১৯২৩ সালের মার্চ মাসের পয়লা তারিখ। ক্ষিতিমোহন সেনকে সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাশী পৌঁছন। ওঠেন ফণিভূষণ অধিকারীর বাড়িতে। সে দিনই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সমাবেশে এক ইংরেজি ভাষণে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য আলোচনা করেন। সে বার কাশীতেই বসেছিল ‘উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন’-এর প্রথম অধিবেশন। প্রমথনাথ তর্কভূষণের অনুরোধে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, “বাংলার বাইরে বাঙালির আহ্বান যখন আমার কাছে পৌঁছল, তখন আমি সে আমন্ত্রণ নাড়ির টানে অস্বীকার করতে পারিনি।” তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ জাতিগত ঐক্যের মধ্য দিয়েই চিরকাল আপন পরিচয় ব্যক্ত করার কথা ভেবেছে। সেখানে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আছে বলেই মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধ এত উদার। তাই কবি বলেছিলেন, “বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলাভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি। ভাষা আত্মীয়তার আধার, তা মানুষের জৈব-প্রকৃতির চেয়ে অন্তরতর। আজকের দিনে মাতৃভাষার গৌরববোধ বাঙালির পক্ষে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হয়েছে; কারণ ভাষার মধ্য দিয়ে তাদের পরস্পরের পরিচয়সাধন হতে পেরেছে এবং অপরকেও তারা আপনার যথার্থ পরিচয় দানকরতে পারছে।”
সে বার প্রবাসে এই বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন ঘটা করে পালিত হয়েছিল। সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে তাঁর আশা ছিল, বাংলা সাহিত্যের পুষ্টিসাধনে উত্তর ভারতের বঙ্গভাষীরা যথেষ্ট সচেষ্ট থাকবেন। যদিও এর আগে থেকেই লখনউ, এলাহাবাদ, বেনারস, কানপুর ও কাশীর কৃতী ও শিক্ষিত বাঙালিরা নানাবিধ সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করতেন। ভাষা-সংস্কৃতির টানে কাশী শহরে বিশিষ্ট সাহিত্যসেবী মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বসতভিটেয় মাঝেমধ্যেই মিলিত হতেন। সেখানে হাজির হতেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, বিমলাচরণ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ সেন, রাধাকমল ও রাধাকুমুদ ভট্টাচার্য ভ্রাতৃদ্বয়, মহেন্দ্রচন্দ্র রায় প্রমুখ উত্তর ভারতের বাংলা ভাষার প্রবাসী সাহিত্যসেবীরা। লখনউয়ের ব্যস্ত ব্যারিস্টার গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে সে সমস্ত মজলিশের খবর যথাসময়েই পৌঁছে যেত। কর্মজীবনে ব্যস্ততার মধ্যেও অতুলপ্রসাদকে এই বিষয়টি নাড়া দেয়। তিনি অনুভব করেন, উত্তর ভারতের প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যসাধনার জন্য কোনও পত্রিকা প্রকাশ করা যেতে পারে।
সেই চিন্তা মাথায় রেখে ১৯২৫ সালের ১১-১২ এপ্রিল লখনউতে সরলা দেবী চৌধুরানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন’-এর আসরে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে অতুলপ্রসাদ একটি প্রস্তাব দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে সাহিত্য সাধনার একটা প্রবল ইচ্ছা দেখা দিয়াছে, তাহার ফলে বাঙ্গালী-বহুল কাশীনগরী হইতে কয়েকখানি মাসিকপত্র প্রকাশিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে “অলকা” অলক্ষিত, “প্রবাসজ্যোতি” নির্ব্বাপিত প্রায়। সম্প্রতি সাহিত্যপ্রেমী শ্রীসুরেশ চক্রবর্তী কাশীধাম হইতে “প্রবাসী-বাঙ্গালী” নামে একখানি পাক্ষিক পত্রিকা বাহির করিতেছেন, আমি তাঁহার সাহিত্যোৎসাহের প্রশংসা করি এবং তাঁহার সুলিখিত পত্রিকার স্থায়িত্ব কামনা করি।” এর পর প্রস্তাব পেশ করেন: “আমি কিন্তু তাঁহাকে একটি মনোরম ও সারগর্ভ মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা বিষয়ে সহায়তা করিতে অনুরোধ করিতেছি। পত্রিকাখানি সচিত্র হইবে।”
অতুলপ্রসাদ কথিত ‘প্রবাসজ্যোতি’ সাহিত্য পত্রিকাটি কাশীবাসীদের দ্বারা ১৩২৭ সনের আশ্বিন মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্পাদক ছিলেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সহ-সম্পাদনার ভার পড়ে সুরেশ চক্রবর্তীর উপর। বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও আর্থিক সহায়তায় পত্রিকার প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল। যদিও মাসিক পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল মাত্র একটি বছর অর্থাৎ বারোটি সংখ্যা। এর পরের বছর, ১৩২৮ সনের ফাল্গুনে ‘অলকা’ পত্রিকা প্রথম বেরোয়। এটির সম্পাদনা ও সহ-সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং সুরেশ চক্রবর্তী।
তৃতীয় বারের ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন’-এ অতুলপ্রসাদের পেশ করা এই প্রস্তাবনাটি সাহিত্য সম্মেলনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে বারই অধিবেশনে সম্মেলনের মুখপত্র হিসেবে এগারো সদস্যের পরিচালন সমিতি গঠন ও তার মাধ্যমে সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পত্রিকার সেই পরিচালন সমিতির সভাপতি হন লখনউবাসী অতুলপ্রসাদ সেন। সম্পাদক হিসেবে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সহ-সম্পাদক হিসেবে হীরেন্দ্রলাল দে ও সুরেশ চক্রবর্তী আর পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে অতুলপ্রসাদ সেন ও রাধাকমল মুখোপাধ্যায়কে রাখা হয়।
পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা অতুলপ্রসাদকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সঙ্গে এর আর্থিক দিক এবং গ্রাহক সংগ্রহের বিষয়টি নিয়েও নানা জনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। জানা যায়, লখনউ ছাড়াও ইন্দোর, ফৈজ়াবাদ, আজমগড়ের অনেক প্রবাসী বাঙালির থেকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস মেলে। একটি উপদেষ্টামণ্ডলীও তৈরি করা হয়। সেখানে সরলা দেবী-সহ ইতিহাসবিদ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যসেবী সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ও কাশীবাসী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং কাশী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ গোপীনাথ কবিরাজও ছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পরিচালন সমিতিকে এক হাজার টাকা-সহ পাঁচশো গ্রাহক ও নিয়মিত লিখতে পারবেন এমন কয়েক জন লেখক-প্রাবন্ধিক জোগাড় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক হয়, পত্রিকাটির প্রাথমিক ও প্রধান কার্যালয় লখনউ শহরে হলেও এর মুদ্রণ হবে এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেসের বারাণসী শাখায়। উত্তর ভারতের প্রবাসী বাঙালিদের দ্বারা প্রকাশিত এই পত্রিকার ‘উত্তরা’ নামকরণটি করেন অতুলপ্রসাদ। অবশেষে লখনউ সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যক্ষ, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অসিতকুমার হালদারের আঁকা প্রচ্ছদ ও রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী প্রকাশ করে ‘উত্তরা’ পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় ১৯২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন (১ আশ্বিন, ১৩৩২)। এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়— “এই প্রকাশের পশ্চাতে আপনাদের যে সাহায্য ও শুভ ইচ্ছা রহিয়াছে কেবল তাহাই প্রবাসী বাঙ্গালীর এই অনুষ্ঠানটিকে উদ্দেশ্য পথে অগ্রসর করিয়ে দিতে সমর্থ।” দাম ছিল প্রতি সংখ্যা চার আনা এবং বার্ষিক স-ডাক তিন টাকা চার আনা। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পত্রিকা প্রকাশ পেত। পরে অবশ্য এর মূল্য বৃদ্ধি হয়।
রবীন্দ্রনাথ ‘উত্তরা’র জন্য ‘আশীর্বাণী’ কবিতাটি লিখে পাঠিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদকে—
‘বঙ্গের দিগন্ত ছেয়ে বাণীর বাদল
বহে যায় শত স্রোতে রস-বন্যাবেগে;
কভু বজ্রবহ্নি কভু স্নিগ্ধ অশ্রুজল
ধ্বনিছে সঙ্গীতে ছন্দে তারি পুঞ্জ মেঘে;
বঙ্কিম শশাঙ্ককলা তারি ঘনঘটা
চুম্বিয়া মঙ্গলমন্ত্রে রচে স্তরে স্তরে
সুন্দরের ইন্দ্রজাল; কত রশ্মিচ্ছটা
প্রত্যুষে, দিনের অস্তে রাখে তারিপরে
আলোকের স্পর্শমণি। আজি পূর্ব্ববায়ে
বঙ্গের অম্বর হ’তে দিকে দিগন্তরে
সহর্ষ বর্ষণধারা যাক্ না ছড়ায়ে
প্রাণের আনন্দবেগে পশ্চিমে উত্তরে;
দিন্ বঙ্গ-বীণাপাণি অতুল প্রসাদ,
চিত্ত-জাগরণী গানে নিত্য আশীর্ব্বাদ!’
জানা যায়, অতুলপ্রসাদ নিজে রবীন্দ্রনাথের কাছে এই ‘আশীর্বাণী’টি চেয়েছিলেন। তবে প্রথমে ঠিক হয়েছিল, আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে পত্রিকাটি বেরোবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিচালন সমিতির অনেকেই তাড়াহুড়ো করে বার করার পক্ষপাতী ছিলেন না। ওই সময়ে ‘উত্তরা’র প্রধান আহ্বায়ক, অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশী দেবী মারা যান এবং অতুলপ্রসাদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শোকের এই সময় শিমলায় গিয়েছিলেন অবসরযাপনের জন্য। সেখান থেকে সুরেশ চক্রবর্তীকে চিঠিতে পত্রিকার কাজকর্মের বিষয়ে চিঠি লিখে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চান। তখনই প্রচ্ছদ অসিতকুমার হালদারকে দিয়ে করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
পত্রিকায় প্রথম থেকে মূলত প্রবন্ধ ছাপানোর বিষয়েই জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত সাতটি প্রবন্ধ ছিল, যথা ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন’, ‘যুক্ত প্রদেশের প্রাচীন শিক্ষা’, ‘গৌড়ীয় যোগশাস্ত্র’, ‘গুরু তেগবাহাদুরের জীবনী ও বাণী’, ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে জড় ও বিদ্যুতের সম্পর্ক’, ‘এক ও বহু’ এবং ‘মনোবিজ্ঞান’। এই প্রবন্ধাবলির লেখকরা হলেন যথাক্রমে সরলা দেবী চৌধুরানী, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, গোপীনাথ কবিরাজ, অবিনাশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, ফণিভূষণ অধিকারী এবং ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। একটিমাত্র গল্প প্রকাশিত হয়, তার লেখক মানিক ভট্টাচার্য। প্রথম সংখ্যায় স্বরলিপি-সহ অতুলপ্রসাদ সেনের লেখা গান প্রকাশিত হয়, স্বরলিপিটি লিখেছিলেন সাহানা দেবী। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র দেখে বোঝা যায়, বিজ্ঞান থেকে প্রাচীন সাহিত্য সব কিছুরই ঠাঁই ছিল সেখানে।
এ ছাড়াও প্রবাসে বাঙালিদের বিবিধ খবরাখবর, বিশেষ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি থেকে বাঙালিদের উল্লেখযোগ্য অবদানের বিষয়গুলি প্রকাশ ও প্রচারে জোর দেওয়া হয়। এই বিভাগটির শিরোনাম হল ‘প্রবাসী বাঙ্গালী’। এ ছাড়াও ‘সপ্তধারা’ বিভাগে মুদ্রিত হত উর্দু, হিন্দি, তামিল, পঞ্জাবি প্রভৃতি অবাঙালি লেখকদের রচনার বাংলা অনুবাদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংবাদও প্রকাশিত হত। গোটা বিশ্বের সঙ্গে পাঠকেরা এই বিভাগটির মাধ্যমে পরিচিত হতে পারতেন। সেই বিভাগটির নাম ‘আহরণী’। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ খোলা হয়, যার নাম ‘সংকলন’। এখানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাকে পুনর্মুদ্রণের সুযোগ দিতেন সম্পাদক। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা ‘উত্তরা’ পুনঃপ্রকাশ করে। শুধু রবীন্দ্রনাথেরই নয়, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রেরও একাধিক লেখা তাতে স্থান পেয়েছে। ‘উত্তরা’র সম্পাদকীয় দফতর ‘পুস্তক-পরিচয়’ বিভাগ খুলে বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয় ও গ্রন্থ-আলোচনা নিয়মিত প্রকাশ করতেন। আর একটি বিভাগ ছিল, নাম ‘বিবিধ’। বৈচিত্রপূর্ণ নানা ধরনের সংবাদ নিয়ে তৈরি। সে কালের কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, নরেন্দ্র দেব, মোহিতলাল মজুমদার, কালিদাস রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিষ্ণু দে, রাধারানী দেবীর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বনফুল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ সকলেই ‘উত্তরা’য় লিখতেন। সে কালে পটনা, কাশী, এলাহাবাদ, লখনউ, লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বিদ্বান বাঙালি অধ্যাপনা করতেন। তাঁদের কাছে নিয়মিত প্রবন্ধ লেখার জন্য অতুলপ্রসাদ নিজে আবেদন করেছিলেন।
এ ছাড়াও ‘উত্তরা’র বিভিন্ন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু রচনা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে অতুলপ্রসাদ সেনের লেখা ‘আমার কয়েকটি রবীন্দ্র-স্মৃতি’ প্রকাশিত হয় ‘উত্তরা’র ষষ্ঠ বর্ষ ১৩৩৮ সনের মাঘ সংখ্যায়। এটি পড়ার পর ১৩৩৮-এর ১৫ চৈত্র তারিখে অতুলপ্রসাদ সেনকে একটি চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, “উত্তরায় রবীন্দ্রনাথ নামক এক ব্যক্তির সম্বন্ধে যে কয়টি কথা লিখেছ তা পড়ে উক্ত নামধারী খুশী হয়েছেন। হবার কারণ এই যে অনেক কথা মনে পড়ে গেল।… পলাতকা দিনগুলোকে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে… শান্তির স্নিগ্ধ রসের পাত্রটা উজাড় করে দিয়ে তার মধ্যে খ্যাতির ঝাঁঝালো মদ ভরে দিয়েছে।”
‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ সংখ্যা ছাড়াও ‘উত্তরা’র বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়, এর মধ্যে কেদারনাথ স্মৃতি সংখ্যা, অতুল সংখ্যা, অবনীন্দ্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ‘উত্তরা’র দীর্ঘ একচল্লিশ বছরের যাত্রাপথের মূল কান্ডারি ছিলেন আড়ালে থাকা সাহিত্যসেবী সুরেশ চক্রবর্তী। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে নিশ্চিন্তে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। তাতেই তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়েছিল। চলতি বছরটিতে প্রবাসী বাঙালিদের সেই গৌরবময় সাহিত্যপত্রিকা ‘উত্তরা’র শতবর্ষ পূর্ণ হল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)