দাউদ ডাকতেন ‘মাসি’, মুম্বই হামলার পর দেশের প্রথম মাফিয়া কুইনের সঙ্গে সম্পর্ক বদলায় ডনের

দেশভাগের সময় ভারত থেকে বহু মানুষ পাকিস্তানে চলে গেলেন। পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য জেনেবাইকে জোর করেছিলেন তাঁর স্বামী। কিন্তু সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন জেনেবাই। অগত্যা তাঁর স্বামী একাই পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। ৫ সন্তানকে নিয়ে ডোঙরিতে থেকে গিয়েছিলেন জেনেবাই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই জেনেবাইয়ের মাফিয়া কুইন হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়। সেই সময় মুম্বইতে রেশনের ঘাটতি ছিল। সস্তায় গরিবদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করেছিল মহারাষ্ট্র সরকার। আর সেই সময়ই কালোবাজারির ব্যবসায় হাত পাকাতে শুরু করেন জেনেবাই।

সেই সময় চালের ব্যবসা শুরু করেছিলেন জেনেবাই। কিন্তু দেখলেন, অনেকেই চালের ব্যবসা করছেন। তাই শুরু করলেন চোরাচালানের কারবার। চালের ব্যবসা না চলায় চোরাচালানের দিকে ঝোঁকেন জেনেবাই।

চালের চোরাকারবারের সময়ই কয়েক জন মদ বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল জেনেবাইয়ের। বুঝলেন যে, মদ ব্যবসায় টাকা রয়েছে। মদ বানানোয় হাত পাকালেন। তার পরই ডোঙরিতে নিজেই মদের ব্যবসা শুরু করলেন। সেই থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল ‘দারুওয়ালা’ শব্দ। হয়ে গেলেন জেনেবাই দারুওয়ালা।

চোরাচালানের কারবার, মদ ব্যবসা— এই ভাবেই মুম্বইয়ে নিজেকে ক্ষমতাবান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন জেনেবাই। রোজগার করতে শুরু করলেন প্রচুর টাকা।

ষাটের দশকে ভেজাল মদ বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল জেনেবাইকে। কিন্তু জেনেবাইয়ের যা প্রতাপ ছিল সেই সময়, পুলিশকেও পিছু হটতে হয়েছিল। গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জেনেবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। তার পর থেকে পুলিশের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে জেনেবাইয়ের।

সত্তরের দশকে মুম্বইয়ে অনেক ডনের প্রতাপ বাড়তে শুরু করেছিল। যাঁদের মধ্যে ছিলেন হাজি মস্তান, দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিল। সকলেই জেনেবাইকে মাসি বলে ডাকতেন। নিজেদের ব্যবসা এবং কারবার নিয়ে দাউদ-সহ বাকি ডনরা জেনেবাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন।

সেই সময় সমস্ত দাগী অপরাধীরা জেনেবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শুধু তাই নয়, জেনেবাইয়ের আদেশ ছিল তাঁদের কাছে শিরোধার্য। জেনেবাইকে খুবই মান্যিগণ্যি করে চলতেন সেই অপরাধীরা। আর এই ভাবেই মাফিয়া কুইন হিসাবে নিজের জায়গা পাকা করে নেন জেনেবাই। হাজি মস্তান যখন বিপদে পড়তেন, ছুটে যেতেন জেনেবাইয়ের কাছে।

সাংবাদিক জাইদি আরও একটি বই লিখেছিলেন। তার নাম ‘ডোঙরি সে দুবাই তক’। ওই বইতে দাউদের সঙ্গে জেনেবাইয়ের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা তুলে ধরেছেন জাইদি।

দাউদের বাবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল জেনেবাইয়ের। সেই সূত্রে দাউদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল জেনেবাইয়ের। আর জেনেবাইকে মাসি বলে ডাকতেন দাউদ।

অপরাধ দুনিয়ায় যখন পা রাখেন দাউদ, সেই সময় জেনেবাইয়ের কাছে কাছে থাকতেন তিনি। দেশে জরুরি অবস্থার পর দেশের রাজনীতিতে বদল ঘটতে শুরু করেছিলেন। অনেক ডনের আবির্ভাব ঘটেছিল সেই সময়। ডনেদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও ঘটত। গোটা পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন জেনেবাই।

অপরাধ জগতে পা রেখেছিলেন জেনেবাইয়ের বড় ছেলেও। নিজস্ব পরিচিতি তৈরির চেষ্টায় ছিলেন তিনি। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। সন্তান হারানোর শোকে স্বভাবতই ভেঙে পড়েছিলেন জেনেবাই। কিন্তু সেই অপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, উপরওয়ালা তাঁদের শাস্তি দেবেন।

ছেলে মারা যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিজেকে যেন গুটিয়ে নিয়েছিলেন জেনেবাই। ধর্মের প্রতি ঝুঁকেছিলেন তিনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কাজ শুরু করেছিলেন। যেখানেই সাম্প্রদায়িক অশান্তি হত, সেখানে ছুটে যেতেন জেনেবাই।

ধীরে ধীরে মুম্বইয়ে বেআইনি কারবারের ধারা বদলাতে থাকল। মাদক কারবারের রমরমা শুরু হল। এ সব থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন জেনেবাই। পাশাপাশি তাঁর দাপটও ক্রমশ কমছিল। শোনা যায়, এর পরই নাকি জেনেবাইয়ের থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন দাউদ, হাজি মস্তানরা।

সাল ১৯৯৩। মুম্বইয়ে ঘটে গেল বিস্ফোরণ। এই ঘটনায় ভেঙে পড়েছিলেন জেনেবাই। শোনা গিয়েছিল যে, এই নিয়ে তাঁর অনুতাপ ছিল। বলেছিলেন, তাঁর যদি সেই ‘নেটওয়ার্ক’ থাকত, তা হলে হামলার কথা আগাম জানলে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করতেন। এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল জেনেবাইকে। দাউদের উপর অসন্তুষ্টও হয়েছিলেন।

দীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যু হয়েছিল জেনেবাইয়ের। কবে কোথায় তাঁর মৃত্যু হয়, জানা যায়নি। তবে তাঁর মৃত্যু হলেও এখনও জ্যান্ত রয়েছে এক জন সাধারণ নারীর মাফিয়া কুইন হওয়ার কাহিনি।