China may tighten its export as a weapon to destroy Indian economy dgtl
India China Trade
ওষুধ থেকে মোবাইল-ইভি, চিনা ‘কুয়ো’য় হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের অর্থনীতি! বেজিঙের ‘বাণিজ্য-বাণ’ রুখতে পারবে নয়াদিল্লি?
চিনের সঙ্গে দিন দিন বেড়েই চলেছে বাণিজ্যিক ঘাটতি। পাশাপাশি, শিল্পক্ষেত্রে বেজিঙের উপর বাড়ছে নির্ভরশীলতা। ফলে আগামী দিনে বহু পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে ভারতীয় অর্থনীতির বড় ক্ষতি করতে পারে ড্রাগন। এই পরিস্থিতিতে কী করবে কেন্দ্র?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ১৬:৩৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
সীমান্ত সংঘাতে ফেল! পূর্ব লাদাখের ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলওসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) লাল চোখ দেখিয়ে লাভ কিছুই হয়নি। উল্টে আন্তর্জাতিক ভাবে বেড়েছে চাপ। এই পরিস্থিতিতে ফের আর্থিক আক্রমণ শানিয়ে ভারতকে ভিতর থেকে দুর্বল করার নোংরা ষড়যন্ত্রে নেমেছে চিন। সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু সামগ্রীর রফতানিতে হ্রাস টেনেছে বেজিং। ড্রাগনের এ-হেন চালবাজিতে ভুরু কুঁচকেছেন নয়াদিল্লির কূটনীতিকেরা।
০২২০
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকা ভারতের অর্থনীতি বহু ক্ষেত্রে চিনের উপর নির্ভরশীল। ড্রাগনভূমি থেকে আমদানি করা কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সংস্থা। আগামী দিনে বেজিং ওই সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করলে এ দেশের উদ্যোগপতিরা যে আতান্তরে পড়বেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তা-ই নয়, চিনের ওই পদক্ষেপের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে এ দেশের অর্থনীতির সূচকে।
০৩২০
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। বেজিঙের লালফৌজের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ মোট ২০ জন সৈনিক। অন্য দিকে, অন্তত ৪০ জন পিএলএ সেনার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছিল পশ্চিমি গণমাধ্যম। এর পরই ‘অবাধ্য’ বেজিংকে শিক্ষা দিতে সেখান থেকে আমদানি হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
০৪২০
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্তে বড়সড় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে চিন। অর্থনীতির সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকায় প্রত্যাঘাত শানাতে ওই বছর ‘রফতানি নিয়ন্ত্রণ আইন’ (পড়ুন এক্সপোর্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ২০২০) পাশ করে বেজিং। এর জেরে ভারতের বিপদ বেড়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
০৫২০
কী বলা আছে ড্রাগনের রফতানি নিয়ন্ত্রণ বিধিতে? সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তা এবং দেশীয় স্বার্থের অজুহাত দিয়ে যে কোনও সময় যে কোনও পণ্যের রফতানি সাময়িক স্থগিত বা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দ্বৈত প্রয়োজনে ব্যবহার হওয়া পণ্যগুলির ক্ষেত্রে এই নিয়ম বেশি কার্যকর হবে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
০৬২০
উদাহরণ হিসাবে বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভির (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) কথা বলা যেতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই ধরনের গাড়ি নির্মাণে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে উঠে আসবে ভারত। এ-হেন ইভির ব্যাটারি তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিরল খনিজ পদার্থ, যার ৮২ থেকে ৯০ শতাংশ চিন থেকে আমদানি করে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, আগামী দিনে সেটা বন্ধ করতে পারে বেজিং।
০৭২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত কয়েক বছরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে ভারত। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে বিমানবাহী রণতরী, ড্রোন, রেডার এবং ডুবোজাহাজ তৈরি করছে এ দেশের সরকারি-বেসরকারি বহু সংস্থা। এই ধরনের হাতিয়ার তৈরিতেও অনেক সময় বিরল খনিজ পদার্থের প্রয়োজন হয়। ফলে সহজেই জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে সেগুলির রফতানি বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে ড্রাগন সরকারের হাতে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ইভি শিল্পে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৮২০
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গালওয়ান সংঘর্ষের পর জাতীয়বাদী হাওয়ায় সাময়িক ভাবে কমেছিল চিনা পণ্য আমদানি। কিন্তু, পরবর্তী বছরগুলিতে সেই সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে বাড়তে থাকে বাণিজ্যিক ঘাটতি। গত অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) সেই অঙ্ক ৯৯২ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। অর্থাৎ, বর্তমানে বেজিংকে মাত্র এক ডলারের পণ্য বিক্রি করছে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে, সেখান থেকে কিনছে ১০ ডলারের সামগ্রী।
০৯২০
বিশ্লেষকদের দাবি, গালওয়ান-কাণ্ডের আগে চিন থেকে বাজারজাত পণ্য বেশি পরিমাণে আমদানি করত ভারত। গত পাঁচ বছরে নিম্নমুখী হয়েছে সেই সূচক। পরিবর্তে কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে কাঁচামাল কেনার অঙ্ক। ফলে ড্রাগনের উপর আরও বেড়েছে নির্ভরশীলতা। সরকারি তথ্য বলছে, গত আর্থিক বছরে (২০২৪-’২৫) সর্বমোট আমদানি হ্রাস পেলেও বেজিংয়ের পণ্য কেনার পরিমাণ ৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
১০২০
বিশ্লেষকদের দাবি, ইভিকে বাদ দিলে অন্যান্য বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, টেলিকম এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী দেশীয় সংস্থাগুলি চিনের উপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম এবং টেলিকম ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশ কাঁচামাল আসে চিন থেকে। ওষুধ তৈরিতে যে জটিল জৈবিক উপাদানের প্রয়োজন হয়, তার ৭০ শতাংশ বেজিঙের থেকে কিনতে হয় ভারতকে। পেনিসিলিনের মতো জটিল অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে সেটা ৯০ শতাংশ বলে জানা গিয়েছে।
১১২০
বর্তমানে বিশ্বের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বিরল খনিজ উপাদান সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের হাতে। ভারতের মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের লোকসান করতে পারে বেজিং। কারণ, ৯৫ শতাংশ ছাতা, ৫৯ শতাংশ চশমার কাচ এবং প্রায় ৬০ শতাংশ খেলনা ড্রাগনভূমি থেকে এনে এ দেশের বাজারে বিক্রি করে থাকে এই ধরনের বহু শিল্প সংস্থা। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হলে পথে বসতে হতে পারে তাদের।
১২২০
চলতি বছরের গোড়ায় ভারতের মাটিতে আইফোন তৈরিতে উদ্যোগী হয় মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপ্ল। সেইমতো এ দেশে খোলা হয় কারখানা। আইফোনের মূল নির্মাণকারী ইউনিট রয়েছে চিনে। সেখান থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভারতের কারখানায় নিয়ে আসার কথা ছিল। পাশাপাশি, এ দেশের ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার পড়ে মান্দারিনভাষীদের উপর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেজিং নিষেধাজ্ঞা চাপানোয় তৈরি হয়েছে জটিলতা।
১৩২০
একই কথা ‘টানেল বোরিং মেশিন’ বা টিবিএমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গ খুঁড়তে প্রয়োজন হয় এই যন্ত্রের। এর জন্য একটি জার্মান সংস্থাকে বরাত দেয় নয়াদিল্লি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি চিনের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় বিপাকে পড়েছে ভারত। কোনও অবস্থাতেই বেজিং টিবিএমের যন্ত্রাংশ বার্লিনকে সরবরাহ করতে রাজি নয়। ড্রাগনের যুক্তি, সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনাবাহিনীর জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়তে ব্যবহার হবে ওই যন্ত্র।
১৪২০
এই পরিস্থিতিতে মোটেই হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই কেন্দ্র। চিনের এই চালবাজিকে ভেস্তে দিতে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগানের উপর জোর দিয়েছে মোদী সরকার। বর্তমানে বেজিঙের কোনও সংস্থাকে এ দেশে কারখানা খুলতে হলে বাধ্যতামূলক ভাবে কোনও ভারতীয় কোম্পানির হাত ধরতে হবে। এই নিয়মের ফলে আর্থিক অবরোধ তৈরি করা ড্রাগনের পক্ষে বেশ কঠিন হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
১৫২০
এ ছাড়া ‘প্রোডাক্টটিভ লিঙ্কড ইনসেন্টিভ’ বা পিএলআই প্রকল্প চালু করেছে মোদী সরকার। এতে ১৪টি শিল্পক্ষেত্র উপকৃত হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। পিএলআই চালু হওয়ার পর ১.৬১ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি এসেছে টেলিকম এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্মাণের শিল্পে। এ ছাড়া পেনিসিলিনের মতো ওষুধ তৈরির জটিল জৈবিক উপাদান ঘরের মাটিতে তৈরির চলছে চেষ্টা।
১৬২০
চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি দূর করতে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে জোট তৈরি করেছে ভারত। তার মধ্যে কোয়াড (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ) এবং আইটুইউটু গুরুত্বপূর্ণ। কোয়াডে দিল্লির সঙ্গে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, আইটুইউটুর চারটি সদস্য দেশ হল ভারত, ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং আমেরিকা।
১৭২০
এই দুই সংগঠনের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে নয়াদিল্লি। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে চিনের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে গত কয়েক বছরে ইজ়রায়েলের অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছে ভারত। পাশাপাশি, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম এবং ইভির ক্ষেত্রে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে বেজিঙের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে কেন্দ্রের কাছে।
১৮২০
বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কিছু খনির উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। আর্থিক বিশ্লেষকদের পরামর্শ, একই ধরনের পদক্ষেপ করতে হবে ভারতকেও। প্রধানমন্ত্রী মোদীর জমানায় আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আর তাই সেখানকার খনিশিল্পে লগ্নির পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
১৯২০
পাশাপাশি, নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা এবং সেইমতো পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়ার সবচেয়ে বেশি করে বলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের যুক্তি, প্রযুক্তিগত বদল এলে চিন থেকে আমদানি করা বহু পণ্যের আর কোনও প্রয়োজন না থাকতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার এবং শিল্প সংস্থাগুলিকে যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০২০
বেজিঙের ‘বাণিজ্য-বাণ’ ঠেকাতে কেন্দ্রের হাতে দু’টি বড় অমোঘ অস্ত্র রয়েছে। একটি হল, শিল্পের প্রয়োজনীয় বিপুল সংখ্যক সস্তা শ্রমিক এবং ভারতের বিরাট বাজার। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ান এবং ব্রিটেন-সহ বহু দেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করছে নয়াদিল্লির সঙ্গে। পাশাপাশি, এ দেশের কারখানা খোলার ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে একাধিক বহুজাতিক সংস্থার। এতে সময় লাগলেও ড্রাগনের একাধিপত্যে বড় আঘাত আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে।