বাড়তে বাড়তে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছে গিয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেজিঙের শুল্কযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। আর তাই ড্রাগনের পণ্যে নয়াদিল্লি উঁচু হারে শুল্ক চাপাক, চাইছেন অনেকেই।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:০২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
চিনের সঙ্গে আকাশছোঁয়া বাণিজ্য ঘাটতি। এই আবহে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে শুল্কযুদ্ধে জড়িয়েছে বেজিং। ফলে ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রির দরজা বন্ধ হওয়ায় এ দেশের বাজারকে বেছে নেবে না তো ড্রাগন? পরিস্থিতি সে দিকে গেলে মারাত্মক ভাবে ধাক্কা খাবে দেশের অর্থনীতি। আর তাই বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই সুর চড়াচ্ছেন শিল্পপতি থেকে আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০২১৯
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) চিনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ৯,৯০০ কোটি ডলারে পৌঁছয়। ঠিক এক বছর আগে (পড়ুন ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছর) এই অঙ্ক ৮,৫০০ কোটি ডলারে আটকে ছিল। দুই দেশের মধ্যে আমদানি ও রফতানির ফারাক যে দিন দিন বাড়ছে, এই তথ্য দিচ্ছে তারই ইঙ্গিত।
০৩১৯
উত্তর ও উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশী দেশটির ক্ষেত্রে রফতানির সূচক খাদে নেমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। গত আর্থিক বছরে (২০২৪-’২৫) চিনের সঙ্গে রফতানি কমেছে ১৪.৫ শতাংশ। ১,৪২৫ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য ড্রাগনভূমিতে পাঠাতে পারেনি নয়াদিল্লি।
০৪১৯
অন্য দিকে চিনের সঙ্গে ১১.৬ শতাংশ বেড়েছে আমদানি। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতে ১১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, ড্রাগনের ক্ষেত্রে কোভিড অতিমারির সময়ের নীচে চলে গিয়েছে ভারতের রফতানি বাণিজ্য।
০৫১৯
বাণিজ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, এ বছরের মার্চে চিন থেকে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ শতাংশ। ওই মাসে ৯৬০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে ভারত। গত বছরের মার্চে এটি ছিল ৭৭০ কোটি ডলার। অন্য দিকে, এ বছরের মার্চে মাত্র ১৫৫ কোটি ডলারের পণ্য ড্রাগনভূমিতে পাঠাতে পেরেছে নয়াদিল্লি। ২০২৪ সালের নিরিখে এই পরিমাণ তিন শতাংশ কম।
০৬১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে বেজিঙের ঘরোয়া বাজারে ইলেকট্রনিক্স পণ্য, বৈদ্যুতিন ব্যাটারি, সোলার সেল-সহ বেশ কিছু শিল্পসামগ্রীর চাহিদা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়। ফলে পড়ে পাওয়া চোদ্দা আনার মতো বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর কিছুটা সুযোগ পায় ভারত। নইলে ফারাক আরও বেশি হত বলে মনে করছেন তাঁরা।
০৭১৯
সমীক্ষক সংস্থা ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-এর (জিটিআরআই) রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতের প্রধান আটটি শিল্পের ক্ষেত্রে মূল পণ্যগুলি সরবরাহ করে চিন। এটা নয়াদিল্লির কাছে খুবই চিন্তার। বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ঘাটতি শুধুই বাড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
০৮১৯
এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নীতিকে দুষেছেন জিটিআরআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরোয়া উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ দিতে ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেন্টিভ’ বা পিএলআই প্রকল্প চালু করেছে সরকার। কিন্তু, এতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। কারণ দেশীয় শিল্পগুলি কাঁচামাল বা উন্নত যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’’
০৯১৯
জিটিআরআইয়ের তরফে দেওয়া সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, প্রথমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে। পাশাপাশি, শিল্পের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভাবে আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দিল্লিভিত্তিক এই সমীক্ষক সংস্থা। উল্লেখ্য, চিনে মূলত পেট্রোপণ্য, বিভিন্ন খনিজ, জৈব রাসায়নিক, সামুদ্রিক পণ্য এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রী রফতানি করে থাকে ভারত।
১০১৯
বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিদের দাবি, শুল্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় আমেরিকার বাজার চিনের কাছে একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছে। আর তাই বিকল্প বাজারের সন্ধান করছে ড্রাগন। এ ব্যাপারে মূলত ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে পাখির চোখ করছে বেজিং। পাশাপাশি, তাঁদের চোখ রয়েছে ভারতের দিকেও।
১১১৯
কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের আশঙ্কা, আর্থিক লোকসান সামলাতে ভারতে বিপুল পণ্য পাঠিয়ে দিতে পারে চিন। অর্থাৎ, ব্যাপক সস্তা পণ্য কেনার জন্য এ দেশের ব্যবসায়ীদের লোভ দেখানো বেজিঙের পক্ষে মোটেই আশ্চর্যের নয়। আর তখন ড্রাগনভূমির পণ্যে পুরোপুরি ভরে উঠবে বাজার। ফলে মারাত্মক ভাবে মার খাবে দেশীয় শিল্প।
১২১৯
এই পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তার জন্যেই শিল্পপতি এবং আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ চিনা পণ্যের উপর চড়া হারে শুল্ক চাপানোর পক্ষপাতী। ভারত যে কখনওই এই রাস্তায় হাঁটেনি, এমনটা নয়। এর আগে ইস্পাতের ব্যাপারে নয়াদিল্লিকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছে।
১৩১৯
ইস্পাত উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম স্থান দখল করে রয়েছে চিন। এ দেশে রফতানি বাড়াতে অনেক সময়েই বেজিংকে ভারতীয় সংস্থাগুলির চেয়ে সস্তা দরে ইস্পাত বিক্রির চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে। আর তাই ড্রাগনভূমি থেকে আগত ইস্পাতের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে নয়াদিল্লি। ফলে এখানকার বাজারে ব্যবসা করা চিনা ইস্পাতের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়েছে।
১৪১৯
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষে চিনা পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক আরোপ করা সম্ভব নয়। কারণ, বেজিঙের সস্তা সামগ্রী এ দেশের ঘরোয়া বাজারে না এলে লাফিয়ে বাড়বে মুদ্রাস্ফীতির হার। ড্রাগনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার জেরে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে আমেরিকা।
১৫১৯
নতুন শুল্কনীতির ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার যে ভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, তা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে। ফলে এই ঝুঁকি কেন্দ্রের পক্ষে নেওয়া কার্যত অসম্ভব। তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে।
১৬১৯
বিশেষজ্ঞদের অপর অংশের দাবি, আমেরিকার মতো একবারে বিপুল অঙ্কের শুল্ক চাপালে অবশ্যই আকাশছোঁয়া হবে মুদ্রাস্ফীতির হার। কিন্তু, তার বদলে বিশেষ কিছু পণ্যকে বেছে নিয়ে শুল্কের হার বৃদ্ধি করলে পরিস্থিতি সামলানো মোটেই কঠিন হবে না। ঠিক যেমনটা ইস্পাতের ক্ষেত্রে হয়েছে। এতে যে সময় পাওয়া যাবে, তাতে শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে আরও সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পাবে ভারত।
১৭১৯
চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাতে চিনা পণ্যে ৬৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন তিনি। কিন্তু বেজিং এর বিরোধিতা করে পাল্টা কর চাপালে দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে বেধে যায় বাণিজ্য-যুদ্ধ। এর কয়েক দিনের মধ্যেই চিনা পণ্যের শুল্কের অঙ্ক ২৪৫ শতাংশ করে যুক্তরাষ্ট্র।
১৮১৯
মার্কিন-চিন শুল্কযুদ্ধের ফয়দা নিতে ভারতীয় সংস্থাগুলিকে বেশি করে আমেরিকার পণ্য কেনার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। পাশাপাশি, বেজিঙের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে একটি আন্তঃমন্ত্রক প্যানেল তৈরি করেছে কেন্দ্র। তাতে বাণিজ্য বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্স), বিদেশি বাণিজ্য (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড), শুল্ক দফতর এবং শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচার বিভাগের অফিসারেরা রয়েছেন।
১৯১৯
চিনা পণ্যে এ দেশের বাজারে ‘ডাম্পিং’ হচ্ছে কি না, সে দিকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্যানেলটিকে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রকে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা পড়বে। তার পরই বেজিঙের পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মোদী প্রশাসন। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি কেন্দ্র।