেকে বরাত দিয়ে। শেষ হলে ছাপতে দেবেন।

পারব না। তুমি তো জানো, কিস্তির চাপ না থাকলে খুব বড় লেখা আমার হবার না। পুজো সংখ্যার লেখাই তো চাপে চাপে শেষ করি।

আমার মনে পড়ল, অনেক দিন আগে সুনীলদা একবার লিখেছিলেন, লিখি টাকার জন্য। আর লেখা চাওয়া হলে।

টাকার সেই টান সুনীলদার বহু দিন হল চলে গিয়েছিল। টাকা ছাড়াই যে কী অজস্র লেখা উনি দান করে গেছেন, তার সীমা-পরিসীমা নেই। তবে না চাইলে গদ্য লিখতে পারাটা থেকে গিয়েছিল। কিন্তু কবিতা লিখতেন রক্তের টানে, স্মৃতির টানে, ভালবাসার টানে। শেষ দিকে বন্ধু শক্তির অত্যাগমনেও এক অপূর্ব কবিতা লিখলেন।

বালির ওপর দিয়ে ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে দরজা-জানলা বন্ধ করে, মানুষজন থেকে সরে বছরের পর বছর ধরে মার্সেল প্রুস্তের মতো তেরো খণ্ড ‘রিমেমব্রন্স অফ থিংগজ পাস্ট’ উপন্যাস গোছের কিছু আপনার কাছে অকল্পনীয়? ওই মহত্ত্বর কথায় বলছি না, ওই ধরন ও বহরের।”

সঙ্গে সঙ্গে সুনীলদার ভেতরকার সেই পড়ুয়া, অনুরাগী ও শিল্পীটি বেরিয়ে এল—“বলো কী! ও-ও তো মহাভারত লেখার মতো ব্যাপার। শুধু পাতা দিয়ে দেখলেই তো হবে না। কমলদা (মজুমদার) ছাড়া আমাদের এখানে পুরো কেউ তেরো খণ্ড পড়েছে বলেও তো শুনিনি। যদি জোগাড় করে দাও তো কয়েক খণ্ড পড়ার আকাঙ্ক্ষা আছে।”

তাহলে বলি, এহেন নানা অনাবিল আকাঙ্ক্ষার মতো সুনীলদার যে কিছু উচ্চাঙ্ক্ষাও ছিল না তাও না। ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওঁর ছিল। সেই প্রথম যৌবন থেকেই ‘কৃত্তিবাস’ করা, মধ্যবয়েসে নতুন করে ‘কৃত্তিবাস’ করা, প্রৌঢ়ত্বে এসে ‘বুধসন্ধ্যা’, বার্ধক্যে উন্নীত হয়ে ‘ভাষা দিবস’, বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব গঠন এবং সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায় দ্রব। একবার আমায় বলেছিলেন,“কবিতার পাতা দেখার মধ্যে হ্যাপা অনেক। কত যে হাবিজাবি অনুরোধ আসে আর হিজিবিজি পড়তে হয়। আর তার মধ্যে একটা যথার্থ কবিতার স্বর আবিষ্কার করতে পারলে সব ক্লেশ কেটে যায়।”

অনেক তরুণ লেখক-কবিকেই সুনীলদা আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। অনেক লেখক-কবিই ওঁর দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, অবজ্ঞাত হয়ে ওঁর প্রতি বিরূপও হয়েছিলেন। এহেন বিবিধ কারণে শেষজীবনে ওঁর মতো উদার এবং ভাল মানুষেরও খ্যাতির অপচয় ঘটে গিয়েছিল। ওঁর এই কষ্টের সময়ে বার কয়েক দেখা-সাক্ষাতে বুঝেছিলাম, এই শিবির বিভাজন ওঁকে কষ্ট দেয়। ওঁর মৃত্যুর এক বছর আগে এক টেলিভিশন ইন্টারভিউ-এ বললেন, “মরে যাওয়ার আগে আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা। এই হানাহানি, রক্তপাত, কুৎসিত ধ্বংসলীলা বন্ধ হোক।”

উল্লেখ না করে উপায় নেই সাক্ষাৎকারের ওই দিনটি ছিল ওঁর জন্মদিন এবং সেদিনই প্রথম ঘোষণা করলেন যে, রামায়ণ-এর এক নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে এক উপন্যাসে হাত দিচ্ছেন।

সুনীলদার বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ ওঁর বিরুদ্ধ শিবিরের যে, উনি সারাজীবন ওঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাকে হিসেব কষে, মেপেজোপে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। না বলে উপায় নেই যে, এ হল হেরোদের যুক্তি। ক্লাসের ফার্স্টবয়কে কেউ বেশি পড়াশুনো ও বেশি বুদ্ধিমত্তার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে না। লিওনেল মেসিকে বেশি গোল বা সচিন তেন্ডুলকরকে বেশি রান করার জন্যও না। আফশোসটা হওয়ার কথা সুনীলের অনুরাগীদের। ওঁর কি একটা পদ্মভূষণ অন্তত প্রাপ্য ছিল না? কিংবা একটা জ্ঞানপীঠ? কিংবা রাজ্যসভার সদস্য পদ?

সুনীলের সত্যিকারের অনুরাগীদের অবশ্য এর কোনওটা নিয়েই কোনও আক্ষেপ নেই। এই সব খেতাব, পুরস্কার, পদে কী এল-গেল সুনীলের মতো লেখকের? যাঁকে রবিশঙ্করেরর মতো মানুষ ‘সেই সময়’ পড়ে ফোন করে বলেন, ‘অভিভূত! আপনার গালে চুমো দিতে ইচ্ছে করছে,” তাঁর আবার কী সংশাপত্র চাই কোনও সংসদ বা সমিতির?

অনুরাগীদের আক্ষেপ অন্যখানে। বিদেশের সব বঙ্গ সম্মেলন-টম্মেলনে গিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করলেন কেন? ইউরোপ, আমেরিকার প্রকৃত গুণী লেখকদের সম্মেলনে সাহিত্য, নিজের সাহিত্য, ভারতজীবন ও নিজের জীবন নিয়ে কত কিছুই তো বলার ছিল ওঁর। ২০১০-এ লন্ডনের বইমেলায় বিষয়-দেশ ছিল ভারত। সেখানে সুন্দর বক্তব্য রাখলেন অমর্ত্য সেন এবং বিক্রম শেঠ। সুনীলদাও সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি, ওঁর কোনও ইংরেজিতে অনুবাদ করা সরস্বান বক্তৃতা শুনতে পেলে কতই না ভাল হত!

বইমেলার সান্ধ্য পানাসরে সেটা বললামও ওঁকে। উনি বললেন, ওরা তো বিক্রমের ব্যাপারে উৎসুক, ওর কথাই শুনতে চাইছিল।

এইখানেই শেষ অবধি সুনীলদা বাঙালিই থেকে গেলেন। যেটা আহ্লাদের কথা কিন্তু উবে যায় যখন ভাবি, আন্তর্জাতিক মানের এক সাহিত্যপ্রতিভা সুযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করলেন না। লন্ডন বইমেলায় ‘সেই সময়’ ও ‘প্রথম আলো’র অনুবাদগ্রন্থগুলি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু তাদের নিয়ে কোনও রিডিং সেশন হল না। অথচ দ্বিতীয় বইটির অনুবাদ ‘ফার্স্ট লাইট’-এর মুক্তি অনুষ্ঠানে কলকাতার অক্সফোর্ড বুক স্টোরের পাঠবৈঠকে কী ভিড় আর কী উত্তেজনা! বছর দশেক আগে আনন্দবাজারে এক লেখায় সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারে সম্ভাব্য ভারতীয় প্রাপকদের তালিকায় সুনীলদা’র নাম না রাখায় উনি হয়তো একটু কষ্টই পেয়েছিলেন। আমাদের দুজনেরই এক বন্ধু চলচ্চিত্রকারের কাছে খেদ করেছিলেন, নোবেল পুরস্কারের লং লিস্টে ওঁর নাম আছে, কিন্তু সেটাকে শর্ট লিস্টে তোলার জন্য যে-উদ্যম ও উদ্যোগ লাগে তা ওঁর ক্ষমতায় নেই।

নোবেল প্রাইজের লং লিস্ট কত লম্বা বা শর্ট লিস্ট কত ছোট আমার ধারণা নেই। কিন্তু কথাটা শুনে বেশ কষ্টই হয়েছিল। শর্ট লিস্টে ঢোকার চিন্তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায় আসবেই বা কেন? ওটা লেখকদের চিন্তা নয়, প্রদাতাদের সমস্যা। কিন্তু সুনীলদাই বা করবেন কী? শেষজীবনে এমন খ্যাতিশৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছিলেন, এমন পরিবেশে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন সর্বক্ষণ, যে কল্পনার শিকার হয়ে পড়েছিলেন। নিজের অপচয় রোধ করতে পারছিলেন না।

shankarlal bhattacharya sunil gangopadhyay sunil ganguly
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy