Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Presents

মুশকিল আসান

কর হিসেবে কাটা বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার নাম নেই। কিংবা হয়তো জমা পড়েনি টিডিএস। আয়কর দফতরে অভিযোগ জানিয়ে হয়রান। এ বার যাবেন কার কাছে? জানালেন প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী।যা রোজগার, আর সঞ্চয়ের যা বহর, তাতে বছর গেলে কুড়ি হাজার টাকা মতো আয়কর দেওয়ার কথা সুমন্তবাবুর। সেখানে এ বার প্রায় হাজার পাঁচেক বেশি কাটা গিয়েছে। কর বাঁচাতে পড়িমরি করে শেষ বেলায় করা জীবনবিমা আর এনএসসি-র কাগজ তিনি যখন জমা দিয়েছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কর কাটা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

যা রোজগার, আর সঞ্চয়ের যা বহর, তাতে বছর গেলে কুড়ি হাজার টাকা মতো আয়কর দেওয়ার কথা সুমন্তবাবুর। সেখানে এ বার প্রায় হাজার পাঁচেক বেশি কাটা গিয়েছে। কর বাঁচাতে পড়িমরি করে শেষ বেলায় করা জীবনবিমা আর এনএসসি-র কাগজ তিনি যখন জমা দিয়েছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কর কাটা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। অফিস অবশ্য বলেছে, কর হিসেবে দেওয়া ওই বাড়তি টাকা সরকারের ঘর থেকে ঠিক ফেরত (রিফান্ড) পাবেন তিনি। কিন্তু তা শুনে সুমন্তবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন কই? কারণ, প্রায় সকলের মুখেই তিনি শুনেছেন যে, সরকারের ভাঁড়ারে টাকা এক বার চলে গেলে, তা ফেরত পাওয়া বেশ শক্ত। অন্তত সময়সাপেক্ষ তো বটেই। অনেক সময় বছর ঘুরে গেলেও রিফান্ডের দেখা মেলে না।

আয়কর নিয়ে আমি-আপনি-সুমন্তবাবুর মতো সাধারণ মানুষেরা যাতে এই হয়রানি থেকে রেহাই পাই, তার জন্যই তৈরি হয়েছে ইনকাম ট্যাক্স (আয়কর) ওম্বাডসম্যানের দফতর। আয়কর নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সুরাহার জন্য আর্জি জানানো যায় এখানে।

ধরুন, কর হিসেবে যত টাকা জমা দেওয়ার কথা, কারও কাটা গেছে তার থেকে বেশি। অথচ দীর্ঘ দিন কেটে যাওয়ার পরেও সেই রিফান্ডের দেখা নেই। কারও হয়তো আবার টিডিএস (আয়ের উত্‌সে কর বা ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স) কাটা হয়েছে। কিন্তু রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, তা আয়কর দফতরের ঘরে জমা পড়েনি। আমাদের আশেপাশেই এ ধরনের নানা ঘটনা ভুরিভুরি ঘটে। কিন্তু অনেক সময়ই এ সব নিয়ে আয়কর দফতরকে চিঠি লিখেও কোনও সুরাহা হয় না। বরং হেনস্থা হন আয়করদাতা। প্রাপ্য টাকা ফেরত পেতে কিংবা অন্য কোনও প্রাপ্য পরিষেবা আদায় করতে হয়রান হতে হয় তাঁদের। আমাদের পরামর্শ, এই সব ক্ষেত্রে আয়কর ওম্বাডসম্যানের দরজায় কড়া নাড়ুন। ঠিক যে ভাবে ব্যাঙ্ক কিংবা বিমা সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তাদের ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হন আপনারা।

অফিস কোথায়?

আয়কর ওম্বাডসম্যানের দফতর তৈরি হয় ২০০৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১২টি রাজ্যে এই দফতর রয়েছে। এ রাজ্যের দফতরটি কলকাতায়। রাজ্যে আয়করের সদর দফতর আয়কর ভবনেই। আপনাদের সুবিধার জন্য তার ঠিকানা, ফোন নম্বর, ওয়েবসাইট সঙ্গের সারণিতে তুলে দিলাম আমরা।

অভিযোগ কীসে?

আয়কর সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইনকাম ট্যাক্স ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানো যায়। এক কথায় তা বলা শক্ত। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি, অ্যাসেসমেন্টের পর যে সমস্ত পরিষেবা আয়কর দফতরের কাছ থেকে আপনার প্রাপ্য, তা পাওয়া না-গেলে, ওম্বাডসম্যানের দফতরে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে। যেমন—

রিফান্ড না-পাওয়া বা পেতে দেরি: যত টাকা আয়কর কারও দেওয়ার কথা, কোনও কারণে তার থেকে বেশি টাকা কাটা হয়ে থাকলে, ওই বাড়তি অঙ্ক অবশ্যই তাঁর ফেরত পাওয়ার কথা। একেই রিফান্ড বলে। কিন্তু অনেক সময় দীর্ঘ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রিফান্ডের টাকা হাতে পান না করদাতা। অনেক সময় আবার টাকা ফেরত পেলেও তার উপর প্রাপ্য সুদ মেলে না। এমনকী সুরাহা হয় না সংশ্লিষ্ট আয়কর দফতরে চিঠি লিখেও। তখন ভরসা ওম্বাডসম্যানই।

সুদ মকুবের সুবিধা না-পাওয়া: সময়ে বকেয়া কর মেটালে অনেক ক্ষেত্রে করদাতার সুদ মকুবের সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আয়কর দফতরের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও তারা বিষয়টি ফেলে রেখেছে। সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সুদ মকুব করা হবে কিনা, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার অবশ্য তাঁর নেই। কিন্তু আয়কর দফতর যাতে এই ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট করদাতাকে তা জানিয়ে দেয়, সেই বিষয়টি ওম্বাডসম্যান নিশ্চিত করতে পারেন।

প্যান কার্ড পেতে দেরি: ধরুন, প্যান কার্ডের জন্য কেউ আবেদন করলেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি তা হাতে পেলেন না। সে ক্ষেত্রে ওম্বাডসম্যানের দফতরে অভিযোগ অবশ্যই জানাতে পারেন তিনি।

কর কেটেও নথিবদ্ধ না হওয়া: অনেক সময়ই দেখা যায় যে, সংস্থা আপনার আয়ের উত্‌সে কর কেটে নিয়েছে (টিডিএস) ঠিকই। কিন্তু আপনি যখন ইন্টারনেটে দেখতে যাচ্ছেন, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, তা আয়কর দফতরের খাতায় তোলা হয়নি। আগাম বা অ্যাডভান্স করের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের যে কোনও সমস্যার জন্যই ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হতে পারেন।

চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার না-করা: আয়করদাতা কোনও বিষয়ে চিঠি লেখার পর যদি আয়কর দফতর তার প্রাপ্তি স্বীকার না-করে, তা হলে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। এমনকী আয়কর দফতরের কোনও অফিসার বা কর্মী দুর্ব্যবহার করলে কিংবা কাজের সময় বিনা কারণে অনুপস্থিত থাকলেও অভিযোগ জানানো যায়।

আটক নথি বা মূল্যবান সামগ্রী সময়ে ফেরত না পেলে: ধরুন, আয়কর হানার সময়ে কোথাও ওই দফতরের অফিসারেরা বিভিন্ন নথি এবং সোনাদানা-সহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী আটক করেছেন। অনেক সময় দেখা যায়, সেই তদন্ত (কেস) মিটে যাওয়ার পরেও দীর্ঘ দিন ওই সব নথি ও সামগ্রী ফেরত পাননি সংশ্লিষ্ট আয়করদাতা। এ ক্ষেত্রেও তিনি ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন।

আপিল কর্তৃপক্ষের রায় কার্যকর না-করা: আপিল কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকা কোনও বিষয় নিয়ে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ করা যায় না (এই লেখায় পরের দিকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা)। কিন্তু তার নির্দেশ যদি সঠিক ভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্যকর করা না-হয়, তা হলে ওম্বাডসম্যানের কাছে যেতেই পারেন। আয়কর সংক্রান্ত অন্য যে কোনও সরকারি নির্দেশ যদি দফতর ঠিক ভাবে পালন না-করে এবং তাতে কারও আর্থিক বা অন্য কোনও ধরনের ক্ষতি হয়, তা হলেও তিনি ওম্বাডসম্যানের কাছে যেতে পারেন।

অ্যাসেসমেন্ট সংশোধন না-করা: অনেক সময় আয়কর অ্যাসেসমেন্টে ভুল থাকে। কিন্তু সেই ভুল সংশোধনের জন্য আবেদন করার পরেও কিছু ক্ষেত্রে তা নিয়ে উদাসিনতা দেখায় আয়কর দফতর। সে ক্ষেত্রেও ওম্বাডসম্যানের ‘দরবারে’ অভিযোগ জানাতে পারেন।

এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে ওম্বাডসম্যানের দরজায় কড়া নাড়তে পারেন। সেগুলি কী কী, তা জানতে ওম্বাডসম্যানের দফতরের ওয়েবসাইট অবশ্যই খুঁটিয়ে দেখুন।

অভিযোগ কী ভাবে?

আয়কর ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি বেশ সরল। তবে অবশ্যই তা মনোযোগ দিয়ে করা জরুরি। মনে রাখবেন—

সাদা কাগজে পরিষ্কার করে নিজের অভিযোগ লিখুন।

নিজেই সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারেন।

আইনজীবী নিয়োগের কোনও প্রয়োজন নেই।

অনলাইনেও অভিযোগ দায়ের করা চলে। তবে সে ক্ষেত্রে তার প্রিন্ট সই করে ওম্বাডসম্যানের দফতরে পাঠাতে বা জমা দিতে হবে।

সঙ্গে কোন নথি?

শুধু অভিযোগ লিখলেই হবে না। তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় নথি (সাপোর্টিং ডকুমেন্ট)-এর কপি জমা দেওয়া জরুরি। মানতে হবে কিছু নিয়মও। যেমন—

অভিযোগকারীকে নিজের নাম, ঠিকানা এবং প্যান নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে প্যান কার্ডের ফোটো কপি দিতে ভুলবেন না। অভিযোগ পত্রে থাকতেই হবে সই।

যে অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর নাম এবং পদ উল্লেখ করুন।

অভিযোগটি ঠিক কী, তা নির্দিষ্ট করে লিখে জানান। সেই বিষয়ে যতটা সম্ভব তথ্য দিন। সঙ্গে দিন প্রয়োজনীয় নথিও (সাপোর্টিং ডকুমেন্ট)।

স্পষ্ট জানান যে, ওম্বাডসম্যানের কাছে ঠিক কী ধরনের সুরাহা (রিলিফ) চাইছেন আপনি।

মনে রাখবেন

ঠিকঠাক নিয়ম মেনে আবেদন না-করলে, ওম্বাডসম্যানের দফতরে কিন্তু তা গ্রাহ্য হবে না। তাই মনে রাখবেন—

ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানোর আগে সংশ্লিষ্ট আয়কর দফতরে উপযুক্ত অফিসারের কাছে অভিযোগের সুরাহা চেয়ে চিঠি লিখতে হবে। সাধারণত যে অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, চিঠি লেখা উচিত তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তা লেখার ৩০ দিন পরেও সুরাহা না-হলে, তবেই এ নিয়ে অভিযোগ জানানো যাবে ওম্বাডসম্যানের কাছে।

চিঠি যে লেখা ও পাঠানো হয়েছিল, তার প্রমাণ সম্বলিত নথি অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমা দিন।

চিঠির উত্তর পাওয়া বা না-পাওয়ার পর ওই বিষয়ে ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে এক বছর পর্যন্ত সময় পাওয়া যায়।

ওম্বাডসম্যানের কাছে এক বার কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর দ্বিতীয় বার ওই একই বিষয়ে তাঁর কাছে আর অভিযোগ জানানো যায় না।

সুরাহা কত দিনে?

সাধারণত অভিযোগ পাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে তা ফয়সালা করার কথা ওম্বাডসম্যানের। তবে কত দিনের মধ্যে কোনও সমস্যার সমাধান করা যাবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে আয়কর দফতরের সহযোগিতার উপর। কলকাতায় ওম্বাডসম্যানের দফতরে সাধারণত দু’সপ্তাহের মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়।

ক্ষমতা কতখানি?

এখন প্রশ্ন হল, ওম্বাডসম্যানের নির্দেশ কি মানতে বাধ্য আয়কর দফতর?

সত্যি বলতে বিমা এবং ব্যাঙ্কিং ওম্বাডসম্যানের নির্দেশ যেমন বিভিন্ন বিমা সংস্থা ও ব্যাঙ্ক মানতে বাধ্য, সে রকম কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা আয়কর ওম্বাডসম্যানের ক্ষেত্রে নেই। কিছু নির্দেশিকা অনুযায়ী আয়কর ওম্বাডসম্যান কাজ করেন। এ বিষয়ে কোনও আইন এখনও তৈরি হয়নি।

তবে বাস্তবে দেখা যায়, যেহেতু আয়করদাতাদের পরিষেবা দিতে ওম্বাডসম্যানের দফতরটি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকেরই তৈরি, তাই তাদের নির্দেশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেনে চলে আয়কর দফতর। যেমন, কলকাতা ওম্বাডসম্যান দফতরেরই দাবি, জমা পড়া অভিযোগগুলির ৯০ শতাংশই নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয় তারা।

অভিযোগ কীসে নয়?

এই পর্যন্ত পড়ার পর অনেকেই ভাবতে পারেন, আয়কর সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগ নিয়েই বুঝি ওম্বাডসম্যানের দ্বারস্থ হওয়া চলে। কিন্তু তেমনটা মোটেও নয়। আয়কর নিয়ে অভিযোগ শোনার জন্য ওম্বাডসম্যান ছাড়াও রয়েছেন আপিল কর্তৃপক্ষ। তাদের আওতায় যে যে বিষয় রয়েছে (কোনও আয় করযোগ্য কিনা তা দেখা, করছাড় সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়, কর না-দেওয়ার কারণে জরিমানা নিয়ে বিরোধ ইত্যাদি), সেগুলি নিয়ে কিন্তু ওম্বাডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানো যাবে না।

ওম্বাডসম্যানের কাছে কী কী সমস্যা নিয়ে যাওয়া যাবে, তা বিশদে জানতে ওয়েবসাইটের কথা আগেই উল্লেখ করেছি আমরা।

তথ্য সহায়তা: কলকাতার আয়কর ওম্বাডসম্যান কে কে মহাপাত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

income-tax pragyananda choudhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE