গাড়িটা পার্ক করে বাইরে আসতেই রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া শেষ এপ্রিলের দিন। সালটা ২০০৪ বা ২০০৫। মাথার ওপর নির্মেঘ অবিশ্বাস্য একটা নীল ঝকঝকে আকাশ। সামনে বারান্দায় ঝলমল করছে হলুদ ফুল। সান হোসে-র শহরতলিতে বৈশিষ্ট্যহীন একটা সাদা রঙের বাড়ি। চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকেই বাঁ দিকে একটা কেজো অফিসঘর। তিনটে কম্পিউটারের সামনে কাজ করছে তিন জন। এক জন ফোনে অসম্ভব নিচু স্বরে কথা বলছে, ডান হাত চলছে দ্রুত, লিখে নিচ্ছে জরুরি তথ্য। বাইরে ভেসে যাওয়া আলোর দিন; কিন্তু ঘরের জানলার সমস্ত ব্লাইন্ড টেনে দেওয়া হয়েছে, সব কিছু নিশ্ছিদ্র ভাবে বন্ধ। কিন্তু ঘর কৃত্রিম আলোয় ঝকঝক করছে।
লিভিংরুমে টিভিতে চলছে একটা ভিয়েতনামের সিরিয়াল। টিভির সামনে পুরনো বাদামি সোফার এক কোনায় বসে আছেন এক মহিলা, পা গুটিয়ে। মুখটা টিভির দিকে ঘোরানো, আমার পায়ের আওয়াজে এক বার ফিরে তাকানওনি। তাকালে আমি কী দেখতাম, জানি। দুটো চোখ, অভিব্যক্তিহীন, কৌতূহলহীন। সম্পূর্ণ শূন্য। আসলে কিছুই দেখছেন না উনি।
কোনও কোনও দিন এই বাড়িটাও জেগে ওঠে, গমগম করে কার্টুন নেটওয়ার্কের আওয়াজে, বেডরুম থেকে ভেসে আসা বাচ্চার হাসির শব্দে। জেগে ওঠে এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে থাকা খেলনা-গাড়িতে, চোখ উলটে পড়ে থাকা বার্বিতে, আধখোলা ড্রয়ার থেকে উঁকিমারা সবুজ মোজায়।
বাড়িটার ছবি বদলে যায়, এখানে স্রোতের মতো আসা মেয়েদের মতোই। যারা আসে এই স্টেট থেকে, ওই স্টেট থেকে, অনেক অনেক রাস্তা পার হয়ে অন্য কোনও স্টেট থেকে। কেউ থাকে কয়েক দিন, বোঝার আগেই চলে যায় নতুন কোনও ঠিকানায়। কেউ থাকে কয়েক মাস। এই বাড়িটা একটা ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স শেল্টার’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্ট মেয়েরা, যারা আর স্বামীর মার সহ্য করতে পারছে না, যাদের কাছে সংসার হয়ে উঠেছে একটা ভয়াবহ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, তারা পালিয়ে আসে এখানে। তার আগে অবশ্য বার বার, অসংখ্য বার, নিজের কাছে তারা অস্বীকার করে যে এ রকম কিছু তার বেলায় ঘটছে। তার পর ভাবে, এক দিন নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে লুকোয়, কালশিটে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলে বলে, পড়ে গেছি। শেষে, আর না পেরে, পালিয়ে আসে। আমাদের কর্মীরা অনেকগুলো ভাষাতে স্বচ্ছন্দ, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে এই মেয়েরা বেঁচে যায়। কারণ এদের একটা বিরাট সমস্যা: এই দেশটার ভাষায় তারা ভাল করে কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারে না।
অবশ্য বুঝিয়ে বলার খুব কিছু যে থাকে, তা নয়। আমাদের প্রায় মুখস্থ। লুকনো লাল চোখ, কালশিটে পড়া মুখ, নার্ভাস ব্রেকডাউন। তার পর এক দিন ভাঙা পাঁজরা, রক্তাক্ত মুখ নিয়ে, হাসপাতাল, পুলিশ। আর তার পর হাজার মাইল কাঁটাতার পেরিয়ে এ রকম একটা শেল্টারে পৌঁছনো, যেখানে আমি কাজ করতাম শেল্টার ম্যানেজার হিসাবে।
এক দিন সকালে শেল্টারে পৌঁছে দেখি হাওয়ায় থমথমে ভাব। কিচেনের কাছে একসঙ্গে তিন জন কথা বলছে নিচু গলায়। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই একটি মেয়ে এক নিশ্বাসে বলে উঠল, ‘কাল রাত্রে এসে পৌঁছেছে, ইমার্জেন্সি থেকে, নাম ক্যামেলিয়া, বিবাহিত, বয়স আঠাশ, কন্ডিশন ভাল নয়।’ আমি নামে এখানকার ম্যানেজার অথচ এ রকম দিনগুলোতে এখনও অভ্যস্ত হতে পারিনি। শুনলেই বুক ধড়াস ধড়াস করে, পেটে কেমন যেন একটা খালি-খালি ভাব...
হলওয়ে-র শেষ ঘরটায়, ব্লাইন্ডের আড়াল থেকে আসা অল্প আলোয় দেখতে পেলাম মেয়েটাকে। বিছানায় শোওয়া, মুখটা দেওয়ালের দিকে ফেরানো, গলা পর্যন্ত ঢাকা একটা কম্ফর্টারে। একটা হাত বেরিয়ে বাইরে, কবজিতে একটা প্লাস্টার। অ্যান্টিসেপটিকের তীব্র গন্ধ এসে ধাক্কা মারছে নাকে। দেওয়ালের পাশে একটা চেয়ারে বসে ওর কেস ম্যানেজার।
কিচেনে আসতেই, আমার এক সিনিয়র কলিগ, অ্যান, নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। পোলারয়েডে তোলা কয়েকটা ছবি। প্রথম ছবিটার দিকে তাকাতেই সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। ছবিটা মানুষের শরীরের একটা অংশ, কিন্তু হাত না পা বোঝা শক্ত। যা দেখা যাচ্ছে তা হল শুধু ক্ষতচিহ্ন। না, কেটে যাওয়ার দাগ নয়, কোনও ভোঁতা জিনিস দিয়ে একটানা মারলে, চামড়ার ওপরের স্তর ফেটে যখন রক্ত বেরিয়ে আসে, তার পর জমাট বেঁধে যায়, তেমন দাগ অজস্র— লাল, কালো, নীল, আর তার মাঝামাঝি অনেক অনেক শেড-এর। এই বাড়ির বাইরেও রং, লাল, বেগুনি, হলুদ ফুলে ঝলমল করছে আমেরিকার মাঝদুপুর, যা কিনা ফোটোশপকেও লজ্জা দিতে পারে। আর আমি ভাবছি কত জোরে, কতটা জোরে, কত ক্ষণ ধরে মারলে, মেরে চললে, এ রকম হতে পারে।
পরের মুহূর্তেই ভাবলাম, ভাগ্যিস ভাগ্যিস, ওর মুখটা অন্য দিকে ঘোরানো ছিল, সামনে দেখতে হয়নি। তার পরেই সপাট ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ল রাগ, নিজের ওপর। আমি? আমি সহ্য করতে পারছি না? জাস্ট ছবি দেখে? আর ওই আটাশ বছরের মেয়েটা? কত দিন ধরে, কত দিন ধরে ?
‘বাচ্চা আছে ওর?’
‘হ্যাঁ, ওদেরকেও আড়াল করছিল হয়তো। কেন যে restraining order নেয়নি মেয়েটা? কী ভেবেছিল? কেন যে আমরা এতো স্টুপিড!’
কখন যেন ক্যামেলিয়া ‘আমরা’ হয়ে গেছে অ্যানের কাছে।
রাগী অ্যান, স্পষ্টবক্তা অ্যান, ক্লায়েন্টদের জন্য প্রাণপাত করা অ্যান, সিলিকন ভ্যালির কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রিজ এর গড় আয়ের আণুবীক্ষণিক অংশ রোজগার করা অ্যান। ফিলিপিন্সের মানুষ, যে দীর্ঘ দিন সহ্য করার পর চার সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল এক অত্যাচারের সম্পর্ক থেকে, একা হাতে প্রচণ্ড কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছে এই সুদূর বিদেশে। অভিজ্ঞতায়, কর্মদক্ষতায় অনায়াসে শুরু করতে পারত নিজের চাকরি বা ব্যবসা, কিন্তু সমস্ত প্রাণশক্তি ঢেলে দিয়েছে আমাদের এই সংস্থায়।
এই বাড়ির পৃথিবীতে পা দেওয়ার প্রথম শর্তই হল গোপনীয়তা। হাজার বাধা পেরিয়ে, প্রচুর বিপত্তির মধ্যে দিয়ে এখানে যখন পৌঁছয় এই মহিলারা, বাচ্চারা, কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমরা মন্ত্রের মত তাদের বলি, ‘কাউকে এই বাড়ির লোকেশনের কথা নয়; কাউকে না, কোনও অবস্থাতেই নয়, কোনও কারণেই নয়। আমাদের কাছ থেকে পাওয়া ফোন, শুধু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য।’
সেই সময় ক্লান্ত চোখগুলোতে ফুটে ওঠে একটা কাঁচা ভয়, কিন্তু বার বার বলে যেতে হয়, কারণ একটা সামান্য ভুলেই তারা জানিয়ে ফেলতে পারে নিজেদের হদিস। আর তাদের তাড়া করে খুঁজে বের করতে পারে তাদের পুরুষ-সঙ্গীটি, বা স্বামী, মানে abusive domestic partner। আরও অনেক অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাদের তো বটেই, আমাদেরও। বিশেষত এ দেশে বন্দুক যখন এত সহজলভ্য। আমরা যারা কাজ করি এখানে, একই গোপনীয়তা বহন করতে হয় চাকরির প্রথম শর্তে, কোনও ভাবেই যেন না জানে পরিবারের লোকজনও, সান হোসের কোন পাড়ায় মিশে আছে এই সাধারণ বাড়িটা।
আর এক দিন। আমার অফিসে ফোনটা এল দুপুরে। কিম-এর শরীর হঠাৎ খুব খারাপ হয়েছে। কিম আমাদের শেল্টারে আছে বেশ কিছু দিন। ভিয়েতনামের মানুষ, বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। মুখে সব সময় হাসি, আর ভাঙা ইংরিজিতে গল্প। পৌঁছে দেখি লিভিং রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে কিম, চোখ বন্ধ, মুখ পাঙাশ, কোনও রকমে কষ্ট করে মুখ খুলে শ্বাস নেওয়ার শব্দে ভারী হয়ে আছে চারপাশ। ওর কেস ম্যানেজার বলল, অ্যাম্বুল্যান্স আসছে এক্ষুনি। ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলাম, আর তার পর বুঝতে পারলাম এর পরে কী করতে হবে। মন ভয়ে কাঁটা হয়ে উঠেছে, মাথায় প্রচুর প্রশ্ন।
কিমের নিউমোনিয়া হয়ে যায়নি তো ? ইনহেলার দরকার কি এক্ষুনি? হে ভগবান, আমরা তো ওর মেডিকেল হিস্ট্রি জানি না! কী হবে? আর হাত কিন্তু মাথা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে করতে লাগল নিজের কাজ— যন্ত্রের মতো। সমস্ত লোকাল শেল্টার, সোশ্যাল সার্ভিস, লিগ্যাল সার্ভিসের ফোন নাম্বার সরিয়ে দিতে হচ্ছে, নোটিস বোর্ড সরিয়ে দিতে হচ্ছে, যাতে শেল্টারের পরিচিতি নজরে না আসে প্যারামেডিকদের। অ্যাম্বুল্যান্স এল। অক্সিজেন দেওয়ার কিছু ক্ষণ পর কিমের শরীরটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল। তার পর শুরু হল প্রশ্ন। ‘ওঁর কি হাঁপানি আছে?’ ‘এর আগে এ রকম কত বার হয়েছে?’ ‘শেষ কবে হয়েছে?’ আর প্রত্যেকটা প্রশ্নে আমাদের উত্তর, ‘জানি না।’ ‘ভেরি সরি, জানি না।’ এ বার হাসপাতালের লোকেরা খুব ভুরু কুঁচকে নজর করতে থাকে আমাদের। বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন বয়সের মহিলা। যারা সবাই ফর্মাল জামাকাপড় পরে আছে।
কিম মাতৃভাষায় কী যেন বলে ওঠে বিড়বিড় করে। কার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে মানুষটা? যাদের জন্য এই বয়সে ঘরছাড়া হতে হয়েছে ওকে? না আমাদের কাউকে খুঁজছে ও?
যাওয়ার আগে এক জন প্যারামেডিক অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠেন, ‘হোয়াট ইজ দিস প্লেস?’ দাঁড়িয়ে আছি আমরা পাশাপাশি। নিরুত্তর। এই পরিস্থিতিতে সত্যি-মিথ্যে কিচ্ছু উত্তর না দেওয়া— এটাই আমাদের ট্রেনিং। ভদ্রলোক হয়তো আঁচ করলেন কিছু, কিন্তু আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এলি আর না পেরে জিজ্ঞাসা করে উঠল, ‘ঠিক হয়ে যাবে তো কিম?’ আমি ভাবলাম, কিমের পক্ষে কোনটা ভাল? সেরে ওঠা? ভাল হয়ে ওঠে তো মানুষ ঘরে ফেরার জন্য। অসুখ সেরে যাওয়ার পর, ফেরার জায়গা না থাকলে কোথায় ফেরে মানুষ?
আবার কোনও দিন হয়তো সম্পূর্ণ অন্য ছবি— দু’দিনের জন্য আসা বাচ্চাদের খুশিতে তোলপাড় করছে বাগান, ঝলমল করছে চারদিক, ইস্টার এগ হান্ট চলছে; ছোট ছোট ঝুড়ি হাতে রঙিন প্লাস্টিকের ডিম খুঁজতে বেরিয়েছে নানান ঝলমলে ড্রেস পরা ফুটফুটে বাচ্চাদের দঙ্গল, আর নানা দেশের পাকা গৃহিণীদের রান্নার সুগন্ধে ভরে গেছে বদ্ধ বাড়িটা। কেমন একটা নিশ্চিন্ততা, আলস্য মেশানো হালকা হাওয়া যেন ঘিরে রয়েছে বাড়িটাকে। কে বলবে সে দিন ওটা আমাদের সকলের বাড়ি নয়? কয়েক জন সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন মানুষের কিছু দিনের যত্নে বোনা— এই বাড়ি?
মানুষ এ দেশে আসে পেটের তাগিদে, জীবিকার সূত্রে, পারিবারিক সূত্রে, পালিয়ে... কিন্তু আসে পায়ের তলার নতুন জমিতে ঘর বাঁধার জন্য। আর সেই নতুন ঘরটা থেকেই যখন পালিয়ে যেতে হয় রাতারাতি রক্তাক্ত ঠোঁট, ভাঙা আঙুল, ফোলা চোখ নিয়ে, বা উদ্যত বন্দুকের ভয়ে? আবার ছিন্নমূল হয়ে ভেসে যেতে হয় এক শহর থেকে অন্য শহরে, ঘর বদল করে করে, একটা সাদা বাড়িতে, বা সেই সাদা বাড়ি পেরিয়ে আরও অন্য অনিশ্চিতে? সে ইমিগ্রেশনের শেষ কোথায়?
mahuamu@gmail.com