Advertisement
E-Paper

আমিও আমার বাবা-মা’র কাছে চললাম

মৃত্যুর আগে এটাই ছিল মান্না দে-র বড় মেয়ে রমার শেষ কথা। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী।মান্নাদার রমা মা একটা ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। সারা শরীরে মৃত্যুর ছায়া। রমাদি কোনও রকমে চোখদুটো খুললেন। মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করে বললেন, ‘‘ডোন্ট ওয়ারি বকুল, আই অ্যাম গোয়িং টু মাই ড্যাডি অ্যান্ড ম্যামি।’’

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩৯

মান্নাদার রমা মা

একটা ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। সারা শরীরে মৃত্যুর ছায়া। রমাদি কোনও রকমে চোখদুটো খুললেন। মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করে বললেন, ‘‘ডোন্ট ওয়ারি বকুল, আই অ্যাম গোয়িং টু মাই ড্যাডি অ্যান্ড ম্যামি।’’ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বকুলও অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ইউ অলসো ডোন্ট ওয়ারি মাই ডিয়ার। আই অ্যাম ফলোয়িং ইউ সুন’’। সে-কথা শুনে রমাদি চোখ বন্ধ করলেন। চোখের কোলে ক্ষীণ জলের ধারা।

১৮ নভেম্বর, ২০১৫। বিকেল ৬টা ২৮। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড হাসপাতাল থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন রমাদি। সুরমা হেরকর। মান্নাদার বড় আদরের ‘রামি’—রমা মা। মান্নাদার বড় মেয়ে। দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে লড়াই করেছেন দুরারোগ্য ক্যানসারের সঙ্গে। পাঁচবার অপারেশন হয়েছে। খুবই যন্ত্রণাদায়ক। একবার তো ডাক্তার ভুল করে একটা নার্ভ কেটে দিয়েছিল। ফলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। সবাই ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেছিল। আপত্তি করেছিলেন রমাদি-ই। মানুষমাত্রেই ভুল হয়। সবার যখন চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে, অবিচল থেকেছেন শুধু রমাদি। নিজেই সান্ত্বনা দিতেন সবাইকে— ‘‘আমেরিকায় এত ভাল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। তোমরা কেন এত ভাবছ? দেখো, আমি একদম ঠিক হয়ে যাব’’।

২০০৯। এক অনুষ্ঠানের জন্য মান্নাদা কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু সেই চেনা মেজাজে নেই। মুড প্রচণ্ড খারাপ। একটা রেকর্ডিঙের শ্যুটিং ছিল। মান্নাদারই সুর। চা-স্ন্যাক্স এল যেমন আসে। আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম—‘‘দাদা, শরীরটা কি ভাল নেই?’’ মান্নাদা আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘রমার শরীরটা একদম ভাল নেই। মেয়েটার উপর দিয়ে যে কী ধকল যাচ্ছে! একের পর এক অপারেশন। ও আর কত সহ্য করবে? আমিও আর পারছি না....’’ বলতে বলতে মান্নাদাও কেঁদে ফেললেন। কারও মুখে কথা নেই। মান্নাদা একটু সামলে নিয়ে বললেন—‘‘রমার এমন কঠিন অসুখ হবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমার স্ত্রী কী ভাবেই না দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন! ওদের জন্য বেস্ট ফুড, বেস্ট লাইফ স্টাইল। সব কিছু ছিল একটা সিস্টেমের ভিতর। অথচ কোথা থেকে কী হয়ে গেল!’’

পরের দিন মান্নাদা বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। মনটা খুঁতখুঁত করছিল। ফোনে দু’একটা কথার পরে জিজ্ঞাসা করলাম রমাদির কথা। মান্নাদা বললেন, ‘‘খুব খারাপ অবস্থা। রমা বোধহয় আর বাঁচবে না। যে কোনও সময় খারাপ খবর আসতে পারে।’’ এ অবস্থায় কী আর বলা যায়! তবু বলার চেষ্টা করলাম—‘‘আপনি এত চিন্তা করবেন না দাদা। কত ভাল চিকিৎসা হচ্ছে। দিদি ভাল হয়ে যাবেন।’’ এবার মান্নাদা শান্তভাবে বললেন, ‘‘মিথ্যে সান্ত্বনা দেবেন না প্লিজ!’’

দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে প্রিয় সন্তানের যন্ত্রণা মান্নাদাকে কুরে কুরে খেয়েছে। প্রচণ্ড কষ্টের ভিতর দিয়ে সন্তান অবধারিত মৃত্যুর দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে...মান্নাদা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছেন সেই মৃত্যুযন্ত্রণা। নতুন নতুন গানের রেকর্ড করছেন, সারা পৃথিবী জুড়ে কত অনুষ্ঠান, সুরের ধারায় সবাই ভেসে গিয়েছে, কেউ জানতেও পারেনি কী গভীর বেদনা বহন করে মান্নাদা সঙ্গীত পরিবেশন করছেন, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পবিত্র কর্তব্য পালন করে গিয়েছেন।

ম্যাডামের মতো রমাদির কথা বলতে বলতেও গর্বে মান্নাদার বুক ফুলে যেত। উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর মুখ। বেশ হোমওয়ার্ক করে একদিন মান্নাদাকে বললাম, ‘‘আপনি আমাকে ‘দেবপ্রসাদবাবু’ ‘আপনি’ বলেন। রমাদির তো ১৯৫৫-য় জন্ম। আমি রমাদির থেকেও কত ছোট। আমাকে কেন নাম ধরে ‘তুমি’ বলে ডাকবেন না?’’ মান্নাদা সে কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, ‘‘তাই তো! দেখতে দেখতে রমাও কত বড় হয়ে গেল। কী ভাবে যে দিন চলে যায়! আপনি তো রমাকে দেখেননি। দেখবেনই বা কী করে? ও তো বহু দিন ধরে আমেরিকায়। ঈশ্বর ওকে সব কিছু দিয়েছেন। ওর মায়ের মতো বিদ্যা, মায়ের মতো গুণ আর রূপ। ও ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল গান করত। রমার গলায় ইংরেজি গান শুনলে আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে যেত। তেমন সুন্দর নাচতও।’’

বললাম, ‘‘রমাদিকে তেমন করে গান-বাজনায় পেলাম না কেন দাদা?’’ মান্নাদা কথাটাকে লুফে নিয়ে বললেন—‘‘পাবেন কী করে? লেখাপড়ায়ও তো মারাত্মক ছিল। ওর মা ছিল ইংরেজিতে এম এ, তার পর বিটি। বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা পড়াত। রমাও মায়ের মতো সব পরীক্ষাতেই প্রথম হত। পড়াশোনাতেই ওর ন্যাক-টা বেশি ছিল। বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে যখন বলল হায়ার এডুকেশনের জন্য আমিরেকায় যেতে চায়, আমি আর আপত্তি করিনি। রমা আর ওর হাজব্যান্ড বকুল দু’জনেই কম্পিউটার নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছে—এখন তো ক্যালিফোর্নিয়ায় সান মাইক্রো সিস্টেমে দু’জন খুব উঁচু পোস্টে চাকরি করে।’’ যদিও মান্নাদা ফোনের ও পারে, আমি এক গর্বিত পিতার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

রমাদি আজীবন প্রবল ভাবে টেনেছেন মান্নাদাকে। প্রতি বছর মে-জুন মাস নাগাদ ছুট লাগাতেন আমেরিকায় মেয়ের কাছে। সারা আমেরিকা জুড়ে মান্নাদার অনুষ্ঠান লেগে থাকত। সেই তিন-চার মাস কিন্তু মনটা পড়ে থাকত কখন ফিরবেন মেয়ের বাড়ি। পূর্ণপাত্র স্নেহ নিয়ে যেতেন, উজাড় করে দিতেন, পাত্র, আবার কানায় কানায় ভর্তি হয়ে উঠত। রমাদি কত বার বলেছেন, ‘‘অনেক তো হল, এ বার তুমি একেবারে আমার কাছে চলে এসো।’’ বাবাকে বলতেন বেস্টেস্ট, ...হাইয়েস্ট অ্যান্ড ব্রাইটেস্ট স্টার ইন আওয়ার স্কাই। মুগ্ধ ছিলেন মায়ের প্রতি স্বামী হিসেবে, সন্তানদের অসীম স্নেহময় এক পিতা হিসেবে।

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মান্নাদা কারও কাছে আমার দাদা ড. শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তীর কথা শুনেছিলেন। দাদা ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাকরামেন্টোতে সেটেলড। বিশ্ব-বিখ্যাত রকেট-বিজ্ঞানী। নাসার প্রধান প্রধান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পরামর্শদাতা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য। ইউ সি এল-এর অধ্যাপক। এই দুটি জায়গায় অধিকাংশ সহকর্মীই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। এ দিকে পঞ্চাশ বছর বয়েসে পার হয়েছেন ইংলিশ চ্যানেল। প্রথম বাঙালি ট্রেইন্ড অ্যাস্ট্রোনট। স্বীকৃত পাইলটও। চালিয়েছেন মিগ-২৫ (শব্দের থেকে তিন গুণ স্পিড)। উত্তর মেরু অভিযানে আমেরিকাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মান্নাদা বললেন, ‘‘মশায়, এমন দাদার সঙ্গে একবার আলাপ করালেন না!’’ এ দিকে দাদাও মান্নাদার সঙ্গে আলাপ করার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আমেরিকায়। কিন্তু এখনও প্রতিদিন মান্নাদার গান শোনা চাই। এমন অনেক সিনেমা বারবার দেখেন শুধু মান্নাদার গান শোনার জন্য। ফোনে ফোনে আলাপ হল। মান্নাদা বললেন, ‘‘রমা তো পালে অল্টোয় থাকে। আপনার বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। ওর সঙ্গে আলাপ হলে ভাল লাগবে। বকুলের সঙ্গেও আপনার বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।’’ দাদা ইতস্তত করে বললেন, ‘‘আমার কী পরিচয় দেব?’’ মান্নাদা অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কেন? বলবেন আপনি দেবপ্রসাদবাবুর দাদা।’’ দাদা আবার সংকুচিত, ‘‘ভাইয়ের নাম বললে চিনবে?’’ মান্নাদা এ বার হেসে ফেললেন—‘‘চিনবে না মানে? আমরা একসঙ্গে এত দিন ধরে কাজ করছি। ‘আমার প্রিয় মনীষীর গান’ তো রমার খুব প্রিয়। ওর আমেরিকান বন্ধুদের মানেও বুঝিয়ে দেয়। একবার ফোন করেই দেখুন না।’’ এই হল মান্নাদার শিক্ষার অবিশ্বাস্য উত্তরাধিকার। সব ক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতা হয় না। অনেক শিল্পীই তো গীতিকারের নামই মনে রাখেন না। মান্নাদাই প্রথম গান গাওয়ার আগে সে গানের গীতিকার-সুরকারেরর নাম বলা শুরু করেন। মান্না-রমাদি-বৌদির শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই এক জায়গায় এসে মিশেছে—সাধারণ মানুষকেও তাঁরা মনে রেখেছেন।

বড় মেয়ে মান্নাদার ‘রামি’, ‘রমা মা’, ছোট মেয়ে ‘চুমু মা’। যখন আমেরিকায় যেতেন রমাদিকে ভুল করে ডেকে ফেলতেন ‘চুমু মা’ বলে। আবার যখন বেঙ্গালুরুতে ফিরতেন সুমিত্রাদিকে বারবার ডাকতেন ‘রমা মা’ বলে। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ—সুদূরে—বারবার মান্নাদা ছুটেছেন এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে। তাঁর চোখের মণিকে দেখলেই সব চাওয়া শেষ হয়ে যেত।

আপনি আজ বড় নিশ্চিন্ত মান্নাদা। আর ঘোরাঘুরি নেই। আমি দেখতে পাই এক দৃশ্য। হাসিমুখে আপনার রমা মা এসেছে। ম্যাডামও খুশি। আপনাদের নতুন জীবন নতুন ভাবে কাটুক। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। আপনার অনন্ত আনন্দদানের গানের মতো আপনারা সবাই ভাল থাকুন। নব আনন্দে।

manna dey daughter rama debaprasad chakraborty manna blog affectionate father
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy