আপনি ওষুধ কুমিয়ে নেন। আমার কাসে তিনশো ট্যাকাই আসে। উরই মধ্যে যা হয় দেন।’ বিরক্ত ওষুধের দোকানের কর্মী প্রথমে খুব খানিক খেঁকিয়ে ওঠে, তার পর ফের প্রেসক্রিপশন দেখে হিসেব করতে বসে। জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘এটা লাগবে? ক’টা?’ ‘আর এটা?’ বছর পঞ্চান্ন’র মানুষটি ‘হ, হ’ বলে সবেতেই মাথা নাড়েন। জরুরি ওষুধ, যতটা না হলে নয় ততটাই দিয়েছে দোকানের কর্মী। কিন্তু বাদ সাধছে দারিদ্র। ওই মানুষটির কাছে তিনশো টাকার বেশি নেই। আর তাই কর্মী পড়েছে ফাঁপরে। অনেক ক্ষণ নানা রকম হিসেবনিকেশ করে দেখা গেল তিনশো ছাপ্পান্ন টাকার নীচে কিছুতেই হচ্ছে না। ও দিকে চাচাজান নাছোড়। ‘তুমি কুমিয়ে দাও।’ এ বার দোকানের ছেলেটি রেগে গিয়ে বলল, ‘আমি কি সিরাপ একটু বার করে নেব বোতল থেকে? কোথায় কমাব, কোথায়? দ্যাখো তোমার ট্যাঁকে আর ছাপ্পান্ন টাকা হয় কি না।’
সরকারি হাসপাতাল চত্বরের ওষুধের দোকান। অনেকটা কম দামেই পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় ওষুধ। তবু দর-কষাকষির শেষ নেই। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দেখাতে এসেছেন মানুষটি। সঙ্গে ছেলের বউ। সে-ও জড়োসড়ো কুঁচকে রয়েছে তার নিজের অস্তিত্বটুকু নিয়ে। রাত থাকতে এসে আউটডোরে লাইন দিয়েছিলেন। বেলা একটা নাগাদ দেখানো হয়েছে। ডাক্তারবাবু ওষুধ যা দিয়েছেন তাতে ডিসকাউন্ট দিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৬ টাকা। হার্টের অসুখ। ওষুধ তো খেতেই হবে।
লাইন ছেড়ে এসে বউমার সঙ্গেই খানিক শলা করলেন ভদ্রলোক। লুঙ্গির কোঁচড় থেকে মলিন দুটো কুড়ি টাকার নোট আর একটা দশটা টাকার নোট আর ক’টা কয়েন গুনেগেঁথে নিয়ে বের করে ফের লাইন ঠেলে অন্যদের গালাগালি খেতে খেতে কাউন্টারের দিকে এগোলেন। লাইন ভাঙার জন্য খানিক তিক্ত বচসা হল লাইনে দাঁড়ানো অন্যদের সঙ্গে। তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। তারাও রাত থাকতে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদেরও বুক ঢিপঢিপ করছে— ঠিক কত টাকা হাঁকবে ওষুধের জন্য কাউন্টার থেকে।
মানুষটি শেষমেশ বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। বেশ বিরক্ত। গজগজ করছেন, ‘এই বার কী হবে। গাড়িভাড়া ছাড়া তো আর কিসু নাই। দুটো কিসু মুখে দেব, সে-ও হবার নয়কো। চল, অখন পা বাড়া। পানির কলটা কুন দিকে?’ নিশ্চুপ বউমাটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। নাইলনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে পানির কলের দিকে চললেন দুজনে।
আমার সামনে থেকে ওঁরা চলে গেলেন। খুব খানিক রাগ করতে করতে। দোকানের কর্মীকে দোষ দিতে দিতে। সে যে চাইলেই ব্যাপারটা তিনশো টাকার মধ্যে করে দিতে পারত, দুজনেরই ঘোর বিশ্বাস।
খাওয়া নেই সারা দিন। রোদে-গরমে-সিকিয়োরিটি গার্ডের বকুনিতে থরথরিয়ে গেছে ভেতর। পেট পাকাচ্ছে খিদেয়। গোটা পঞ্চাশেক টাকায় কলকাতার রাস্তার ধারে ভাতের হোটেলে দু-মুঠো ভাত খেয়ে বৈকালের টেনে ঘর যাওয়া— সেটা আর হল না। হয়তো খুব ইচ্ছে ছিল, ডাক্তার দেখানোর পর একটু ‘আউটিং’-এর। আউটিং মানে ভিক্টোরিয়া ঘোরা নয়, একটা শহুরে ভাতের হোটেলে পাখার তলায় বসে সানমাইকা-সাঁটা টেবিলে খাওয়া, ওখানকার চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে একটু এক্সট্রা ডাল চাওয়া, এক টুকরো লেবু। ওই হাঁকডাকের মধ্যে একটু তৃপ্তির হাসি নিয়ে বসে থাকা, যেন শহরের এক জন হলাম।