এ বার কী ‘নক্ষত্র যুদ্ধ’-র সূচনা করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন? সেই লক্ষ্যে মহাকাশে পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েন করতে পারেন তিনি। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ১২:০০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
আর ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা নয়। ট্যাঙ্ক-কামান-বন্দুকের প্রথাগত লড়াই অতীত। এ বার রাশিয়ার হাত ধরে ‘নক্ষত্র যুদ্ধ’র (স্টার ওয়ার) ধ্বংসলীলা দেখবে বিশ্ব। সেই লক্ষ্যে মহাশূন্যে না কি পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েনও করে ফেলেছে মস্কো। তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই এই খবর ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে পশ্চিম ইউরোপ। অন্য দিকে এই ইস্যুতে ক্রেমলিন মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় ঘনীভূত হয়েছে রহস্য।
০২১৯
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অতি গোপনে তিনটি ফৌজি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর নিম্ন কক্ষে পাঠান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পশ্চিমি দুনিয়ার দাবি, সেগুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি রহস্যময় বস্তু। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই সন্দেহ দানা বাঁধে। তবে কি ক্ষেপণাস্ত্র বা পারমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য মহাকাশে বিশেষ মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে মস্কো?
০৩১৯
ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে জায়গা পাওয়া মস্কোর তিনটি ফৌজি উপগ্রহের নাম হল, কসমস ২৫৮১, ২৫৮২ এবং ২৫৮৩। উত্তর রাশিয়ার পুলেৎস্কো কসমোড্রোম থেকে সেগুলির সফল উৎক্ষেপণ করে ক্রেমলিন। স্পেস ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি নতুন বস্তুকে চিহ্নিত করে মার্কিন মহাকাশ বাহিনী (ইউনাইটেড স্টেটস স্পেস ফোর্স বা ইউএসএসএফ)। এর পরই বিষয়টি নিয়ে তীব্র হয় জল্পনা।
০৪১৯
ইউএসএসএফের পদস্থ আধিকারিকদের দাবি, গত ১৮ মার্চ রুশ ফৌজি উপগ্রহ কসমস ২৫৮৩ থেকে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বর্তমানে রহস্যময় সেই বস্তুটিই পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে তার উদ্দেশ্য কী, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আর তাই এ ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছেন তাঁরা।
০৫১৯
মার্কিন অফিসারদের অনুমান, মহাশূন্যে কোনও সামরিক পরীক্ষার জন্য ওই বস্তুটিকে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে পাঠিয়েছে রাশিয়া। সেটা নতুন প্রযুক্তির অত্যাধুনিক কোনও হাতিয়ারের নিশানা পরীক্ষা হতে পারে। আবার ফ্লাইং অ্যান্ড ডকিং প্রযুক্তির (মহাশূন্যে দুরন্ত গতিতে ঘোরার সময়ে দু’টি বস্তুর সংযুক্তিকরণ এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া) জন্যেও রহস্যময় বস্তুটিকে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে ক্রেমলিনের।
০৬১৯
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের একাংশ আবার মনে করেন, অনিচ্ছাকৃত কোনও কারণে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছে রুশ ফৌজি উপগ্রহ কসমস ২৫৮৩। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন স্পেস ফোর্সের অফিসারেরা। এই ধরনের ঘটনায় উপগ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশটি অচিরেই একাধিক ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। কসমস ২৫৮৩-র ক্ষেত্রে সেটা হল না কেন?
০৭১৯
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কসমস ২৫৫৩ উপগ্রহটিকে সয়ূজ-২ রকেটের সাহায্যে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে সফল ভাবে স্থাপন করেন রুশ জ্যোতিবির্জ্ঞানীদের দল। এই মিশন সাফল্য পেতে না পেতেই ইউক্রেন আক্রমণের ডিক্রিতে সই করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ফলে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে শুরু হয়ে যায় মস্কোর ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন)। তিন বছর পেরিয়ে সেই অভিযান এখনও চলছে।
০৮১৯
গত বছরের ডিসেম্বরে কসমস ২৫৫৩-কে নিয়ে প্রথম বার সন্দেহ প্রকাশ করে আমেরিকার সেনাবাহিনীর স্পেস কমান্ড। রুশ মহাকাশ অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ওই উপগ্রহটিকে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করে বসেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, এর পর থেকে এক মূহূর্তের জন্যেও কসমস ২৫৫৩-কে চোখের আড়াল করেননি তাঁরা। চলতে থাকে মস্কোর ফৌজি উপগ্রহগুলির উপর কড়া নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ।
০৯১৯
পরবর্তী পর্যায়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একসঙ্গে তিনটি সামরিক উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠায় ক্রেমলিন। এতে আমেরিকার মনে বাড়তে থাকে সন্দেহ। ফলে কালবিলম্ব না করে কসমস ২৫৮১, ২৫৮২ এবং ২৫৮৩-র উপরেও কড়া নজরদারি চালাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেস কমান্ড। এই কাজে স্পেস ট্র্যাকারদের (মহাশূন্যের বস্তু চিহ্নিতকরণের কাজে লিপ্ত) সাহায্য নেয় তারা।
১০১৯
স্পেস ডটকম জানিয়েছে, লাগাতার নজরদারির ফলে এ ব্যাপারে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় মার্কিন স্পেস কমান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বর্তমানে পৃথিবীর মেরু কক্ষপথে অবস্থান করছে ওই তিনটি রুশ সামরিক উপগ্রহ। ‘নীল গ্রহ’ থেকে তাদের দূরত্ব প্রায় ৫৮৬ কিলোমিটার।
১১১৯
এ বছরের মার্চের শেষে এসে মার্কিন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং স্পেস ট্র্যাকার জোনাথন ম্যাকডোয়েল জানান, রুশ কৃত্রিম উপগ্রহের ডিভাইসগুলির মহাশূন্যে ঘোরাঘুরির ধরন দেখে মনে হচ্ছে সেগুলিকে ‘প্রক্সিমিটি অপারেশন’-এর জন্য ব্যবহার করছে ক্রেমলিন। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে দুই বা তার বেশি মহাকাশযানকে একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। এতে ডকিং করতে সুবিধা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।
১২১৯
তবে এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নন ম্যাকডোয়েন। তাঁর কথায়, ‘‘পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয় হতে পারে। কারণ, দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহ কাছাকাছি এলেই যে ডকিং করা হবে, তা তো আর নয়। হয়তো রাশিয়ার অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। মস্কোর ফৌজি উপগ্রহগুলি কাউকে নিশানা করছে, এমন প্রমাণ আমরা পাইনি।’’
১৩১৯
মার্কিন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর ওই মন্তব্যের পরও সন্দেহ যে দূর হয়েছে এমনটা নয়। কারণ গত বছর থেকেই আমেরিকার স্পেস কমান্ডের সেনাকর্তারা বলে আসছেন, মহাশূন্যে পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়ার। মস্কো সত্যি সত্যিই সেই পদক্ষেপ করলে মহাকাশের অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর দেশগুলি যে নেমে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
১৪১৯
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সূত্রে খবর, মহাকাশে পরমাণু বোমা রাখলেও তা নিয়ে পৃথিবীর উপরের কোনও শহরকে নিশানা করবেন না প্রেসিডেন্ট পুতিন। মূলত শত্রু দেশগুলির কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশ স্পেশন উড়িয়ে দিতে সেটি ব্যবহার করতে পারেন তিনি।
১৫১৯
উল্লেখ্য, মস্কোর হাতে রয়েছে উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র। আমেরিকার সেনাকর্তাদের অনুমান, তার সাহায্যে মহাশূন্যে পরমাণু বোমা নিয়ে যাবে রাশিয়া। তার পর সুযোগ বুঝে শত্রু দেশগুলির অন্তরীক্ষ সম্পদগুলির কাছাকাছি কোনও জায়গায় সেটির বিস্ফোরণ ঘটাবে ক্রেমলিন। এতে যে তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি তৈরি হবে, তা দিয়েই সেগুলিকে পুড়িয়ে ছাই করবে ক্রেমলিন।
১৬১৯
২০২২ সালে মহাশূন্যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সাহসী পরীক্ষা চালায় মস্কো। ওই বছর কেএইচ-১১ নামের একটি মার্কিন গুপ্তচর উপগ্রহের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায় দু’টি রুশ কসমস শ্রেণির উপগ্রহ। ঠিক একই সময়ে তৃতীয় একটি উপগ্রহ থেকে উচ্চ গতির একটি গোলা নিক্ষেপ করেন ক্রেমলিন। এতে ১০০ শতাংশ সাফল্য মিলেছে বলে পরবর্তীকালে কালে বিবৃতি দিয়ে দাবি করে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
১৭১৯
মহাকাশে বিপজ্জনক পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে গত বছর রাষ্ট্রপুঞ্জে একটি প্রস্তাব আনা হয়। সেখানে বিশ্বের সমস্ত দেশকে এর থেকে বিরত থাকাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবটিতে পত্রপাঠ ভিটো দেয় রাশিয়া। বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক পরমাণু হাতিয়ার রয়েছে মস্কোর অস্ত্রাগারে। এর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বলে জানা গিয়েছে।
১৮১৯
১৯৬৭ সালে পরমাণু এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী হাতিয়ার নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়। ওই সময়ে আমেরিকার ও রাশিয়ার মধ্যে পুরোদমে চলছিল ঠান্ডা লড়াই। তা সত্ত্বেও দু’টি দেশ এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী মহাকাশে এই ধরনের অস্ত্র মোতায়েন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মস্কো এই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে গেলে সেটি মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
১৯১৯
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্য জানিয়েছেন, মহাকাশে পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েনের কোনও ইচ্ছাই তার নেই। কিন্তু, গত বছর রাষ্ট্রপুঞ্জে আসা এই সংক্রান্ত প্রস্তাবে মস্কো না বলায়, ক্রেমলিনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এর উত্তর হয়তো দেবে সময়।