পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর বদলার আগুনে জ্বলছে দেশ। সন্ত্রাসী পাকিস্তানের ফৌজ সরাসরি যুদ্ধে নামলে আদৌ কি এঁটে উঠতে পারবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৩
ভূস্বর্গের বরফে চাপ চাপ রক্ত! পাকিস্তান মদতপুষ্ট জঙ্গিদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে চলে গিয়েছে ২৬টি তাজা প্রাণ। পহেলগাঁওয়ের সেই হাড় হিম করা আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা দেশ। ইতিমধ্যেই একাধিক পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। তবে কি ফের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? না কি এ বার সরাসরি যুদ্ধেরই বিউগল বাজিয়ে দেবে নয়াদিল্লি? এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
০২২৩
সাবেক সেনা অফিসারদের বড় অংশই, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পক্ষপাতী নন। তাঁদের যুক্তি, সন্ত্রাসবাদের বিষাক্ত সাপ আসলে পাকিস্তানের সেনা। যত ক্ষণ না রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি অফিসার ও জওয়ানদের নিকেশ করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত কাশ্মীরে বন্ধ হবে না রক্তের হোলি খেলা। এতে বার বার প্রাণ যাবে নিরীহ নাগরিকদের। আর তাই রণক্ষেত্রে পাক বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল করছেন তাঁরা।
০৩২৩
স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে মোট চার বার সম্মুখসমরে গিয়েছে উপমহাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতি বারই ভারতের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে পাকিস্তান। আধুনিক সময়ে অবশ্য পদ্ধতিগত ভাবে অনেক বদলে গিয়েছে যুদ্ধ। এসেছে নতুন নতুন গণবিধ্বংসী হাতিয়ার। নয়াদিল্লির মতো ইসলামাবাদের হাতেও রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। কিন্তু তার পরও মুখোমুখি লড়াইয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের এঁটে ওঠা বেশ কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্বের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
০৪২৩
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সৈন্যশক্তির দিক থেকে কোন দেশ কতটা শক্তিশালী, সেই সংক্রান্ত একটি তালিকা প্রকাশ করে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’। মোট ১৪৫টি দেশের মধ্যে সেখানে ভারতকে চতুর্থ স্থানে রেখেছে এই সমীক্ষক সংস্থা। গত বছরের নিরিখে নয়াদিল্লি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারলেও অবনমন হয়েছে পাকিস্তানের। তালিকার ১২ নম্বরে জায়গা পেয়েছে ইসলামাবাদ।
০৫২৩
ভারতের স্থলসেনা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। সেখানে অ্যাক্টিভ এবং রিজ়ার্ভ দুই ধরনের সৈনিক রয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা যথাক্রমে ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫৫০ এবং ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার। পাক ফৌজের অ্যাক্টিভ সেনার সংখ্যা ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। এ ছাড়া রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের কাছে রয়েছে সাড়ে পাঁচ লক্ষের একটি রিজ়ার্ভ বাহিনী। এই সংখ্যার নিরিখে ইসলামাবাদ রয়েছে সাত নম্বরে।
০৬২৩
আধাসেনার সংখ্যার দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের র্যাঙ্কিং যথাক্রমে দুই ও ছয়। ২৫.২৭ লক্ষ আধাসেনার বাহিনী রয়েছে নয়াদিল্লির। পাকিস্তানের আধাসেনার সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। সেনাবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন দুই দেশের আধাসৈনিকেরা। ভারতের আধাসেনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন।
০৭২৩
ভারতীয় স্থলবাহিনীর হাতে রয়েছে ৪,২০১টি ট্যাঙ্ক এবং ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪টি সাঁজোয়া গাড়ি। চাকা লাগানো কামানের (সেল্ফ প্রপেল্ড হাউইৎজ়ার) সংখ্যা ১০০। এ ছাড়া ৩,৯৭৫টি অন্য ধরনের কামানও ব্যবহার করে এ দেশের সেনাবাহিনী। অন্য দিকে পাক ফৌজের ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এবং কামানের সংখ্যা যথাক্রমে ২৬২৭, ১৭৫১৬ এবং ২৬২৯।
০৮২৩
চাকা লাগানো কামান অবশ্য ভারতের চেয়ে বেশি রয়েছে ইসলামাবাদের। সেটির সংখ্যা ৬৬২। নয়াদিল্লির গোলন্দাজ বাহিনী আবার পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, এই রকেট লঞ্চার থেকে মাত্র ৪৪ সেকেন্ডে ছোড়া যায় ৭২টি রকেট। বর্তমানে এর পাল্লা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। মধ্য এশিয়ার দেশ আর্মেনিয়া ভারতের থেকে এই হাতিয়ারটি আমদানি করেছে।
০৯২৩
পাক সেনা যে রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে তার নাম ফতেহ। এর পাল্লা ও শক্তি পিনাকার নিরিখে অনেকটাই কম। ভারতীয় হাতিয়ারটি থেকে একসঙ্গে ছ’টি রকেট ছোড়া সম্ভব। অন্য দিকে ইসলামাবাদের রকেট লঞ্চারে রয়েছে মাত্র দু’টি রকেট। তবে সংখ্যার দিক থেকে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা বেশি রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছে রয়েছে ৬০০টি ফতেহ। আর ভারতীয় সেনা পিনাকা মোতায়েন করেছে ২৬০টি।
১০২৩
ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। ফিলিপিন্সকে ইতিমধ্যেই তা রফতানি করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ব্রহ্মস কেনার প্রতিরক্ষা চুক্তি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
১১২৩
এ ছাড়া একাধিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে। তার মধ্যে অন্যতম হল অগ্নি-৫। অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে প্রলয়, সূর্য ও পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ। এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। পাক ফৌজ ব্যবহার করে গজ়নভি, আবদালি, শাহিন এবং বাবরের মতো ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি অধিকাংশই ব্যালেস্টিক শ্রেণির। তবে পাল্লার দিক থেকে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ইসলামাবাদের দূরপাল্লার অস্ত্র।
১২২৩
বর্তমানে হাইপারসোনিক (শব্দের পাঁচ গুণ বেশি জোরে ছুটতে পারে) ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দিয়েছে ডিআরডিও। এতে প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছে ভারত। মহাশূন্যে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহ, অন্তরীক্ষযান বা মহাকাশ স্টেশনকে চোখের নিমেষে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। পাকিস্তানের কাছে এই ধরনের কোনও হাতিয়ার নেই।
১৩২৩
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’ জানিয়েছে, ভারতীয় নৌসেনার রয়েছে মোট ২৯৩টি রণতরী। এর মধ্যে বিমানবাহী যুদ্ধপোতের সংখ্যা দুই। এই ধরনের আরও একটি রণতরী তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। ১৩টি ডেস্ট্রয়ার, ১৪টি ফ্রিগেট এবং ১৮টি করভেট ব্যবহার করেন এ দেশের জলযোদ্ধারা।
১৪২৩
ভারতীয় নৌসেনায় মোট ডুবোজাহাজের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে তিনটি পরমাণু শক্তিচালিত এবং পরমাণু হাতিয়ারে সজ্জিত ডুবোজাহাজ। পাক নৌবাহিনীর হাতে থাকা মোট রণতরীর সংখ্যা ১২১। ইসলামাবাদের কোনও বিমানবাহী রণতরী বা ডেস্ট্রয়ার নেই। মাত্র ৮টি ডুবোজাহাজ এবং ৯টি করে ফ্রিগেট ও করভেট ব্যবহার করে তারা। এর মধ্যে একটি ডুবোজাহাজও পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত নয়।
১৫২৩
মোট ৫১৩টি লড়াকু বিমান রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনায়। পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ৩২৮টি। দু’টি দেশের কাছেই কোনও বোমারু বিমান নেই। নয়াদিল্লির হাতে থাকা মালবাহী বিমানের সংখ্যা ২৭০। অন্য দিকে ইসলামাবাদের কাছে এই ধরনের বিমান রয়েছে ৬৪টি।
১৬২৩
তিন বাহিনী মিলিয়ে ভারতীয় ফৌজ মোট ৮৯৯টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। এর মধ্যে হামলাকারী হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৮০। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ৫৭। ইসলামাবাদের মোট হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৩৭৩।
১৭২৩
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ব্যবহার শুরু করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। এ ছাড়া ঘরোয়া প্রযুক্তিতে তৈরি আকাশ নামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে। অন্য দিকে চিনের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে ইসলামাবাদ। কয়েক বছর আগে ভুলবশত একটি ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র পাক মাটিতে আছড়ে পড়ে। সেটিকে চিহ্নিতই করতে পারেনি ওই চিনা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফলে সেটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
১৮২৩
আধুনিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে ড্রোন। সে দিক থেকে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ভারত। ঘরের মাটিতে তৈরি একাধিক আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যান রয়েছে নয়াদিল্লির অস্ত্রাগারে। এ ছাড়া আমেরিকা থেকে এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন কিনেছে মোদী সরকার। পাক সেনা আবার ব্যবহার করে তুরস্কের তৈরি ব্যারেক্টার টিবি-২ নামের আত্মঘাতী ড্রোন।
১৯২৩
সুইডিশ গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের থেকে ভারতের কাছে বেশি সংখ্যায় পরমাণু হাতিয়ার রয়েছে। তাঁদের দাবি, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের আণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৭২ ও ১৭০। তবে নিউট্রন, ফিশন এবং থার্মোনিউক্লিয়ার— এই তিন ধরনের অস্ত্রই রয়েছে ভারতীয় ফৌজের অস্ত্রাগারে। পাশাপাশি, অতিরিক্ত ১৮০-২০০টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।
২০২৩
‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট’-এর রিপোর্টে আবার বলা হয়েছে, বর্তমানে নয়াদিল্লির পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১৮০। মার্কিন বিজ্ঞানীদের দাবি, এক বছর আগেও ভারতের মোট পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ১৭৪। এর পর আরও ছ’টি আণবিক ওয়ারহেড বৃদ্ধি করে নয়াদিল্লি। পাকিস্তান সেটা করতে পারেনি।
২১২৩
শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে ভারত। অর্থাৎ, জল, স্থল এবং আকাশ— তিন জায়গা থেকে পরমাণু হামলার ক্ষমতা রয়েছে নয়াদিল্লির। এমনকি সমুদ্রের গভীরে থেকেও আণবিক আক্রমণ চালাতে পারবে ভারতের নৌসেনা। এই ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই।
২২২৩
চলতি বছরের এপ্রিলে লেজ়ার হাতিয়ারের সফল পরীক্ষা চালায় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। অস্ত্রটির পোশাকি নাম ‘এমকে-টু(এ) লেজ়ার’। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ‘ডিরেক্ট এনার্জি ওয়েপন সিস্টেম’ বা ডিইডব্লিউ। হাতিয়ারটি একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ ড্রোন হামলাকে রুখে দিতে পারবে বলে দাবি করা হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে এই ধরনের কোনও হাতিয়ার নেই।
২৩২৩
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানিদের ‘সার্ক’ ভিসা বাতিল, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা-সহ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত বদলা নিতে পাক সেনার ছাউনিগুলিকে নিশানা করা হবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়।