Advertisement
E-Paper

একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা়]

আমাদের বৃহৎ সংসারের ছোট ছোট অংশ প্রায়শই জামসেদপুর চলে যেত। আমার সেজ জ্যাঠার পোস্টিং ছিল ওখানে। সেজ জ্যাঠা ভালমানুষ, সবাইকে নিয়ে লেপটে-জুপটে থাকতে ভালবাসতেন। আর সেই জন্য সবাই হুট বলতে ডিমনা লেক দেখতে চলে যেত।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০

আমাদের বৃহৎ সংসারের ছোট ছোট অংশ প্রায়শই জামসেদপুর চলে যেত। আমার সেজ জ্যাঠার পোস্টিং ছিল ওখানে। সেজ জ্যাঠা ভালমানুষ, সবাইকে নিয়ে লেপটে-জুপটে থাকতে ভালবাসতেন। আর সেই জন্য সবাই হুট বলতে ডিমনা লেক দেখতে চলে যেত। সেখানে ভালবাসার ধন একটি ছিল। কিন্তু সেটি, বাপ রে কী ডানপিটে ছেলে! আমার দাদাভাই। সেজ জ্যাঠার ছেলে।

ষাটের দশকে ওদের কম্পাউন্ড ছিল বহুতল। এমনকী লিফ‌্টও ছিল। দাদাভাই ফাঁক পেলেই চড়ে পড়ত লিফ্‌ট-এ। ব্যস। অমনি আর কেউ লিফ‌্ট ধরতে পারত না। কারণ, সে এক বার মহানন্দে নীচে যায়, মুহূর্ত পড়তে না পড়তে, ফের উঠে যায় ২২ তলার ছাদে। দাদাভাই ওরফে রাজার হাতে তখন কুড়ি তলার ভাগ্য। কখন লিফ্‌ট দাঁড় করাবে সে, তবে অন্য লোকে উঠতে পারবে। সবার হা-পিত্যেশ অপেক্ষা। ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখে, ‘ওরে রাজা, দাঁড়া এক বার। নেমে আয়’— এ সব আকুল আর্তি পেরিয়ে, এক সময় প্রফেসর মুখার্জি, মানে আমার জ্যাঠাকে নালিশ জানাতেই হত। অতঃপর প্রফেসরবাবু ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে রাজাকে হুংকার সহযোগে বকাবকি করে লিফ্‌ট থেকে নামাতেন। অন্যরা গনগনে রাগ চেপে, মুখে প্লাস্টিক হাসি ছেপে লিফ্‌টে উঠতে পারত। তখন রাজার বয়স বড়জোর পাঁচ।

এমনই একটা পুজোর সময় আমার মা-বাবা, পিসিরা, তাদের বড়, মেজ, ছোট সাইজের উৎপাতগুলি একসঙ্গে জামসেদপুর গেছে। যদিও আমি যাইনি। কারণ আমি তখনও হইনি। তাই অন্যের মুখে এ গল্পের স্বাদ মেটাই। পুজো থেকে ওরা বোধ হয় দিওয়ালি অবধি ছিল। আশেপাশে ফ্ল্যাটের লোকেদের সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন গড়ে ফেলা, এর বাড়ির মোচাঘন্ট ওর বাড়ির পালক-পনির’এ বিলীন হয়ে যাওয়ার যে উথলে ওঠা ভাব, মনে হয় পার্টিশন কোনও দিন হয়নি আমাদের। অবাঙালিরা বিজয়ার নেমন্তন্ন করতে ব্যস্ত, আর বাঙালিরা তখন দিওয়ালির প্রস্তুতিতে মগ্ন!

এমন একটি দিনে রাজা এবং রাজার ফ্যামিলি গিয়েছে কোনও এক মিস্টার কপূর কিংবা মিস্টার ভগবত কিংবা মিস্টার গর্গদের বাড়ি। বিজয়ার পর। থালা ভর্তি করে মিষ্টি, সঙ্গে কাজু-কিশমিশ, চানাচুর। সবাই অল্পবিস্তর নেমন্তন্ন রক্ষা করেছে। কিন্তু রাজা গুম হয়ে বসে রয়েছে। এমন উলটো চরিত্র দেখে বোধ করি ভয়ই পেয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী। তিনি খুব আদরের গলায় নাকি জি়জ্ঞেস করেছিলেন, ‘রাজা, তুমি এত ভালবাসো কাজু-কিশমিশ, কই খাচ্ছ না যে?’ এই বার মঞ্চে রাজার প্রবেশ। ‘খেতে তো আমার ভালই লাগে, ইচ্ছেও করছে। কিন্তু মা বারণ করেছে। বলেছে, লোকের বাড়ি দিলেই খেতে নেই। বলেছে, থালা শেষ করে খেয়ে নিলে তোমরা হ্যাংলা বলবে।’ ঘরে নিঃশব্দ বোমা বিস্ফোরণ।

এ বার আমার বাড়ির লোকেদের মুখ কালো, লাল। সঙ্গে সেজজেঠিমার চোখ জ্বালা। ব্যাপার গম্ভীর বুঝে দু-পক্ষেরই হেসে উড়িয়ে ভারী সহজ হওয়ার চেষ্টা। দু-পক্ষেরই বেমক্কা লজ্জা। কারণ দুরন্ত ছেলের নামে পড়শিরাও কম কথা চালাচালি করেনি, আবার দুরন্ত ছেলেটি বাড়ির শাসন এ ভাবে সব্বার সামনে বেআব্রু করে দেবে— এমনটাও ভাবা যায়নি। ও পক্ষ ভাবছে, এ বাবা রাজার নামে যা বলেছি, ওদের বাড়ির লোক জেনে ফেলল! আর এ পক্ষ ভাবছে, কী করে যে শেখাই ছেলেটাকে। কেবল ছেলেটা বিন্দাস!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy