Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সহজেই বুঝে নিতে পারতেন কোন সুরটি সর্বোত্তম

লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলে থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সবার কাছেই অনিবার্য ছিলেন মান্না দে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমান্নাদার সঙ্গীত-জীবন সত্তর বছরেরও বেশি। সারা পৃথিবীর সঙ্গীত ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিন পুরুষ মুগ্ধ হয়ে তাঁর গান শুনছে। মানুষের বয়স বেড়েছে, এসেছে নতুন নতুন জেনারেশন, গানের ধারা বারবার বদলেছে, পাল্টেছে মানুষের রুচিবোধ—শুধু এক রয়ে গেছে মান্না দে-র গান। সুদীর্ঘ জীবনে কত শিল্পী, সুরকার, মিউজিসিয়ানদের সঙ্গে তাঁর পথ চলা। কত ঘটনা, কত উপলব্ধি, কত অভিজ্ঞতা।

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

মান্নাদার সঙ্গীত-জীবন সত্তর বছরেরও বেশি। সারা পৃথিবীর সঙ্গীত ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিন পুরুষ মুগ্ধ হয়ে তাঁর গান শুনছে। মানুষের বয়স বেড়েছে, এসেছে নতুন নতুন জেনারেশন, গানের ধারা বারবার বদলেছে, পাল্টেছে মানুষের রুচিবোধ—শুধু এক রয়ে গেছে মান্না দে-র গান। সুদীর্ঘ জীবনে কত শিল্পী, সুরকার, মিউজিসিয়ানদের সঙ্গে তাঁর পথ চলা। কত ঘটনা, কত উপলব্ধি, কত অভিজ্ঞতা।
লতা মঙ্গেশকর। ভারতীয় সঙ্গীতের অনেকখানি জুড়ে তিনি। সে যুগ থেকে এ যুগ প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গে ডুয়েট গান গেয়েছেন। কে নেই? মহঃ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ থেকে কুমার শানু, উদিতনারায়ণ, বাল সুব্রামোনিয়াম। লতার উপলব্ধি—‘‘এত ডুয়েট গাইলাম এত জনের সঙ্গে। কিন্তু ‘প্যার হুয়া ইকবার হুয়া’-র মতো গান কোথায়?’’
একই অভিজ্ঞতা আশা ভোঁসলেরও। মান্নাদা-র সঙ্গে প্রচুর ডুয়েট গান গেয়েছেন—বুটপালিশ, শ্রী৪২০, বরসাত কি এক রাত, আমানত, মিস ইন্ডিয়া, মাদার ইন্ডিয়া, নবরঙ, ছোটি বহিন, লালপাথর....দীর্ঘ তালিকা। মান্নাদা-র প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবোধ আশাজীর। কী বলছেন তিনি?—‘‘যখনই হিন্দি ছবির প্রযোজক-পরিচালকরা বিপদে পড়েছেন, তখনই শরণাপন্ন হয়েছেন মান্নাদা-র। আর উনি ঈশ্বরের মতো তাঁদের সাহায্য করে গেছেন। যে সব গান রফি বা কিশোরকে দিয়ে গাওয়ানো যেত না, সেই সব গান মান্নাদা অনায়াসে গেয়ে দিতেন। এই জায়গায় উনি ছাপিয়ে গিয়েছেন সবাইকে।
ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরিতে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির ‘চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে’ গানের রেকর্ডিং চলছে— মান্নাদা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ডুয়েট গান। সুরকার অনিল বাগচী। মান্নাদা সব সময় সুরকারের কাছে গানটি শিখে শর্ট নোটেশন করে নিতেন। তার পর গাইতেন ইম্প্রোভাইজ করে। এই গানের সুরও শর্ট নোটেশনে লিখে নিয়েছেন। কিন্তু হয়েছে কি অনিল বাগচী বারবার সুর পরিবর্তন করছেন, আর মান্নাদা-কে এক এক বার এক এক রকম ভাবে গাইতে বলছেন। মান্নাদা তো খুব বিপদে পড়ে গেলেন। বাঁচালেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘অত চিন্তা করছেন কেন মান্নাদা? অনিলদা যেমনটি বলছেন এখন তাই গেয়ে শোনান। ফাইনাল রেকর্ডিংয়ে যেটা আপনার নোটেশন করা আছে সেটাই গাইবেন। অনিলদা কিছু বুঝতেই পারবেন না।’ যেমন কথা, তেমন কাজ। অনিলদা একবার শুধু বললেন, ‘শেষ যা পরিবর্তন করেছি, তাই গেয়েছেন তো?’ মান্নাদা নির্বিকার মুখে বললেন, ‘এই দেখুন না শর্ট নোটেশন, সে রকমই তো গাইলাম।’ অনিলদা খুশি। আসলে মান্নাদা-র মতো জহুরি গায়ক আর নেই। নিজে এত বড় সুরকার ছিলেন বলে সহজেই বুঝে নিতে পারতেন কোন সুরটি সর্বোত্তম। সেই গান আজ তো ইতিহাস হয়ে গেছে।

‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে মান্নাদা গেয়েছিলেন—‘লেগেছে, লেগেছে, লেগেছে, লেগেছে আগুন’। কমেডি সিচুয়েশন। জমিয়ে সুর করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। ক্লাসিকাল চলনের সঙ্গে কৌতুক মিশিয়ে এক অনবদ্য গায়কিতে গানটি গেয়েছিলেন মান্নাদা। শুনতে মজা লাগে, কিন্তু গাওয়াটা খুব কঠিন। আর লিপ দেওয়াও একটা শক্ত ব্যাপার। গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মান্নাদা-র খুব প্রিয় অভিনেতা। একদিন দেখা হতে সৌমিত্রবাবু বললেন, ‘যা গেয়েছেন না মান্নাদা, আমি পড়ে গেছি বিপদে। পারব তো ঠিক মতো’। বাঘে বাঘে যুদ্ধ। যেমন সুর, তেমন মান্নাদা-র গাওয়া, আর সৌমিত্রবাবু ফাইনালি সে গানের জাস্টিস করলেন। গানটি আসলে খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু কোনও সমস্যাই হল না কারণ গানের মধ্যে মান্নাদাই তো অর্ধেক অভিনয় করে দিয়েছিলেন।
মান্নাদা-র প্রিয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লাও এই প্রসঙ্গ বারবার বলেন, ‘মান্নাদা শুধু একজন বিরাট মাপের গাইয়েই নন, উনি একজন বড় অভিনেতাও। যাকে বলে সিংগিং-অ্যাক্টিং, তা উনি একেবারে নিখুঁত ভাবে আয়ত্ত করেছিলেন।’
মান্নাদা-র সুরে সম্ভবত হৈমন্তীদিই সব থেকে বেশি গান রেকর্ডিং করেছেন (মান্নাদা নিজে বাদে)। গানের প্রতি মান্নাদা-র ভালবাসা, ইনভলভমেন্ট অপরিসীম। হৈমন্তীদির একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনি। দমদমে এইচ এম ভি স্টুডিওতে মান্নাদা-র সুরে হৈমন্তীদির গানের রেকর্ডিং চলছে—‘কেন নয়নে আবির ছড়ালে’—এই ‘ছড়ালে’ শব্দটায় মান্নাদা একটা অপূর্ব কাজ লাগিয়েছিলেন। রেকর্ডিংয়ের সময় হারমোনিয়ামে সুরটা ধরছিলেন মান্নাদা। মান্নাদা যেমনটি চাইছিলেন হৈমন্তীদি তেমন ভাবেই ‘ছড়ালে’ কথাটি গাইলেন। শুনে মান্নাদা এত খুশি হলেন যে, হাতটা হারমোনিয়ামের কোনায় লেগে কেটে গেল, রক্ত পড়তে লাগল। সবাই ছুটে এল হৈ হৈ করে। মান্নাদা খুশি উপচানো মুখে শান্ত ভাবে হৈমন্তীদিকে বললেন, ‘দারুণ হচ্ছে, আগে গানটা শেষ করো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’

খুব মন খারাপ করে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে এসেছেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। পুজোর জন্য একটা গান লিখছিলেন শচীনকর্তা গাইবেন বলে। গানের কথা পছন্দ হলেও স্ত্রী মীরা দেববর্মনের কথায় অন্য গান তৈরি হয়ে গেছে—তাই গৌরীবাবুর লেখা গানটি আর গাওয়া যাচ্ছে না। গানের কথা পড়ে অরবিন্দবাবুর এত ভাল লাগল যে সুরকার নচিকেতা ঘোষকে দিয়ে গানটি সুর করিয়ে ফেললেন। তখন ‘নিশিপদ্ম’ ছবির কাজ চলছে। মূল চিত্রনাট্যে না থাকা সত্ত্বেও জহর রায়ের লিপে একটা সিচুয়েশন তৈরি করে ফেললেন অরবিন্দবাবু। গানটি হল ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাব না।’ গাইবে কে? সমস্বরে একটা নামই এল—মান্না দে। তাঁর মতো অ্যাক্টিং করে আর কেই বা গাইতে পারে? একবার কথা প্রসঙ্গে মান্নাদা বলেছিলেন, কী অসাধারণ কথা, মনে হচ্ছে হাল্কা গান, কিন্তু শেষ লাইনটা খেয়াল করেছেন—কী ফিলজফি—‘আমার মনটা যখন সিরাজ সাজে, ভাগ্য মীরজাফর।’ এই ছবিতেই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটা গান গেয়েছিলেন মান্নাদা—‘ওরাই রাতের ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু খায়।’ গায়কীর এই কনট্রাডিকশন একমাত্র মান্নাদা-র পক্ষেই সম্ভব ছিল। ‘নিশিপদ্ম’ ছবির জন্য মান্নাদা পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ গায়কের জাতীয় পুরস্কার।

গান শোনা ছিল মান্নাদা-র প্রাথমিক কাজ। দেশ-বিদেশের সব রকমের গান শুনতেন। বর্তমান সময়েও কে কেমন গাইছে, সে খবরও রাখতেন। উৎসাহ দিতেন। এ অভ্যাস মান্নাদা-র বরাবরের। ১৯৫৭ সালের কথা। শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায় তখন কিশোরী মাত্র। সর্ব ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন। অন্যতম বিচারক ছিলেন বিশিষ্ট সুরকার অনিল বিশ্বাস। আরতি এসেছেন অনিলবাবুর বাড়িতে। সেই সময় মান্নাদাও এসেছেন। আরতিকে চিনতেন না। মান্নাদা তখনই মুম্বইয়ে বেশ নামকরা গায়ক। ইতিমধ্যে ১০০টার বেশি হিন্দি ছবিতে গেয়ে ফেলেছেন—রামরাজ্য,আওয়ারা, বুটপালিশ, দো বিঘা জমিন, মশাল, পরিণীতা, দেবদাস, সীমা, শ্রী৪২০, বসন্তবাহার—এমন সব কত বিখ্যাত ছবিতে মান্নাদা-র সব বিখ্যাত গান। মান্নাদাকে চোখের সামনে দেখাও পরম ভাগ্যের ব্যাপার। আরতি অবাক হয়ে শুনলেন মান্নাদা অনিল বিশ্বাসকে বলছেন —‘অল ইন্ডিয়াতে আরতি নামে যে বাচ্চা মেয়েটা প্রথম হয়েছে, তার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দেবেন তো’।

সমসাময়িক একটা ঘটনা বলি। ২০১২ সালের শেষ দিকে। তখন বৌদিও চলে গেছেন। মান্নাদা-রও শরীর মন একদম ভাল নেই। ফোনে প্রায়ই কথা হত। একদিন মান্নাদা-র কথা শুনে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও অবাক হয়ে গেলাম। একটি বাংলা সিরিয়ালে নতুন একটি ছেলে দারুণ গাইছে। মান্নাদা-র ভীষণ ভাল লেগেছে। আমি যদি কষ্ট করে ছেলেটিকে মান্নাদা-র এই ভালর কথা জানিয়ে দিই, মান্নাদা কৃতজ্ঞ থাকবেন।

মান্নাদা, বারবার আপনার কাছেই তো কৃতজ্ঞ হয়েছে গানের পৃথিবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE