Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
History

শতবর্ষে অখিলবন্ধু

বহু নজরুলগীতিতেও  অখিলবন্ধু নিজস্ব ভাবমাধুর্যে ভাস্বর। এ প্রসঙ্গে তাঁর শ্যামকল্যাণ রাগে গাওয়া কাজিসাহেবের ‘রসঘন শ্যাম’ গানটি উল্লেখযোগ্য।১৯৪০-এর দশকে তখন কলকাতা টালমাটাল আন্দোলন-দুর্ভিক্ষ-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব-দাঙ্গা-দেশভাগ ইত্যাদি নানা কারণে।

অখিলবন্ধু ঘোষ

অখিলবন্ধু ঘোষ

অভীক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২৩:০৮
Share: Save:

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম, কিন্তু ঝোঁক ছিল বাংলা আধুনিক গানেই। তাঁর গায়কির বিরহ ও অভিমান ছুঁয়ে যেত শ্রোতার মন। নিজের অধিকাংশ গানে সুর দিয়েছিলেন নিজেই। করেছিলেন বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আগামী পরশু অখিলবন্ধু ঘোষের একশো বছর।

শচীন দেব বর্মণের গানে পাগল ছিলেন তিনি। বহু গুণিজনের কাছে গান শিখেছিলেন, মনে মনে শচীন দেব বর্মণকেও দিয়েছিলেন গুরুর আসন। গাইতে গেলে কখনও বাদ পড়ত না শচীনকর্তার গান। এক বার রেকর্ডে গাওয়া তাঁর নিজের একটি গান ওই শিল্পীর গলায় শুনে মুগ্ধ হলেন শচীন দেব স্বয়ং। ওই একই গান সেই গায়ককে নতুন করে রেকর্ড করার অনুমতি দিলেন তিনি। গানটি ছিল, ‘বধূ গো এই মধুমাস...’। গাইলেনও তিনি। বাংলা গানের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। মরমি শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ তাঁর গানে স্পর্শ করেছিলেন গুরুপ্রতিম শিল্পীকেও।

১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর জন্ম অখিলবন্ধু ঘোষের। এক সাক্ষাৎকারে শিল্পীর পত্নী দীপালি ঘোষ জানিয়েছিলেন, অখিলবন্ধুর আদি বাড়ি নদিয়ার রানাঘাটের কাছে হলেও আসলে তাঁরা বালির বিখ্যাত ঘোষ পরিবারের বংশধর, যে বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ঋষি অরবিন্দ। অখিলবন্ধুর বড় হওয়া চাকদার মামাবাড়িতে। মামা কালিদাস গুহ-র জন্যেই সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক। কয়েক বছর পর, কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসা। সেখান থেকেই শিল্পী অখিলবন্ধুর গড়ে ওঠার সূচনা।

প্রথম সঙ্গীতশিক্ষক মামা কালিদাস গুহ। কলকাতায় এসে তালিম পেলেন একে একে নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর মতো গুণিজনদের কাছে। সম্ভবত কিছু দিনের জন্য পণ্ডিত কে জি ঢেকনের কাছেও তালিম নিয়েছিলেন অখিলবন্ধু। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গভীর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু পরিবেশনায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর ছায়াসঙ্গীই হয়ে রইল, আলোয় প্রকাশ পেল না। নিজস্ব ধরনের আধুনিক বাংলা গানে তিনি হয়ে উঠলেন অনন্য।

১৯৪০-এর দশকে তখন কলকাতা টালমাটাল আন্দোলন-দুর্ভিক্ষ-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব-দাঙ্গা-দেশভাগ ইত্যাদি নানা কারণে। অন্য দিকে বাংলা গানের জগতে প্রতিভার ছড়াছড়ি। ১৯৪৪-৪৫ সাল থেকে কলকাতা বেতারে গান গাওয়ার মাধ্যমে শুরু হল অখিলবন্ধু ঘোষের যাত্রা। ১৯৪৭ সালে প্রথম রেকর্ড। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানদু’টি ছিল— ‘একটি কুসুম যবে’ এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’। প্রথমটির গীতিকার অখিলবন্ধু নিজেই, দ্বিতীয়টি ব্যোমকেশ লাহিড়ীর লেখা। এর পর কয়েকটি রেকর্ড পেরিয়ে ছ’নম্বর রেকর্ডে (১৯৫৩) ঝলসে উঠলেন অখিলবন্ধু। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গাইলেন, ‘মায়ামৃগ সম’ এবং ‘কেন প্রহর না যেতে’। সুরকার যথাক্রমে দুর্গা সেন ও দিলীপ সরকার। প্রথম গানটি যে শুদ্ধ ও কোমল ধৈবত-এর এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে শুরু হয়, তা অখিলবন্ধুর কণ্ঠে অপূর্ব মায়া তৈরি করে। কী অনায়াস গায়ন-ভঙ্গি! অথচ অসম্ভব জটিল পথে সুরের চলন, আবার বাণীর মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ। এই রেকর্ড থেকেই প্রতিভার জাত চেনালেন শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ।

‘শিপ্রা নদীর তীরে’, ‘কবে আছি কবে নেই’, ‘এমনি দিনে মা যে আমার’, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়’... প্রতিটি জনপ্রিয় গানই তাঁর নিজের সুর করা। ‘তোমার ভুবনে...’ গানটি মাঝ-খাম্বাজ রাগিণী নির্ভর। গানের মাঝে টুকরো তানকারিও করেছিলেন, কিন্তু সমস্ত কসরত ছাপিয়ে শ্রোতাকে ছুঁয়ে গেছে বিরহী মনের হাহাকার। খানদানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যিনি শিক্ষিত, ঠুংরি, কাজরী বা চৈতি-র সূক্ষ্ম কাজ যাঁর গলায় অনায়াস, সেই তিনি কয়েকটি গানের সুরনির্মাণ ও গায়কিতে এমন এক অভিনবত্ব এনেছিলেনন, যা তাঁর আধুনিকমনস্কতা ও নিজস্বতার পরিচায়ক। যেমন— ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে ওঠে’, ‘ওই যে আকাশের গায়’, ‘যেন কিছু মনে কোরো না’ (সুর: সহধর্মিণী দীপালি ঘোষ), ‘ঐ যাঃ! আমি বলতে ভুলে গেছি’ ইত্যাদি গান অদ্ভুত সংলাপধর্মী কাটা কাটা ভঙ্গিতে গেয়েছেন অখিলবন্ধু। শেষের গানটিতে শচীন দেব বর্মণের প্রভাব কানে বাজে। গানের শুরুতে সুরহীন ভাবে ‘ঐ যাঃ’ কথাটা বলে গানটি শুরু হয়, ঠিক যেমন শচীনকর্তা ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ গানটা গাইবার আগে ‘আঃ’ কথাটা বলে উঠতেন। লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে অখিলবন্ধুর গাওয়া ‘কোয়েলিয়া জানে’ গানটিও শচীন দেব বর্মণকে মনে করায়।

সাঙ্গীতিক এক্সপ্রেশনের অন্যতম জাদুকর ছিলেন শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ। তাঁর জনপ্রিয়তম ‘ও দয়াল বিচার করো’ গানের পাশাপাশি ‘ও বাঁশুরিয়া বাঁশি বাজাইয়ো না’ শুনলে বোঝা যায়, দু’টি গানে প্রেমের ভিন্ন আবেদন অনুযায়ী কী অসাধারণ দক্ষতায় তাঁর গায়কিতে নাটকীয়তার তফাত এনেছেন শিল্পী। প্রথম গানে ‘দয়াল’-এর কাছে বিচারের আর্জি। কারণ, ‘আমায় গুণ করেছে, খুন করেছে ও বাঁশি’। আর দ্বিতীয় গানটিতে বাঁশিকে থামতে বলার প্রাণপণ আর্তি। কারণ, ‘আমি অনেক করে ছিলেম তারে ভুলে, তুমি নতুন করে জাগায়ো না’। বিরহী মনের আকুতিকে জটিল সুরে সাবলীল ভাবে প্রকাশ করার অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর।

বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রও ছিলেন তিনি। ‘আজি চাঁদিনি রাতি গো’ (কেদার), ‘জাগো জাগো প্রিয়’ (ভাটিয়ার), ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’ (সুরদাসী মল্লার), ‘আমার সহেলী ঘুমায়’ (মারু বেহাগ)— এ রকম আরও অনেক রাগপ্রধান গান অপরূপ হয়েছে শিল্পীর কণ্ঠে। রাগরাগিণীর প্রকাশ যে কতখানি ভাবের পথে হতে পারে, অখিলবন্ধুর গাওয়া রাগপ্রধান গান তার অন্যতম দৃষ্টান্ত! বেশ কিছু নজরুলগীতিতেও তিনি নিজস্ব ভাবমাধুর্যে ভাস্বর, এ প্রসঙ্গে তাঁর গাওয়া শ্যামকল্যাণ রাগে কাজিসাহেবের ‘রসঘন শ্যাম’ গানটির উল্লেখই যথেষ্ট। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশ্নাতীত দক্ষতা থাকলেও, রেকর্ডে খেয়াল-ঠুংরি বা গীত-ভজন তেমন শোনা যায়নি তাঁর কণ্ঠে। তবে বেতারে গেয়েছিলেন। যেমন, ১৯৪৯ সালে বেতারে সম্প্রচারিত অখিলবন্ধু ঘোষের গাওয়া দু’টি অসাধারণ ভজন— ‘ফরিয়াদ মেরি সুনলে ও ভগওয়ান’ (কথা: মুন্সি জাকির হোসেন, সুর: দুর্গা সেন) এবং ‘তুম মুরলী শ্যাম বাজাও’ (কথা: সুরদাস, সুর: অখিলবন্ধু ঘোষ)।

নিজের বেশির ভাগ গানে বৈচিত্রময় সুরারোপ করলেও, অন্যের কণ্ঠে অখিলবন্ধুর সুর দেওয়া গান পাওয়া যায় মাত্র দু’টি রেকর্ডে। একটি রেকর্ডে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় দু’টি গান, ‘যমুনা কিনারে’ ও ‘মনে নেই মন’ এবং আর একটি লং প্লেয়িং রেকর্ডের সঙ্কলনে কয়েকটি গানের মধ্যে একটি ভজন ‘গুরু মোহে দে গ্যয়ে’ (গীতিকার: কবীর দাস) অখিলবন্ধু ঘোষের সুরে গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ছায়াছবির জগতেও সুরকার হিসেবে কাজ করেননি তিনি। শুধুমাত্র ‘শ্রীতুলসীদাস’ (১৯৫০), ‘মেঘমুক্তি’ (১৯৫২) ও ‘বৃন্দাবনলীলা’ (১৯৫৮) ছবিতে অখিলবন্ধু ঘোষের নেপথ্য কণ্ঠ শোনা গেছে, যে ছবিগুলির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে অনুপম ঘটক, উমাপতি শীল ও রথীন ঘোষ।

চিরকাল ছিলেন প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন। তাঁর স্ত্রী দীপালি ঘোষ ছিলেন শিল্পী অখিলবন্ধুর প্রকৃত সুরসঙ্গিনীও। কিছু গান তাঁর স্ত্রীর সুরেও গেয়েছেন শিল্পী। সব সময় চোখ বন্ধ করে গান গাইতেন। ধ্যানমগ্ন সাধকের মতো। অখিলবন্ধু ঘোষ মারা গিয়েছিলেন ১৯৮৮ সালের ২০ মার্চ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর মতো বিশিষ্টরাও বলেছেন, তাঁর প্রাপ্য মর্যাদার সবটুকু তিনি পাননি। সে কারণেই হয়তো তাঁর ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম/ এই মায়াভরা পৃথিবীতে/ পেয়েছি যতই, তারও বেশি করে/ হয়তো হয়েছে দিতে’ গানটিতে এক অভিমানী শিল্পীর বেদনা এমন গভীর হয়ে ফুটে উঠেছে। জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এ কথাই মনে হচ্ছে বার বার।

কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History অখিলবন্ধু ঘোষ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE