Advertisement
E-Paper

একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

একটা সময়, যখন নিজের পড়াশোনা করা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই গল্পের বইয়ের নেশা খুব পেয়ে বসে বা বসত। তখন নাইতে খেতে সময় অমিল। খেতে বসেও মুখে বই, মায়ের বকুনি। বাসে-ট্রামে সিট পেলে তো কথাই নেই, না পেলেও পরোয়া নেই। ভিড় কম থাকলে কোনও মতে বইটা বের করে পড়া শুরু। তাতে পাশের লোককে খোঁচা দেওয়া ও খাওয়া— দুটোই অবধারিত।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০

একটা সময়, যখন নিজের পড়াশোনা করা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই গল্পের বইয়ের নেশা খুব পেয়ে বসে বা বসত। তখন নাইতে খেতে সময় অমিল। খেতে বসেও মুখে বই, মায়ের বকুনি। বাসে-ট্রামে সিট পেলে তো কথাই নেই, না পেলেও পরোয়া নেই। ভিড় কম থাকলে কোনও মতে বইটা বের করে পড়া শুরু। তাতে পাশের লোককে খোঁচা দেওয়া ও খাওয়া— দুটোই অবধারিত। কিন্তু পড়ার টান সাংঘাতিক। এখন যেমন মোবাইলের। ভিড় মেট্রোতেও যেমন কলেজের ছেলেমেয়েরা অবলীলায় খেলে যায় বা গান শুনে যায়, কিংবা রাস্তা ক্রস করার সময় টেক্সট করে— ঠিক তেমন টান।

এমন টানের বেলায় এক দিন বিকেলের দিকে ট্রামে চড়ে এসপ্ল্যানেড থেকে ফিরছি। বসার সিটও পেয়েছি। অতএব ফুরফুরে হাওয়ায় জানলার ধারে চুল উড়িয়ে বই খুলে বসেছি। বই পড়লে যে কেবল বইটুকুই দেখা যায়, তা তো নয়। চারপাশে কী হচ্ছে, তা-ও খানিক ঠাওর করা যায়। কে উঠে গেল পাশ থেকে, কে বসল। কেউ এসে দাঁড়াচ্ছে কি না, এ সবই ঠাওর-যোগ্য।

ট্রাম চলার কিছু ক্ষণ পরেই আমি বুঝলাম আমার সামনে কন্ডাক্টর এসে দাঁড়াল। আমি টিকিটের পয়সা আগে থেকেই মজুত রেখেছিলাম হাতে। বই থেকে মুখ না তুলেই হাত বাড়িয়ে দিলাম। এই বার চমক ভাঙল না লাগল ঠিক বুঝিনি। হতভম্ব। হাতে টিকিটের বদলে দুটো লজেন্স। আমি জাগতিক পৃথিবীতে মুখ তুলে দেখি আমার সামনে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে এক জন খাকি পোশাক পরা লজেন্সওয়ালা।

আমার বিস্ময় তখনও ভাঙেনি বলে আমি না চাইতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘আমি তো টিকিট কাটতে চাই।’ উত্তর এল, ‘তা হলে আপনি আমায় পয়সা দিলেন কেন? আমি কি টিকিট বেচি দিদি?’

চার দিকে হাহা হোহো হিহি। এ ওকে ঠেলছে, মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমার বুদ্ধুমিতে সবাই মজা লুটছে। আমার কান গরম হয়ে উঠছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবু অনেকটা মনের জোর জড়ো করে বললাম, ‘আপনি খাকি পোশাক পরেছেন কেন? ট্রামে তো কন্ডাক্টরই এমন পোশাক পরে থাকে। তাই আমার ভুল হয়েছে।’

লজেন্সওয়ালা তেড়েমেরে উঠলেন, ‘কেন অন্য লোকের কি খাকি পোশাক পরা বারণ? অ্যাই কন্ডাক্টর, তুমি ছাড়া কেউ খাকি রং পরতে পারে না? আমি ট্রামে ট্রামে লজেন্স বিক্রি করি আজ তিরিশ বছর, কই কেউ তো আমায় কিছু বলেনি। আমায় সবাই চেনে। অমন বই মুখে করে বসে থাকলে, এই হালই হবে। আমার দিকে পয়সা বাড়িয়ে দিয়েছেন, আমিও লজেন্স দিয়েছি। ভুলটা কোথায়?’

লজেন্সওয়ালার কাছে যারপরনাই বকুনি খাওয়ায় গোটা ট্রামের তামাশা আরও দ্বিগুণ মাত্রা পেল। আমি লজ্জায়, রাগে লজেন্স দুটোকে ছুড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিলাম। আমার অন্যমনস্কতার মাশুল যে এতখানি দিতে হবে, বুঝিনি।

এখনও যখন গল্পটা কোনও আড্ডায় বলি, সবাই আমায় নিয়ে খুব হাসাহাসি করে, ‘সত্যি, তুই না... পারিস বটে!’ আমি নিজেও তাতে যোগ দিই। কিন্তু লজ্জায় কান অনেকটা লাল হয়ে গেলে জোর গলায় এক বার বলে নিই, শোনো বাপু, এটা কিন্তু ঠিক, এর আগে বা পরে কখনও কোনও দিন কোনও খাকি পোশাক পরা লজেন্সওয়ালাকে ট্রামে লজেন্স বিক্রি করতে দেখিনি!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy