ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমারে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজের জন্য ‘অপারেশন ব্রহ্মা’ চালানোর সময়ে বহু বার ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের মুখে পড়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। কিন্তু, মাঝ-আকাশের হ্যাকারদের গোলকধাঁধা থামিয়ে রাখতে পারেনি তাদের।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
‘জিপিএস স্পুফিং’কে থোড়াই কেয়ার! সাইবার আক্রমণ সামলে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দেশে দিব্যি বিমান নিয়ে চড়ে বেড়ালেন ভারতীয় বায়ুবীরেরা। শুধু তা-ই নয়, হ্যাকারদের বোকা বানানো যে তাঁদের বাঁ হাতের খেল, তা ফলাও করে জাহির করেছে দেশের বায়ুসেনা। এই ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
০২১৯
চলতি বছরের ২৮ মার্চ ভূমিকম্পে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাবেক বর্মা মুলুক তথা মায়ানমার। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পূর্বের প্রতিবেশী দেশটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এর পর কালবিলম্ব না করে সেখানে উদ্ধারকাজে নামে ভারতীয় ফৌজ, যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন ব্রহ্মা’।
০৩১৯
মায়ানমারের উদ্ধারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ভারতীয় বায়ুসেনা। ত্রাণসামগ্রী থেকে শুরু করে শুকনো খাবার, ওষুধ বা বিশুদ্ধ পানীয় জল— ফৌজি মালবাহী বিমানের সাহায্যে এ সব সাবেক বর্মা মুলুকে অহরহ সরবরাহ করে গিয়েছে তারা। আর এই কাজ করার সময়েই ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে ভারতীয় বায়ুবীরদের।
০৪১৯
‘অপারেশন ব্রহ্মা’ চলাকালীন সাইবার হামলার ঘটনার কথা স্বীকার করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। পাশাপাশি, বিমানবাহিনীর পাইলটদের সক্ষমতার ঢালাও প্রশংসাও করা হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে বায়ুসেনা। সেখানেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।
০৫১৯
সমাজমাধ্যমে করা পোস্টে বায়ুসেনা লিখেছে, ‘‘এই ধরনের সাইবার আক্রমণের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের আছে। আমরা জানি কী ভাবে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। জিপিএস স্পুফিংয়ের মধ্যেও অপারেশন চলেছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে কোনও সমস্যা হয়নি।’’
০৬১৯
উল্লেখ্য, ‘জিপিএস স্পুফিং’ থেকে বাঁচতে সাবেক বর্মা মুলুকের মান্দালয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জারি করে ‘নোটিস টু এয়ারমেন’ বা নোটাম। এটি প্রকৃতপক্ষে পাইলটদের কাছে পাঠানো এক ধরনের আগাম সতর্কবার্তা। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ভারতের বায়ুবীরেরা। এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে সে কথা উল্লেখ করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
০৭১৯
বায়ুসেনার একটি সূত্রকে উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, গত ২৯ মার্চ সি-১৩০জে সামরিক মালবাহী বিমানে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমারে ত্রাণসামগ্রীর প্রথম ব্যাচ নামানো হয়। বিমানটি ইরাবতীর কোলের আকাশসীমায় থাকাকালীন ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর কবলে পড়েছিল। সফল ভাবে অবতরণের পর তা নিয়ে রিপোর্ট করেন বায়ুসেনার পাইলট।
০৮১৯
‘অপারেশন ব্রহ্মা’ চালাতে মায়ানমারে মোট ছ’টি সামরিক পরিবহণ বিমান পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। এগুলি করেই উদ্ধারকারী দলকে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী কালে জানা যায়, ওই বিমানগুলির বেশির ভাগই ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের কবলে পড়েছিল। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপস্থিত বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে দুর্ঘটনা এড়িয়েছেন ককপিটের বায়ুসেনা অফিসারেরা।
০৯১৯
বায়ুসেনা সূত্রে খবর, ২৯ থেকে ৩০ মার্চ রাজধানী ইয়াঙ্গন এবং নে পি ডাউতে ছ’টির মধ্যে পাঁচটি বিমান অবতরণ করে। ১ এপ্রিল একটি বিমানকে মান্দালয়ে পাঠানো হয়। সি-১৩০জে ছাড়াও আমেরিকার তৈরি সি-১৭ গ্লোবমাস্টার মালবাহী বিমানও এই অপারেশনে ব্যবহার করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা।
১০১৯
এ বছরের মার্চে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের অভিযোগ ওঠে। হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে সাইবার হামলা চালায় ইহুদি ফৌজ। কিন্তু তেল আভিভের ওই নেভিগেশন হামলার প্রভাব পড়ে অসামরিক উড়ান পরিষেবাতেও। শুধু তা-ই নয়, যাত্রিবাহী বিমানের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।
১১১৯
কী এই ‘জিপিএস স্পুফিং’? একে এক রকমের হ্যাকিং বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ২০২৩ সালের অক্টোবরে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ‘গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ বা জিএনএসএসে সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। এরই পোশাকি নাম ‘জিপিএস স্পুফিং’।
১২১৯
উল্লেখ্য, ইহুদিভূমিতে নিখুঁত নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট হামলা চালাতে মূলত ‘গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম’ বা জিপিএস ব্যবহার করে হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথি বিদ্রোহীরা। সেটা ঠেকাতেই ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের ব্যবহার শুরু করে ইজ়রায়েল। এর সাহায্যে গ্লোবাল নেভিগেশনের দিক বদলের সুযোগ পেয়েছেন ইহুদিরা।
১৩১৯
‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের সাহায্যে শত্রুর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেটকে ভুল দিকে পাঠাতে সক্ষম হয় ইজ়রায়েল। কিন্তু, জিএনএসএস হ্যাকিংয়ের ফলে যাত্রিবাহী বিমানের পাইলটেরাও ভুল তথ্য পাচ্ছেন। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে উড়োজাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম। আর তাই মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা।
১৪১৯
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজ়রায়েলি ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে পশ্চিম এশিয়ায়। এর জন্য মারাত্মক ভাবে ভুগেছে ইরান এবং পাকিস্তান। ভোগান্তি হয়েছে ভারতেও। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে গত ১৫ মাসে ভারতে যাত্রিবাহী বিমানের নেভিগেশন সিস্টেমে ৪৬৫টি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
১৫১৯
সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইহুদিদের ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের প্রভাব মূলত পাক সীমান্তবর্তী অমৃতসর এবং জম্মু এলাকায় দেখা গিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ওপিএস গ্রুপ। সেখানে ‘জিপিএস স্পুফিং’-এর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকায় উত্তর-পশ্চিম নয়াদিল্লি এবং পাকিস্তানের লাহোর ও এর আশপাশের এলাকার নাম বলা হয়েছিল।
১৬১৯
গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অগস্টের মধ্যে ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের নিরিখে বিশ্বে নবম স্থানে ছিল উত্তর-পশ্চিম দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর এবং তার আশপাশের এলাকা। ওই এক মাসে সেখানকার ৩১৬টি বিমানের ওঠানামা এর জন্য ব্যাহত হয়।
১৭১৯
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, গত বছর ভারতে ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের ঘটনা ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বিষয়টি নিয়ে পাইলট থেকে শুরু করে যাত্রিবাহী বিমানের ৭০ শতাংশ ক্রু উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পূর্ব ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং এশিয়ার বিরাট এলাকা ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের হটস্পট হয়ে উঠেছে বলে জানা গিয়েছে।
১৮১৯
গত বছরের অগস্টে ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের জন্য বিশ্ব জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজারের বেশি বিমান পরিষেবা। পাইলটদের অভিযোগ, ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করার পর থেকেই নেভিগেশনে ভুল তথ্য আসতে শুরু করে। তুরস্কের আকাশসীমায় না পৌঁছনো পর্যন্ত সেটি চলতে থাকে।
১৯১৯
তবে ইজ়রায়েলি ‘জিপিএস স্পুফিং’য়ের জন্য মায়ানমারে বায়ুসেনার পাইলটদের চ্যালেঞ্জদের মুখে পড়তে হয়েছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে হ্যাকিং এড়ানোর কৌশল এতে তাঁরা আয়ত্ত করতে পেরেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক বর্মা মুলুকের এই অভিজ্ঞতা যুদ্ধের রং বদলাতে ভারতীয় বায়ুবীরদের যে অনেকটাই সাহায্য করবে, তা বলাই বাহুল্য।